নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (ষষ্ঠ পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (ষষ্ঠ পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব।]

মহিলাকে নামিয়ে দিলাম এবং পথঘাট না হারিয়ে মোটামুটি এক চান্সেই ম্যানহাটানে ফিরে এলাম। ডাউন টাউনে ঢুকেই ‘অফ ডিউটি’ লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। এই এলাকা থেকে প্যাসেঞ্জার নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তাঘাট অতি জটিল। প্রতিটা রাস্তার নাম ভিন্ন। চেম্বার  স্ট্রিট, এল্ক স্ট্রিট, রিড স্ট্রিট- বিচিত্র নামের সব রাস্তা। সেন্টার স্ট্রিট ধরে আপ টাউনের দিকে যাচ্ছি। দুই সিটের মাঝখানের হ্যান্ড রেস্টে ম্যাপের বইটা খুলে রেখেছি। রেড লাইতে থামলেই ম্যাপের দিকে তাকাই। কারণ ওই যুগে জিপিএস ছিল না। সেন্টার স্ট্রিট, লাফায়েট স্ট্রিট, ফোর্থ এভিনিউ পার হয়ে ইউনিওন স্কয়ারের কাছে গেলাম। এখন রাস্তাঘাটের নাম্বার চোখে পড়ছে। তাছাড়া এই এলাকাটা আমার পরিচিত। আমার রেগুলার কর্মস্থল কাছেই। অফ ডিউটি লাইটটা নিভিয়ে দিলাম। আমেরিকান এক পরিবার গাড়িতে উঠল। উঠেই বলল, ম্যাডিসন এভিনিউ অ্যান্ড নাইনটি ফোর স্ট্রিট। সাথে এটাও বলল, সোজা পার্ক এভিনিউ ধরে চালিয়ে যাও। নাইনটি থার্ড স্ট্রীটে লেফট টার্ন করবে।

মনে মনে খুশি হলাম। সহজ ট্রিপ। হয়তোবা একটু বেশিই খুশি হয়েছিলাম, এজন্য মিটার চালু করতে ভুলে গেলাম। প্রায় দশ ব্লক এগোনোর পর খেয়াল করলাম, লোকজন আমার ট্যাক্সির দিকে হাত উঁচু করে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে মহিলা যাত্রীটি বলল, স্যার তুমি মিটার চালু করতে ভুলে গেছো!

নিয়ে গেলাম তাদের গন্তব্যে। পথিমধ্যে অনেক কথা হলো, ওদের বললাম, আমি এই লাইনে নতুন। তবে আজই যে আমার প্রথম দিন সেটা বললাম না। ওদের নামিয়ে দিলাম। লোকটা খুব ভালো বকশিশ দিল।

এরপর আরও কিছুক্ষণ কাজ করলাম।  দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হতে চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সাড়ে তিনটা বাজে। পাঁচটার মধ্যে গ্যারাজে গাড়ি ফেরত দিতে হবে। ঠিক তখনই এক মহিলা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে গাড়িতে উঠল সাথে বিশাল আকারের দুই স্যুটকেস। ওজন একেকটার অন্তত দু শ পাউন্ডের কম না। টেনেটুনে অনেক কসরত করে স্যুটকেস দুটোকে গাড়ির ট্রাঙ্কে ঢুকালাম। মহিলার গন্তব্য ‘ম্যারিওট মারকি’ হোটেল। তাকে সেখানে নিয়ে গেলাম। ভাবছি এটাই আমার শেষ প্যাসেঞ্জার। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত। মহিলা গাড়ি থেকে নেমেছে, হোটেলের ডোরম্যান তার স্যুটকেস দুটো গাড়ি থেকে নামিয়ে আরও চারটা স্যুটকেস ঢুকিয়ে দিল তারপর আমার জানালার কাছে এসে বলল, ‘বস, আই গাট এ কেনেডি ফর ইউ বস।’

একবার ভাবলাম ‘না’ বলি। হাতে মোটেও সময় নেই। বিকালবেলা এই ট্রাফিকের এয়ারপোর্টে যেতে অনেকক্ষণ লাগবে। আবার এও ভাবছি, প্যাসেঞ্জার রিফিউজ করলে যদি আমার নামে টিএল সি’তে নালিশ করে? প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল লোক দুটোকে নামিয়ে দিতে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা, দুজন নামল দুটো ভিন্ন টার্মিনালে। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যাওয়াটা মোটেও সহজ কাজ না। পুরো এয়ারপোর্ট ঘুরে আসতে হয়। তাছাড়া এই লাইনে আমি একজন নবিশ। অনেক ঝামেলা করে, দুই একটা ইলিগ্যাল ইউ-টার্ন করে দ্বিতীয় জনকে তাঁর টার্মিনালে নামিয়ে দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল পাঁচটা চল্লিশ। বাসায় ফিরছি। গ্যারেজ থেকে বারবার ফোন করছে।

এই তুমি কোথায়? রাতের ড্রাইভার এসে বসে আছে।

বললাম, আমি ফিরছি। আধ ঘণ্টা সময় দাও।

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার দিকে গ্যারাজে গাড়ি ফেরত দিলাম। গ্যারাজের মালিক বিলি আমাকে বলল, তুমি নতুন, তাই তোমাকে আজ ফাইন করলাম না। আগামীতে গাড়ি সময়মতো দেবে।

আচ্ছা।

কাল কি কাজ করবে?

না, আমার আরেকটা রেগুলার জব আছে। তবে প্রতি রোববারে আমি গাড়ি চালাব।

ঠিক আছে, আগামী রোববারে এসো।

বাসায় ফিরে এলাম। আমার পকেটভর্তি কাঁচা টাকা। হিসাব করে দেখলাম, সব খরচ বাদে আমি নিজের জন্য প্রায় এক শ ছিয়াশি ডলার কামিয়েছি। কাজ করেছি দশ ঘণ্টা। অর্থাৎ ঘণ্টায় আঠারো ডলার ছিল আমার সেদিনের মজুরি।

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্যাসেঞ্জার গাড়িতে ওঠার আগেই বলে দিতে পারি সেই মানুষটা কেমন হবে? কোথায় তাঁর গন্তব্য। ম্যানহাটানের প্রতিটি রাস্তা, খানাখন্দ এখন আমার চেনা। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই শহরটাকে বড্ড আপন মনে হয়।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.