পুতুলনাচ আমাদের দেশের গ্রামবাংলার একটি জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে বিপিন পাল প্রথম পুতুলনাচের প্রচলন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদে কৃষ্ণনগর নামে পল্লিতে বিপিন পালের জন্ম।
বিপিন পাল তৎকালীন সময়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বন করে পুতুলনাচ করতেন বলে জানা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনপদে আরও কয়েকজনের নাম জানা যায়, তারা হলেন জেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের গিরীশ আচার্য্য, মো. তারু মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেন্ডা বা মেরুড়া এলাকার ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন ও পৌর শহরের কাজীপাড়া এলাকার শরীফ মালদার। ধন মিয়ার পুতুলনাচ দলের নাম ছিল ‘রয়েল বীণা অপেরা’। ধন মিয়া’র পুতুলনাচ দল দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিল। এ ছাড়াও সুমী বীনা পুতুলনাচ ঝুমুর পুতুলনাচ দল পুতুলনাচ প্রদর্শন করে চলেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যতদূর জানা যায়, পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে পরিচালিত পুতুলনাচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনপদের এক ঐতিহ্য। বছরের বিশেষ সময়ে মেলা পল্লিতে পুতুলনাচ প্রদর্শন হয়ে থাকে। অন্যদিকে শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় আজকাল পুতুলনাচ হয়ে থাকে।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম সম্পদ পুতুলনাচ। পুতুলনাচ এক ধরনের লোকশিল্প, যা বহু যুগ আগে থেকে মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি আমাদের দেশে বেশ প্রসিদ্ধ।
একসময় পুতুলনাচের সংস্কৃতি দেশে-বিদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু উন্নত বিশ্বের কাছে পুতুলনাচের জৌলুস প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই ঐতিহ্যের চিত্র আবারও ফুটে উঠেছে সর্বত্র।
প্রাণবন্ত পুতুল এবং এর কার্যকলাপ পুতুলনাচের মূল আকর্ষণ। কাঠ, কাপড় এবং রঙের মিশেলে তৈরি এই পুতুলগুলো নানা রকম চরিত্রে মঞ্চে হাজির হয়। তাদের নাচ, গান এবং অভিনয়ের মাধ্যমে জীবনের নানা দিক ফুটে ওঠে। পুতুলনাচের কাহিনিগুলো সাধারণত লোককথা, রূপকথা এবং সামাজিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়ে থাকে। বাঙালির পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব ও বিভিন্ন গ্রাম্য মেলায় তা প্রদর্শন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এর সংগীত এবং নৃত্য। লোকসংগীতের তালে তালে পুতুলগুলোর সুনিপুণ নৃত্য পরিবেশন দর্শকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এই নাচের সুর, তাল এবং নিখুঁত সামঞ্জস্যতা প্রাণবন্ত এবং ভীষণ উপভোগ্য।
আমি ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের আশেপাশে ও নব্বইয়ের দশকে ফরিদপুরে বেশ কয়েকটি মেলায় পুতুলনাচ দেখেছি। আমার কাছে সব সময় রূপকথার ও হাসির গল্পের পুতুলনাচগুলো দেখতে খুব বেশি ভালো লাগত। অনেক সময় একই শো পরপর দুইবারও দেখেছি। তখনকার নির্মল সুন্দর গল্পগুলো এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুতুলনাচগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দ চিত্তে উপভোগ করতাম। আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম পর্দার আড়ালে থাকা পুতুলনাচের শিল্পীদের সুনিপুণ হাতের কাজ। ছোট নিষ্প্রাণ কাঠের পুতুলগুলোকে নাচাতে কিংবা অভিনয়ের প্রকাশ ঘটাতে কখন কোন সুতায় টান দিতে হবে- সেই কাজে তাদের বিন্দুমাত্র ভুল কিংবা ছন্দপতন হতে আমি কখনো দেখি নি। ঠিক যে কারণে পুতুলনাচের পুরো অনুষ্ঠানটিই আমার কাছে জীবন্ত মনে হতো। গল্পের কাহিনির সাথে মিল রেখে ওরা নিপুণ হাতে স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি টানিয়ে থাকে। নিঁখুত ছবির কারণে পুতুলনাচের দৃশ্যগুলো প্রাণবন্ত লাগে। এই পুতুলনাচ দেখতে আবালবৃদ্ধবনিতা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের সকল বয়সের মানুষের মেলায় আগমন ঘটে। বিশেষ করে শুধু পুতুলনাচ দেখতে শিশু-কিশোর দর্শকদের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। যেমনটি ঠিক আমার বেলায় ঘটেছিল। প্রতিটি কাহিনি নির্মাণ ও প্রদর্শন করতে পুতুলনাচ শিল্পীদের প্রচুর অনুশীলন করতে হয়। পুতুলনাচের শিল্পীদের মেধা ও দক্ষতা দেখে আমি সব সময় বিস্ময়বোধ করেছি। আমাদের সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরে পুতুলনাচ প্রদর্শনের জন্য একটি স্থাপনা আছে। সেখানে একসময় নিয়মিত পুতুলনাচ দেখানো হতো। অজ্ঞাত কারণে বিগত প্রায় দেড় বছর ধরে পুতুলনাচ দেখানো বন্ধ আছে বলে সেখানকার এক স্থানীয় মানুষের কাছে জানতে পেরেছি। এটা চালু থাকলে আমাদের মতো অনেক উৎসুক মানুষ ছুটির দিনগুলোতে সেখানে বেড়াতে গিয়ে পুতুলনাচ দেখার সুযোগ পেত।
পুতুলনাচের পুতুলগুলি সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে: তারের পুতুল, লাঠিপুতুল, বেণিপুতুল ও ছায়াপুতুল। তারের পুতুল সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে এবং লাঠিপুতুল লম্বা সরু লাঠির সাহায্যে নাচানো হয়; আর দুই বা ততধিক পুতুল যখন একসঙ্গে বেঁধে হাত দিয়ে নাচানো হয়, তখন তাকে বলে বেণিপুতুল।
বাংলাদেশে তারের পুতুল ও লাঠিপুতুলের চর্চাই বেশি হয়। এক্ষেত্রে শিল্পী দুহাতে সর্বোচ্চ তিনটি পুতুল ধরে সংলাপ বা সুরের তালে তালে পুতুলকে নাচান। পুতুলনাচে সাধারণত রাধাকৃষ্ণ, সীতাহরণ বা রামায়ণ-মহাভারতের অন্যান্য কাহিনি এবং লোকজীবনের বিভিন্ন কিসসা, পালাগান ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। এছাড়া সমসাময়িক ঘটনাবলি, যেমন শিশু, নারী ও বয়স্ক শিক্ষা, সুখী পরিবার, দাম্পত্যজীবন, প্রেম-বিরহ, জামাই-শাশুড়ি ও বউয়ের কলহ ইত্যাদিও লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন মেলা ও লোকজ উৎসব-অনুষ্ঠানে পুতুলনাচের আসর বসে। এটি এখন লোকমনোরঞ্জনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম।
যে-কোনো গল্প বা কাহিনি অবলম্বনে পুতুলগুলি দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন চরিত্র রূপায়িত করে। চরিত্রানুযায়ী পোশাক-পরিচ্ছদ, রূপসজ্জা এবং নানাবিধ উপকরণ সংযোজন করে পরিচালক পুতুলের অভিনয়শৈলী তুলে ধরেন। মানুষের মতোই পুতুলগুলি হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, রাগ-দুঃখ ইত্যাদির অভিনয় করে। সাধারণ নাটকে স্থানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও পুতুলনাচে তার বিস্তৃতি অনেক। জলের প্রাণী, আকাশের পাখি, ডাঙার মানুষ, বনের পশু- সবই কাহিনির প্রয়োজনে একমঞ্চে এক সঙ্গে অভিনয় করে। নির্বাক পুতুলসহ সব প্রাণীই নিজস্ব আচার-আচরণের পাশাপাশি মানুষের ভাষায় কথা বলে। ফলে পুতুলনাচ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও আনন্দময় এবং সব বয়স ও শ্রেণির দর্শকেরা তা সানন্দে উপভোগ করে।
বিশ শতকে আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে পুতুলনাচ স্বীকৃত হয় এবং টেলিভিশন আবিষ্কারের পর তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। চারু ও কারুকলা শাখার প্রায় সব কয়টি ফর্মের ব্যবহার ও প্রয়োগ একে টোটাল আর্ট ফর্মের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
গল্প, কবিতা, নাটক, অভিনয়, গান, নৃত্যকলা, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য দৃশ্যমান আর্টের সার্থক মিলন ঘটেছে পুতুলনাচে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুতুলনাচ একটি পুরাতন শিল্পকলা হিসেবে পরিচিত। ইউরোপে পুতুলনাচের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধারক জার্মানি। মধ্যযুগে ইটালিতে ‘পুলসিনেলো’ নামে আবির্ভাব ঘটে সুতা পাপেটের, ফ্রান্সে যার নতুন নাম হয় ‘পলসিনেল’। দস্তানা পাপেটের জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে জন্ম নেয় ‘পাঞ্চ’। এই পাঞ্চ চরিত্রের প্রতিরূপ দেখা যায় রাশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে। জার্মানি ও সুইডেনে পাঞ্চের নাম ‘কাসপার’, হল্যান্ডে ‘ইয়ান ক্লাসেন’ এবং হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ায় ‘ভাসিলচে’। এছাড়াও মিশর, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় পুরোনো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা পাপেট থিয়েটার, পিপলস থিয়েটার, ডলস থিয়েটার এবং বর্ধমান পাপেট থিয়েটার আধুনিক ধারায় পুতুলনাচের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
পুতুলনাচের কাহিনিগুলো সাধারণত লোককথা, রূপকথা এবং সামাজিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বানানো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সংগীত এবং নৃত্য। লোকসংগীতের তালে তালে পুতুলগুলোর সুনিপুণ নৃত্য পরিবেশন দর্শকদের আকৃষ্ট করে। আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই পুতুলনাচ ও পাপেট শো-কে মিলিয়ে ফেলে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কয় শ্রেণির পুতুলনাট্য পরিবেশনা হয় তার মধ্যে একটি হলো সুতা পুতুল, যেটা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের অংশ। আরও আছে হ্যান্ড পাপেট বা হাত পুতুল, রড পাপেট বা শিক পুতুল ও শ্যাডো পাপেট বা ছায়া পুতুল।
বাংলাদেশে পুতুলনাচের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। প্রাচীন বৃহত্তর বাংলার বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা এবং মণিপুরের নদীতীরবর্তী জেলাগুলোতে পুতুলনাচের প্রচলন ছিল। আর্যরা যখন বঙ্গদেশে এল সেসময় অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশকে গৌড় বলা হতো আর দক্ষিণ বঙ্গকে বলা হতো সমতট। দক্ষিণ বঙ্গের বিস্তার বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ থেকে শুরু করে হুগলি নদীর পূর্বতট সুন্দরবন পর্যন্ত। এই ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বাংলার পুতুলনাট্যপালার চর্চা ছিল। এটাই ছিল সনাতন পুতুল শিল্পীদের আদি ভূখ-। এইসব অঞ্চলে পুতুল তৈরির পর্যাপ্ত উপকরণ, উপযুক্ত কারিগরি জ্ঞান, নদী নালার পথে যাতায়াত সহজলভ্য হওয়ায় পুতুল শিল্পচর্চা গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়।
একসময় বর্ষাকাল ছাড়া বছরের বাকি মাসগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে পুতুলনাচের দল পুতুলনাচ পরিবেশন করে বেড়াত। সেসময় গ্রামীণ জনজীবনে পুতুলনাচই সাধারণ মানুষ ও শিশু-কিশোরদের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম ছিল। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর ও রংপুরে পুতুলনাচের প্রাচীন ধারার শিল্পীদের অস্তিত্ব এখনো আছে। এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেই পুতুলনাচের প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্পীরা এখনো পুতুলনাচের মূল ধারাকে টিকিয়ে রেখেছেন। পুতুলনাচ শিল্পীরা পুতুলনাচের মাধ্যমে তুলে ধরেন কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) বিষয়ক সচেতনতা বার্তা, গাছ না কাটার অনুরোধ। গল্পের মাধ্যমে বলা হয় করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়ার কথা, মাস্ক পরা ও পরিচ্ছন্ন থাকার কথা।
২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছরের ২১ মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস উদ্যাপন এবং প্রতি বছর একজন শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ঐতিহ্যবাহী দলগুলোকে নিয়ে প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ দিন পুতুলনাট্য উৎসবের আয়োজন করছে। শিল্পকলা একাডেমি ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য শিল্পী ও নবীন নাট্যকর্মীদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য উৎসবে বাংলাদেশ থেকে দল পাঠানো হয়েছে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতায় শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের গল্প’ শীর্ষক পুতুলনাচ ‘বিশ্ব পুতুলনাট্য উৎসব’-এ অংশগ্রহণ করে ‘বেস্ট ট্রাডিশনাল মিউজিক্যাল পাপেট শো অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে। ২০১৮ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘পুতুলনাট্যশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
আশির দশকে রাশিয়াতে আন্তর্জাতিক পুতুলনাচের একটা বড় আসর হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের মূলধারার একজন পুতুলনাচের শিল্পীÑব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘রয়েল বীণা পুতুলনাচ’-এর ধন মিয়া রাশিয়াতে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বাংলাদেশের পুতুলনাচ প্রদর্শন করেন। সারা পৃথিবীতে সেটি খুব প্রশংসিত হয়েছিল। বাংলাদেশের ধন মিয়ার পুতুলনাচের পরিবেশনা ব্যাপক দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি অনেক উৎকর্ষ দিয়ে পুতুলনাচকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনযোগ্য করে তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এক ধরনের অবহেলা থেকেই পুতুলনাচের এই ক্ষয়িষ্ণু জায়গা তৈরি হয়েছে। পুতুলনাচ পরিবেশনার মূল ক্ষেত্র হলো মেলা। বাংলাদেশে আগে বছরে কয়েক সহস্র মেলা হতো। বিভিন্ন সাধক পুরুষদের তিরোধান ও জন্মতিথিতে মেলা হতো, পুণ্যস্নানের মেলা হতো। পহেলা বৈশাখে সারা বাংলাদেশে মেলা হতো। এছাড়া ঈদে, পুজোয়, পৌষ পার্বণে, শীতকালে গ্রামে গ্রামে বার্ষিক মেলা হতো। এই মেলাগুলো একদম প্রান্তিক পর্যায়ে হতো। পনেরো দিন থেকে শুরু করে এক মাস, দেড় মাসব্যাপী, কখনো কখনো তিন মাসব্যাপীও মেলাগুলো চলত। এই মেলাগুলোকে আশ্রয় করেই পুতুলনাচ চলত। জানা গেছে জয়পুরহাটে একবার একই প্যান্ডেলের ভেতরে অনেকগুলো পুতুলনাচের দল একসাথে পরিবেশন করেছে।
পুতুলনাচের দলগুলোর সরকারি লাইসেন্স নিতে হয়। জনৈক পুতুলনাচ দলের মালিক ছামছুর খাঁ আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিভিন্ন মেলায় কিছু লাইসেন্সবিহীন দল এসে পুতুলনাচের প্যান্ডেল টাঙিয়ে অশ্লীল নাচ-গান পরিবেশন করে। আর দোষ হয় আমাদের, যারা আমরা পুতুলনাচ দেখাই। অনেক সময় নাচ বন্ধ রেখে এ ধরনের অশ্লীল নৃত্য চালানো হয়। তাই গ্রামেগঞ্জে শো করতে গেলে আমরা অনেক সময় বাধার মুখে পড়ি। স্থানীয় মুরব্বিরা শো করতে বাধা দেন। কারণ সাধারণ মানুষ তো আর বোঝে না যে পুতুলনাচের শিল্পীরা এসব পরিবেশন করে না। এসব অশ্লীলতা দূর করা গেলে পুতুলনাচের সুদিন ফিরে আসত। গ্রামের মা-বোনেরাও পুতুলনাচ দেখতে আসতেন। এর জন্য শুধু যেসব দলের লাইসেন্স আছে সেসব দল ছাড়া আর কোনো দল যেন মেলায় পারফরম করতে না পারে সেদিকে প্রশাসনের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।’ কিছু আজেবাজে অনিবন্ধিত পুতুলনাচ দলের কারণে সমাজের রুচিবান মানুষরা আজকাল পুতুলনাচ দেখা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আমরা পরিবার পরিজনদের নিয়ে মার্জিত পুতুলনাচ দেখতে চাই। পুতুলনাচ থেকে অশ্লীলতা দূর করতে হবে, নইলে আমাদের দেশের গ্রামবাংলার প্রাচীন এই লোকশিল্পটি ধ্বংস হতে বাধ্য। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এবং এই শতাব্দীর শুরুতে সিরিজ বোমা হামলাসহ বিভিন্ন কারণে প্রশাসন থেকে মেলা ও জনসমাগমে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এসব কারণে অনেক জায়গায় মেলা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুতুলনাচ পরিবেশনার সুযোগও কমে যায়। এভাবে পুতুলনাচ ও সার্কাসের অনেক দল ভেঙে যায়। তারা ভিন্ন পেশায় চলে যায়। কারণ আগে তারা শুধু পুতুলনাচ পরিবেশন করেই জীবিকা নির্বাহ করত।
আমাদের দেশের পুতুলনাচের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এর সংরক্ষণ ভীষণ জরুরি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই পুতুলনাচ সম্বন্ধে কোনো ধারণা রাখে না। ওরা পুতুলনাচকে পাপেট শোর সাথে গুলিয়ে ফেলে। আজকাল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মেলা, স্কুল এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামে পুতুলনাচ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সমাজের সব স্তরের মানুষের সহযোগিতায় এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকবে এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন তৈরি করবে- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। কারণ পুতুলনাচ শুধু বিনোদন নয়, এটি একটি শিক্ষামূলক মাধ্যমও বটে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে এই শিল্পটির জুড়ি মেলা ভার। বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে পুতুলনাচ শিল্পের আধুনিকায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পুতুলনাচ শিল্পের প্রাণ হলো এর স্টেজ শো, সেই জায়গাতেই একে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.