'ডানকি' ও একটি প্রসঙ্গ

'ডানকি' ও একটি প্রসঙ্গ

সম্প্রতি স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখলাম 'ডানকি'। সিনেমাটি অভিবাসীদের সমস্যাকে ঘিরে ঘুরপাক খেয়েছে। ভারতের পাঞ্জাবের একদল নারী-পুরুষ (পাঁচজন পুরুষ, দুজন নারী) অবৈধ পথে লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি জমায় গত শতকের নব্বই দশকের মাঝামাঝি। তাদের পথে ছিল রোমাঞ্চ ও মৃত্যুর হাতছানি।  তিনজন মারাও যায়। চারজন যখন লন্ডন পৌঁছে, তখন তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়। আইনগতভাবে সেখানে থাকার জন্য তিনজন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। কিন্তু হার্ডি  মিথ্যা কথা বলতে চায় না। নিজের দেশ ভারতকে চায় না ছোট করতে। ফলে তাকে দেশে ফিরতে হয়, মনের মানুষ মুন্নিকে রেখে।

'ডানকি' মানে কী? যারা দূর বিদেশে আপনজনদের গভীরভাবে অনুভব করে। এটি মুন্নিসহ লন্ডনে থেকে যাওয়া তিনজন হাড়ে হাড়ে টের পায়। তারা পঁচিশ বছর পরে পাঞ্জাবে ফিরতে চায়।  কিন্তু ভারতের ভিসা পায় না। কীভাবে তারা দেশে ফিরে এল, সেটি বেশ চমকপ্রদ।
ছবিতে দেশপ্রেম ও ব্যক্তিপ্রেম চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। জীবন বাজি রেখে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিও দারুণভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক রাজকুমার হিরানী। ভারত থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের দুর্গম পথে তাদের কষ্টকর যাত্রা নিষ্ঠুর বাস্তবতারই প্রতিফলন।

ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র হার্ডির ভূমিকায় শাহরুখ খানের অভিনয়ে উত্থান-পতন রয়েছে। বয়সের ছাপও লুকাতে পারেননি। মুন্নি হিসেবে তাপসী পান্নু অনেকাংশেই সফল।  তবে ছোট চরিত্রে ভিকি কৌশল অনবদ্য। গানগুলো হৃদয়স্পর্শী।

বলা হচ্ছে, এটি রাজকুমার হিরানীর সবচেয়ে দুর্বল সিনেমা। এই কথার সঙ্গে আমি একমত নই। হ্যাঁ, এটা ঠিক ভিকি কৌশলের মৃত্যু বিশ্বাসযোগ্য নয়। মুন্নির মৃত্যুও সিনেমাটিক। তারপরেও ছবিতে চমৎকার মন্টাজ রয়েছে। যেমন, হৃদয়ের কান্না হিসেবে সমুদ্রের ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দ। সেই দৃশ্যটিও দারুণ! যখন মুন্নি পঁচিশ বছর পরে দেশে ফিরে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, তখন একই ফ্রেমে পরিচালক অতীত ও বর্তমানকে রেখেছেন। 

হিরানির সিনেমার যে বৈশিষ্ট্য, দর্শকদের অনুভূতিকে স্পর্শ করা, তাদের আবেগের সমুদ্রে ভাসানো, সেটি এ ছবিতেও বিদ্যমান। দর্শকদের চোখ সজলও হয়েছে। হিরানির আরো একটি বৈশিষ্ট্য, হাস্যরসের মধ্য দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরা, সেটিও 'ডানকি'-তে রয়েছে। তাই রাজকুমার হিরানিকে আমি সফলই বলবো।

২.
'ডানকি' দেখার পর একটি বিষয় আমার মনে খচখচ করছে: কেন বাংলাদেশে এ ধরনের সিনেমা নির্মিত হলো না? এ দেশের সাধারণ মানুষের মা ও মাতৃভূমির প্রতি রয়েছে গভীর টান। বিদেশ তো বটেই, ঢাকায় থেকেও তারা মা ও পৈতৃক ভিটার জন্য মায়া অনুভব করে। অবসর পেলেই সেখানে ছুটে যায়। ঈদের সময় অমানবিক কষ্ট সহ্য করে নিজেদের শিকড়ে ফিরে। আর অভিবাসী হয়ে অবৈধভাবে যখন বিদেশে পাড়ি জমায়, অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে। কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওই অবস্থায় যারা বিদেশে পৌঁছে, তারা পালিয়ে থাকে।
অল্প বেতনে কাজ করে। করে নিকৃষ্ট কাজও। এইসব মানুষের কথা গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেছেন আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা। 
ভ্রমণকাহিনিতেও। এমনই এক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে স্মরণীয় উপন্যাস লিখেছেন আনিসুল হক। উপন্যাসটির নাম 'দুঃস্বপ্নের যাত্রী'। এখানে তুলে ধরা হয়েছে এদেশের হতভাগ্য ৪২জন মানুষের কথা, যারা স্পেন যাবে বলে শুরুতে পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে সাহারা মরুভূমিতে পৌঁছে। সেখান থেকে রাবারের ডিঙি নৌকায় পাড়ি জমায়। পথে কয়েকজন মারা যায়। খিদের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাদের মাংস খায় অন্যরা। নিজেদের প্রস্রাবও। দশ দিন পরে আলজেরিয় এক নৌযান তাদের উদ্ধার করে। তখন বেঁচে আছে ২৫ জন। ১৭ জন আগেই মারা গেছে। কিন্তু অবৈধভাবে গিয়েছিল বলে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারোই স্পেনে যাওয়া হয় না।
আনিসুল হকের 'দুঃস্বপ্নের যাত্রী' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মৃদুল চৌধুরী প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, কাহিনিচিত্র নয়।

বিদেশে যারা কষ্ট করে থাকে, তাদের যাপিত জীবন নিয়ে অবশ্য মাহফুজ আহমেদ নির্মাণ করেছেন  টিভি ধারাবাহিক: 'তোমার দোয়ায় ভালো আছি মা'। এই ধারাবাহিকের সিক্যুয়েল 'মাগো তোমার জন্য'। এখানে তুলে ধরা হয়েছে কী কষ্টকর যাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশিরা বিদেশে পৌঁছে। মাহফুজ আহমেদকে স্যালুট। তবু তিনি ছোটপর্দায় বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.