সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৭)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৭)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৭তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব  ষষ্ঠ পর্ব 

সপ্তম পর্ব  অষ্টম পর্ব  নবম পর্ব  দশম পর্ব 

পর্ব ১১  পর্ব ১২  পর্ব ১৩  পর্ব ১৪  পর্ব ১৫  পর্ব ১৬

সোশ্যাল মিডিয়ার সার্বিয়ান বন্ধু

হোটেল লবিতে তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে রয়েছেন ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডরসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সার্বিয়াতে আমাদের যে টিম, তাদের সবাই জড়ো হয়েছেন। অ্যাম্বাসেডরের ব্যক্তিগত নিমন্ত্রণে রাতের খাবার। দানিউবের তীরে ল্যাঙ্গোস্টের মতো কোনো রেস্টুরেন্টে।

‘আমি ফরমাল এই ডিনারে যেতে চাই না।’

কানে কানে বলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের পরিচালক এমদাদ চৌধুরীকে। আমার প্রতি ভদ্রলোকের সব সময়ের সমর্থন। আমার কোনো বিষয়ে একমত না হলেও অন্তত সঠিক পরামর্শ দেন। কিন্তু এবার যেন আকাশ থেকে পড়লেন!

‘অ্যাম্বাসেডরের দাওয়াত কেউ মিস করে?’

আমার সিদ্ধান্ত তার মনমতো হলো না। ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাম্বাসেডরের নিমন্ত্রণ স্কিপ করা তার জন্য কঠিন। বস যেমন অলয়েজ রাইট, তেমনি বসের দাওয়াতেও সব সময় হাজির থাকতে হয়। আমি আর কী করি!

এবার সাহস করে অ্যাম্বাসেডর স্যারকেই বলে ফেললাম, ‘আমার এক বন্ধুকে আসতে বলেছি হোটেলে। সে রাস্তায়, কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে।’ অ্যাম্বাসেডর ভদ্রলোকও সজ্জন ব্যক্তি।

হাসিমুখে বললেন, ‘তার সঙ্গে গল্প করবে? রাতে খাবারে সমস্যা হবে না?’

আমায় আর পায় কে!

বাকি রইলেন মন্ত্রী মহোদয়। গাড়িতে যখন সবাই উঠছে, সাহস করে বলে ফেললাম মন্ত্রী মহোদয়কেই। ‘স্যার, আমার এক বন্ধু আসছে। তার সঙ্গে আমি একটু সময় কাটাই। এই ডিনারটা স্কিপ করতে চাইছি।’ স্যার যেন আকাশ থেকে পড়লেন!

‘সার্বিয়াতে তোমার বন্ধু? কীভাবে? সে কে? সাংবাদিক?’

কাঁচুমাচু করে বললাম, ‘জি স্যার, সাংবাদিক।’

‘তাকে চেনো কীভাবে? আগে থেকেই পরিচয় ছিল?’

‘জি স্যার।’

‘কীভাবে? আমেরিকা, লন্ডন হলে তাও কথা ছিল। এই সার্বিয়াতেও তোমার পরিচিত আছে?’

‘জি স্যার। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এখন নেটওয়ার্কটা ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। সবাইকে রিচ করা সহজ। পৃথিবীটা ছোট হয় নি শুধু, হাতের নাগালেও এসেছে।’

মন্ত্রী মহোদয়ের বিস্ময় কাটছে না। অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা বুঝলাম। কিন্তু এই সার্বিয়ার বুকেও ওর নেটওয়ার্ক? কত স্মার্ট এই যুগের ছেলেমেয়েরা! তোমার বন্ধু কি ছেলে না মেয়ে?’

এবার আর কী বলি? হাসি দিয়ে পার পাইতে চাইলাম। দুনিয়াজুড়ে ছোটোখাটো বিপদ থেকে রক্ষায় মৃদু হাসির ভূমিকা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ।

এ যাত্রায় ম্যাডাম রক্ষা করলেন, ‘ও যেতে চাইছে না, থাকুক। চলো আমরাই যাই।’

স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, মন্ত্রী মহোদয়ের মনে তখনো এই বন্ধুত্ব নিয়ে সংশয়। কাকে পেল, কোত্থেকে পেল?

১৫ মিনিটের মধ্যেই চলে এল সানজা স্টোজানিচ। লবিতেই ছিলাম, খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না। দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরল। যেন কতদিনের সখ্য, কত বন্ধুত্ব! অথচ তার সঙ্গে পরিচয় মাত্র মাস খানেকের। ট্যুর কনফার্ম হওয়ার পর সার্বিয়া নিয়ে জানার জন্য গুগলে সার্চ করছিলাম। খোঁজাখুঁজি চলে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। সার্ব তরুণরা ফেসবুক, টুইটারের চেয়ে ইন্সটাগ্রাম বেশি ব্যবহার করে। ইন্সটাগ্রামে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব। ছোটখাটো আমার কত শত প্রশ্ন, সবগুলোর উত্তর দিয়েছে সে।

নেট দুনিয়াতে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপন। সার্বিয়ার তরুণেরা কী পছন্দ করে। কেমন শিক্ষাব্যবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়ার হালহকিকত। বাংলাদেশ নিয়েও তার আগ্রহ। পাকিস্তান-ভারত-চীনের ভূরাজনীতি নিয়ে তার কিছু পড়াশোনা আছে। তা থেকে বাংলাদেশ বিষয়ে ভালোই জানাশোনা।

স্টোজানিচ কাজ করছে জাতিসংঘের একটি সংস্থায়, শিশুখাদ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক একটি প্রজেক্টে। ইউনিভার্সিটি অব বেলগ্রেড থেকে পড়েছে পলিটিক্যাল সায়েন্সে। আজকের এটি নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎ। তার দেশে গিয়েছি বলে এসেছে দেখা করতে। হোটেল লবির বাইরে খোলা প্রান্তরে দাঁড়াই।

—নাও, হাত বাড়িয়ে ধরে সিগারেটের প্যাকেট।

এই দেশে স্মোকিং খুবই মামুলি ব্যাপার। রাস্তাঘাটে সবাই স্মোক করে। অনেকটা ঢাকার মতোই। ঢাকায় একবার আইন করে পাবলিক প্লেসে স্মোকিং নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কাগজেকলমে এখনো আইন আছে। লোকজন মানে না। সার্বিয়াতে এসব আইনের বালাই নাই। ইচ্ছা হলেই সিগারেট ধরানো যায়।

স্টোজানিচের চোখগুলো নারকেল রঙের। চুলের রং বাদামি। সার্বিয়ান মেয়েদের সঙ্গে তুর্কি মেয়েদের মিল আছে। গায়ের গড়ন আর রং—একই রকম। ওর গায়ে কালো রঙের ভারী কোট। পায়ে বুট জুতা।

‘কেমন লাগছে সার্বিয়া?’

‘ছবির মতো সুন্দর দেশ, ঠান্ডা বেশি।’

‘প্রথমবার এসেছ বলে শীতের প্রকোপ বেশি ঠেকছে। ক’দিন থাকলে গা-সওয়া হয়ে যাবে।’

‘আমাদের দেশে শীত কম। তাই বেশি শীত সহ্য হয় না। তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া মিটেছে?’

একটু হেসে নেয়। বলে, ‘বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ভাবি না। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া ঠিক নাই। মনে না মিললে খালি শরীর দিয়ে কদিন যাওয়া যায়? ছেড়ে দিয়েছি। সে থাকছে তার আগের ফ্রেন্ডের সঙ্গে। আমি এখনো একা। ঠিকই জুটিয়ে নেব।’

পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।

‘তোমার পরিবারের সদস্যরা? তোমার ছোট ভাইটা মিস করে না তোমাকে?’

‘ওরা নোভিসাদেই আছে। সপ্তাহে এক দিন গিয়ে থেকে আসি বাবা মায়ের কাছে। ছোট ভাইটা দুষ্টু হয়ে গেছে, ভীষণ মিস করি ওকে।’

ব্যক্তিগত, পারিবারিক কত গল্প ওর সঙ্গে। কথা বলি আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার চাকরিবাকরি, বিশ্বজনীন শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি, ট্যুরিজম ট্রেন্ডস নিয়ে।

কবি আবু হাসান শাহরিয়ার স্টোজানিচকে দেখলে কয়েকটা কবিতা লিখে ফেলতেন। বাংলাদেশের কবিদের নারী, নদী ও প্রকৃতি প্রেম নিয়ে বলি তাকে।

হা হা করে হাসে। তার আগ্রহ থিয়েটারে। বাংলাদেশের থিয়েটার, নাটক, সংস্কৃতি নিয়ে জানতে চায়।

ভালো রিপ্লাই করতে পারি নি। সমাজে চলার জন্য কতকগুলো নাটক, থিয়েটার আর চলচ্চিত্রের নামটাম মুখস্থ রাখি। অভিনয় জগতের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগও আছে। পরদেশি বন্ধুকে বলার মতো এত জানাশোনা কি আর আছে? স্কিপ করে যাই। সিগারেট একটা শেষ হয়ে আরেকটা শুরু হয়। ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে আমাদের আলাপন। আমি অবশ্য জানতে চাই নি, তবুও সার্বিয়ান সংস্কৃতি নিয়ে একটু বলে গেল সে।

মোটামুটি ধারণা রেখে সে বলে গেল। আমি পরে বইয়ে লেখার জন্য দিন-তারিখ, নাম-ধাম সব ঠিক করে নিই।

দুনিয়ার হাজারটা প্রসঙ্গ মনে হয় এল। সে চটপট কথা বলে। টপিকের পর টপিক, যেন লাইব্রেরিতে তাকে তাকে সাজানো বই। সময় চলে যায়, কত দ্রুত— খেয়ালই করি নি। ঘণ্টাখানেক একসঙ্গে ছিলাম। আমি বেলগ্রেড ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার আগ্রহ দেখাই। সে জানায়, তার তেমন কোনো কাজ নাই। আমি সময় করতে পারলে তাকে যেন ফোন করি। সঙ্গে করে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাবে। পার্কিংয়ে গিয়ে গাড়ি বের করে। সাদা রঙের এক জিপ গাড়ি। বিদায় চোখে তাকিয়ে রই, এই জীবনে আর কখনো দেখা হবে কি না— কে জানে! 

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.