হজের দিনগুলি।। মো. মুনিরুজ্জামান

হজের দিনগুলি।। মো. মুনিরুজ্জামান

কাবাঘর নিজের চোখে দেখা, তওয়াফ করা, মদিনা মনোয়ারায় গিয়ে রাসুল পাক (স.)-এর রওজা মোবারক  জিয়ারত করার বাসনা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজ অন্তরে লালন করে থাকেন। বাস্তবে এসব পবিত্র ভূমি দেখা যেন এক অন্যরকম অনুভূতি, যা লিখে কিংবা মুখে বলে বোঝানো  যাবে না। 

আমার হজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অনেক বছর আগে থেকেই। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০২৩ সালে আমি হজে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই, আর যাত্রা করি ২৫ মে, বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা থেকে সরাসরি জেদ্দা এয়ারপোর্টে।   

ফ্লাইট ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। সেদিন সকালে নাস্তা আর গোসল সেরে  নিয়ত করে এহরামের কাপড় পরে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মূলত এহরামের কাপড় হচ্ছে কাফনের কাপড়। মৃত্যুর পরে সেলাইবিহীন এই সাদা  কাপড় পরেই আমাকে কবরে যেতে হবে। তাই আয়নায় প্রতিফলিত এহরামের কাপড় পরা  নিজেকে তখন একরকম মুর্দা মনে হচ্ছিল। মৃত্যুর কথা চিন্তা করে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গিয়েছিল। 

পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে রওয়ানা হতে প্রায় ১০টা বেজে যায়।  বলাই বাহুল্য, বিদায়বেলার মুহূর্তটি ছিল বেশ আবেগঘন। আমি নিজেকে অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রেখেছিলাম। আবার ফিরে আসব কি-না, এ ব্যাপারে তো নিশ্চয়তা ছিল না। এখানে একটি কথা বলা দরকার, হজের সময় প্রতি বছর অনেক হাজী ইন্তেকাল করেন। মক্কা-মদিনায় আমরা প্রতি ওয়াক্ত ফরজ নামাজ শেষে জানাযা পড়েছি। সেখানে মৃত্যু হলে সৌদি সরকার লাশ হাজিদের দেশে ফেরত পাঠায় না। তাদের লাশ দাফন হয় জান্নাতুল মোয়াল্লায় কিংবা মদিনার জান্নাতুল বাকীতে। আমার জানামতে, এই বছর মোট ৫৯ জন বাংলাদেশি হাজি ইন্তেকাল করেছেন। দেশে ফিরেছে তাঁদের লাগেজ, টাকাপয়সা আর প্রিয়জনদের জন্য কেনা জিনিসপত্র। 

যা' হোক, আমার বিদায় বেলার মুহূর্তগুলো স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করি। তারপর যথাসময়ে আশকোনা হজক্যাম্পে পৌঁছে যাই। আমাকে বিদায় জানাতে পরিবারের সদস্যরা আশকোনা হজ ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছিল। সেখান থেকে সবার কাছ থেকে আবারও  বিদায় নিয়ে আমি ভিতরে চলে যাই। 
এই বছর নতুন নিয়মে আশকোনা হজক্যাম্পে আমাদের বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও লাগেজ বুঝে নেওয়া হয়। হজযাত্রা সহজ করতে সৌদি ইমিগ্রেশন ঢাকার বিমানবন্দরেই সম্পন্ন করা হয়  (পরে আবিষ্কার করেছিলাম, নতুন নিয়ম অনুযায়ী আমাদের হাজিদের  লাগেজ জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত হোটেলের ঠিকানায় সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে)। 

হজযাত্রার সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমরা বিমানবন্দরের ডিপার্চার লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের বিমানে ওঠার ডাক আসে নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা পরে।  আমার সিটটা পড়েছিল জানালার দুই আসন পরে।  যা' হোক অবশেষে আমার হজে যাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, এই কথা ভেবে তখন মনের  ভেতরে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল। তাই মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে মনে মনে অসংখ্যবার শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ তায়ালা কবুল না করলে কেউই শতচেষ্টা করেও হজে যেতে পারেন না। 
আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সেই দিক দিয়ে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। ইতিমধ্যে বিমানে আমার আসন গ্রহণের কথা বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিই।

বেশ কিছু সময় পরে বিমান উড্ডয়নের ঘোষণা এল।  তারপর যথানিয়মে বিমান আকাশে উড়াল দিল। রাতের আকাশে মাতৃভূমিকে পিছনে ফেলে আমরা উড়ে চললাম দয়াল নবিজি রাসুল পাক (স.)-এর দেশে। 

২.
আমরা জেদ্দা এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম তখন স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১২টা । সেখানে আমাদের ফুল ও খেজুর দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। অতঃপর দুটি বিলাসবহুল বাসে জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমাদের নির্ধারিত হোটেল মক্কা টাওয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। সুবিশাল এই ভবনটি হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকী (রা.)-এর আবাসভূমির ওপর নির্মিত ও পবিত্র হেরেম শরীফের অংশ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। 

হোটেলে পৌঁছে আমাদের কার কোন রুম সেটা জেনে নিয়ে সরাসরি রুমে গিয়ে ওযু করে ফজরের নামাজ আদায় শেষে ওমরাহ হজ পালনের জন্য আমরা সবাই হোটেলের ওয়েটিংরুমে এসে জড়ো হলাম। আমাদের মোয়াল্লেম সাহেব নিজের রুম থেকে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলে আমরা তাঁর নেতৃত্বে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ এই  ধ্বনি উচ্চস্বরে বলতে বলতে হেরেম শরীফের ৭৯ নম্বর গেইট দিয়ে মাতাফের দিকে এগুতে থাকলাম।
 
হেরেম শরীফের কিছুদূর ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল আমাদের সবার চিরপরিচিত কেবলা পবিত্র কাবাঘর। অত্যন্ত আবেগাপ্লুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম আল্লাহর পবিত্র ঘরের দিকে। সালাম জানালাম কাবাঘরকে। ওমরাহর নিয়তে সাতবার তওয়াফ করলাম পবিত্র এই ঘরটি। মনে মনে শুকরানা আদায় করি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি। তিনি আমাদের কবুল না করলে আমরা এই পবিত্র ভূমিতে হজ করতে আসতে পারতাম না। আমরা যে এখানে আল্লাহর মেহমান হয়ে এসেছি, এটা যে এক বিরল সম্মান ও মর্যাদার বিষয় সেটা ক’জন বুঝবে? অশ্রুসিক্ত নয়নে আমি বারবার মৃদুস্বরে আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা করতে লাগলাম। কলেমা ও দরুদ শরীফ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের জীবনের গুনাহ মাপের জন্য ভিক্ষা চাইলাম।

তওয়াফ শেষে  মাকামে ইবরাহীম বরাবর মাতাফের বাইরে বসে দুই রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ আদায় করলাম। তারপর জমজম কূপের পানি পান করলাম। আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব নিদর্শন মা হাজেরার স্মৃতিবিজড়িত সাফা-মারওয়া সাতবার সায়ি শেষে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম।  মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে মনপ্রাণ উজাড় করে সবার জন্য দোয়া করলাম। অতঃপর বাইরে এসে মাথা মুণ্ডন করলাম, কাছের একটি সেলুনে। এভাবে ওমরাহ পালনের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম। আমাদের হোটেল রুমে গিয়ে গোসল করলাম। তারপর সোজা হেরেম শরীফে জুম'আর নামাজ পড়তে চলে গেলাম।
এখানে বলে রাখি, আমাদের তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল জমজম টাওয়ার সংলগ্ন আলসাফা টাওয়ারের একটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয়। হজের আগে মক্কা শরীফে ২০ দিন অবস্থানকালে আমরা এই হোটেলে এসেই খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারতাম ।...এখানকার হোটেলগুলোতে খাবারে লবণ ও ঝাল কম থাকে।  দুম্বা ও উটের গোস্ত খেতে খেতে আমরা সবাই একরকম অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলাম। মাঝেমধ্যে রুচি পাল্টাতে চিকেন কিংবা দুম্বার গোস্তের বিরিয়ানি খেতাম। এখানকার কোনো খাবারই আমাদের দেশের খাবারের মতো সুস্বাদু নয়। আমি এই হোটেলগুলোতে বহু পাকিস্তানি, বাংলাদেশি ও ভারতীয় শ্রমিকদের এক দস্তরখানায় মিলেমিশে খাবার খেতে দেখেছি। বিষয়টি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। তবে সৌদি আরবে ভাষাগত  সমস্যা আমার কাছে অনেক বড় মনে হয়েছে । সৌদি পুলিশেরা আরবি ছাড়া একেবারেই অন্য কোনো ভাষা বুঝে না । কোনো কিছু জানতে হলে সেখানে কর্মরত পাকিস্তানি, ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশিদের সাহায্য নিতে হয়।  

আমি এবার হজে গিয়ে মোট চারবার ওমরাহ হজ পালন করতে পেরেছি । তায়েফ শহরসহ রাসুল পাক (সঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা শরীফের অনেক ঐতিহাসিক  জায়গা ঘুরে দেখেছি। তবে তায়েফ শহর আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। এখানে আমাদের দয়াল নবিজি ( সঃ)-এর জীবনের একটি অংশ পার করেছেন।  মক্কা নগরী  থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে এই শহরটি অবস্থিত। 

মক্কায় থাকার সময় শেষ রাতে আমি মেঘের গর্জন শুনেছি, ঝড়বৃষ্টি দেখেছি। মরুপাহাড়ের দেশে বৃষ্টিতে ভেজার ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা আমার কাছে অতুলনীয় মনে হয়েছে। উল্লেখ্য, বাতাসে আর্দ্র্রতা কম থাকায় প্রচণ্ড গরমেও সৌদিতে শরীর থেকে ঘাম বের হয় না। 

আমাদের ইকো বন্ধু মিফতার সাথে আমার এখানেই দেখা হয়েছে। আনন্দে দুই বন্ধু পরস্পকে জড়িয়ে ধরেছি , গল্প করেছি ও একসঙ্গে সেলফি তুলেছি। মিফতার সাথে পরে মদিনায়ও দেখা হয়েছিল।...মিলটনের সাথে মোবাইল ফোনে অনেক গল্প করেছি। সে তখন মক্কায় ছিল বলে দেখা হয়নি। আমাদের বাকি দুই হাজি ইকো বন্ধু, স্বপন ও শহিদ, ওদের সাথে আমি কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। বিদেশের মাটিতে সহপাঠী বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার আনন্দই আলাদা!

৩. 
আমরা মদিনা শরীফে যাই ১৪ জুলাই। সেখানে যাওয়ার দিন আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। জীবনে প্রথমবার পবিত্র মদিনা শরীফ যাচ্ছি, এই কথা ভেবে আমার মনের ভেতরে অন্যরকম একটা আবেগ ও উচ্ছ্বাস কাজ করছিল। আমি পুরোটি পথই দুই পাশের মরুভূমি ও পাথরের পাহাড় দেখতে দেখতে গিয়েছি আর ভেবেছি আমাদের নবিজি (সঃ) হয়তোবা এইসব দুর্গম জনমানবহীন পথ দিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় কিংবা দূরদূরান্তে বহবার যাতায়াত করেছেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে জীবনে তিঁনি অনেক কষ্ট করেছেন ।  দীর্ঘ এই যাত্রাপথে দয়াল নবিজিকে নজরানা দিতে আমি অসংখ্যবার দুরুদ শরীফ পাঠ করেছি । আল্লাহর তায়ালার কাছে সবার জন্য রহমত ভিক্ষা চেয়েছি। 

আমরা যখন মদিনায় পৌঁছি তখন দূর থেকে দয়াল নবিজি রাসুল পাক (সঃ)-এর রওজা মুবারকের সবুজ গম্বুজ দেখে মনটা আনন্দ ও আবেগে ভরে উঠল। সেই দিন এশার নামাজ মসজিদে নববীতে আদায় করে আমরা সবাই নবিজি (সঃ)-কে সালাম জানাতে রওজা শরীফের কাছে গিয়ে দাঁড়াই । বাংলাদেশ থেকে সবার পাঠানো সালাম নবিজিকে পৌঁছে দিই এবং সংক্ষেপে জিয়ারতপর্ব শেষ করে হোটেলে ফিরে আসি। রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে ঘুমাতে যাই। 

রাত তিনটায় তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে নববীতে যাই।  পরের দিন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী  আসরের নামাজ আদায় শেষে আমরা তিন রুমমেট জান্নাতুল বাকী জিয়ারত করতে কবরস্থানে প্রবেশ করি । এই জান্নাতুল বাকীতে চির শায়িত আছেন নবী পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ অসংখ্য সাহাবী। নামফলক না থাকায় কার কবর কোনটা সেটা জানার উপায় ছিল না।  বেশ কয়েক দশক আগে সৌদি সরকার সমস্ত কবরের নামফলক গুঁড়িয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে সুবিশাল এই পবিত্র কবরস্থান ঘুরে দেখতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। 

জান্নাতুল বাকী জিয়ারত শেষে আমরা তিনজন রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের জন্য কৌশলে অন্য একটি বাংলাদেশি গ্রপের সাথে মিশে যাই । রিয়াজুল জান্নাত হচ্ছে পৃথিবীর মাঝে একটুকরো বেহেশত। ছবিতে এটি বহুবার দেখেছি । বাস্তবে এই পবিত্র জায়গায় ঢুকে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছে। আমি সেখানে দুই দুই করে মোট চার রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। 

রওজামুবারক জিয়ারত শেষে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। দোয়া করি, নিজের ও সকলের মঙ্গল কামনা করে। সেখানে আমার সকল সহপাঠী বন্ধুদের জন্যও বিশেষভাবে দোয়া করি। আমার সৌভাগ্য যে, এ্যাপসের মাধ্যমে আমাদের গ্রুপ এপয়েনমেন্টের মাধ্যমে আমি এই রিযাজুল জান্নাতে দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলাম।

মদিনা শরীফে নয় দিন থাকার সময় আমি মোট  ৪১ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববীতে আদায় করতে পেরেছি। সেখানে ঘুরে দেখেছি মসজিদে কুবা, মসজিদে কেবলাতাইন, খন্দকের যুদ্ধস্থল, উহুদের যুদ্ধে ৭০ জন শহীদের সমাধিস্থলসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ। মসজিদে কুবায় আমি দুই রাকাত করে মোট ৪ রাকাত নফল নামাজ পড়েছি। উল্লেখ্য, এই মসজিদে নফল নামাজ পড়লে নাকি একটি ওমরাহ হজ্জের সওয়াব পাওয়া যায় । আলহামদুলিল্লাহ! 

আমাদের দয়াল নবিজি (সঃ) মানুষদের খাওয়াতে অনেক ভালবাসতেন । প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শত বছর পরেও বংশপরম্পরায়  মদিনাবাসীরা দয়াল নবিজি রাসুল পাক (সঃ)-এর সেই সুন্নতটি আজও ধরে রেখেছেন। আমি দেখেছি মাগরিবের নামাজের সময় সুন্দর দস্তরখানা বিছিয়ে উপস্থিত হাজি সাহেবদের জন্য বড়সড়ভাবে ইফতারের আয়োজন করতে কিংবা খাওয়াতে। মক্কা থেকে মদিনার মানুষদের তুলনামূলক আমার কাছে অনেক নম্র ও ভদ্র মনে হয়েছে। আরেকটি কথা, কেনাকাটার জন্য মক্কা থেকে মদিনায় জিনিসপত্রের দাম অনেক সস্তা । এই জন্য হাজি সাহেবরা মক্কার চেয়ে মদিনায় কেনাকাটা করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

৪. 
জিলহজ মাসের ৬ তারিখ, শুক্রবার, পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে আমরা  মদিনা  থেকে মক্কায় যাই।  পথে ঐতিহাসিক জুলহুলাইফা মসজিদে এসে হজের নিয়তে এহরাম পড়ে দুই রাকাত ওয়াজিব ও জুম'আর নামাজ আদায় করে নিই। আমাদের নবিজি (স.) বিদায় হজের সময় যাত্রাপথে এই জুলহুলাইফা মসজিদে মিকাত করেছিলেন অর্থাৎ এহরাম বেঁধেছিলেন। সেই দিক থেকে নিঃসন্দেহে আমরা অনেক ভাগ্যবান। 

মদিনা থেকে মক্কায় যাওয়ার পথে প্রচণ্ড গরমে আমাদের বাসের ইঞ্জিন একবার বিকল হয়ে ষায়।  অনেক চেষ্টা করে পুনরায় চালু হলে মরুভূমির মধ্যে গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। বেশ কিছুদূর রাস্তা যাওয়ার পর আমাদের বাসের পেছনের দুটি চাকা বিকট শব্দে ফেটে যায়। বাসের গতি কম থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে আমরা বেঁচে যাই। জনমানবহীন মরুভূমির মধ্যে উত্তপ্ত রাস্তায় গাড়ির চাকা সেই সময় কোনোভাবেই পাল্টানো সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় ঘণ্টাখানিক পরে অন্য একটি উদ্ধারকারী বাস আসে। আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। পবিত্র মক্কা  নগরীতে এবার আমরা আজিজিয়া এলাকার শিসা নামের স্থানের  একটি আবাসিক হোটেলে উঠি। মাঝখানে ৭ জিলহজ আমরা সবাই হজের প্রস্তুতি হিসেবে পুরোপুরি বিশ্রাম নিই।

৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ, এই পাঁচ দিন হচ্ছে হজের মূল পর্ব। ৭ জিলহজ দিনগত রাতে অর্থাৎ ৮ জিলহজ আমরা সবাই যে যার মতো তিন-চার দিনের জন্য  একটি দড়ি ব্যাগে প্রয়োজনীয় কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিই। তারপর বাসে চড়ে মিনার নির্দিষ্ট তাঁবুতে গিয়ে উঠি। সেখানে একরাত ও একদিন পুরোপুরি থেকে  ৮ জিলহজ দিনগত রাতে অর্থাৎ ৯ জিলহজ রাতে একই বাসে আরাফাতের ময়দানে যাই। সেখানে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট তাঁবুতে বসবাস করতে থাকি। 

৯ জিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্তের পরেও আরাফাতের ময়দানে হাজিদের উপস্থিত থাকা হজের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মোট ফরজ অংশের একটি। আমাদের দয়াল নবিজি রাসুল পাক (সঃ) বলেছেন আরাফাই হজ। আল্লাহ তায়ালা এই দিনে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত সকল হাজিদের দোয়া কবুল করে নেন এবং ক্ষমা করে দেন। সেখানে দুপুরের পরে আমরা সবাই এক আজানে ও দুই একামতে জামাতে জোহর ও আছর নামাজ আদায় করি। সারা দিন মনেপ্রাণে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিজের ও সবার মঙ্গল কামনা করে দোয়া করি। দরখাস্ত করি জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফের জন্য। প্রয়াত সকল পূর্বপুরুষসহ, বাবা-মা, বোন, শ্বশুর, আত্মীয়স্বজন, আপনজন, ভালোবাসার মানুষ, পাড়া প্রতিবেশী, সকল বন্ধু-বান্ধবের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করি। আরাফাত দিবসের বিশেষ দোয়াপাঠসহ সারা দিন এবাদত বন্দেগি করে কাটিয়ে দিই। সাথে সাথে নিজ ও নিজ পরিবারের সদস্যদের, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মঙ্গল কামনা করে দোয়া চালু রাখি। 
 
অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আরাফাত দিবসটি প্রতিটি হাজিদের জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। এখানে উল্লেখ্য যে, মিনা, আরাফায় আমাদের হাজিদের  তিন বেলার খাবার ও পানীয় সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় আমাদের তাঁবুতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে টয়লেটের স্বল্পতার বিষয়টি হাজি সাহেবদের সমস্যার মুখোমুখি করেছে এবং ওযুরও জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। 
৯ জিলহজ দিনগত রাতে অর্থাৎ ১০ জিলহজ আমরা বাসে চড়ে মুজদালিফার খোলা আকাশের নিচে চলে যাই। এখানে রাত্রিযাপন হাজিদের জন্য ওয়াজিব।  সেখানে রাতে এক আজানে ও দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করি এবং জামারার জন্য ছোটো আকারের ৭০টি দানা পাথর সংগ্রহ করি। 

মুজদালিফায়  খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো ছিল অনেক ফয়েজপূর্ণ। প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করেছি।  শেয রাতে জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করি। সকালে সূর্য উঠার পরে আমরা সবাই রিজার্ভ বাসে উঠে বড় শয়তানকে পাথর মারতে জামারায় চলে যাই। ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রচ- গরমে অনেক দূর পথ পায়ে হাঁটি। জামারায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের কাজটি খুব সহজ  ছিল না।
 
সেদিন পাথর নিক্ষেপের  কাজটি সেরে আমরা সবাই হোটেলে চলে যাই। কোরবানি সম্পন্নের খবর পেয়ে আমরা কাছের সেলুনে গিয়ে মাথা মু-ন করি। তারপর হোটেলে এসে গোসল শেষে এহরামের কাপড় ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরি। প্রচণ্ড গরমে একনাগাড়ে তিন-চার দিন এহরামের কাপড় পরে থাকা আমাদের জন্য বেশ কষ্টের ব্যাপার ছিল । 

৫.
১১ জিলহজ বাদ আছর দ্বিতীয় দিনের মতো জামারায় ছোট, মাঝারি ও বড় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে যাই। তখন আমার মাথায় একটা পাথর  জোরে আঘাত হানে। মাথা সামান্য কেটে রক্ত বের হয়। সেদিন রাতে আমরা সবাই হজের ফরজ অংশ পবিত্র কাবাঘর তোয়াফ ও সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করি। পরের দিন বিকেলে অর্থাৎ ১২ জিলহজ জামারায় তিন শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে  হজের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করি। 

আমাদের ফিরতি ফ্লাইট ছিল ৪ জুলাই দিনগত রাত একটায়। ৩ জুলাই দিবাগত রাতে আমরা পবিত্র কাবা শরিফে গিয়ে বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করে অশ্রুসিক্ত নয়নে হোটেলে ফিরে আসি। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, আমরা  যেন বারবার তোমার ঘর তওয়াফ করতে আসতে পারি। 

পরের দিন অর্থাৎ ৪ জুলাই আমরা বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে জেদ্দা এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। এয়ারপোর্টে পৌঁছে  বিমানে লাগেজ বুকিং, বোর্ডিং পাস সংগ্রহ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করি। অতঃপর আমরা ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে থাকি। 
বিমানে ওঠার ঘোষণা এলে আমাদের বিশেষ বাসে করে অপেক্ষারত বাংলাদেশ বিমানের সিঁড়ির কাছে নামিয়ে দেওয়া হয়। সিঁড়ি ভেঙে বোয়িং বিমানে উঠার পরে আমরা সবাই যার যার আসনে বসে পড়ি । বিমান যখন ঢাকার উদ্দেশে উড়াল দেয় তখন ঘড়ির কাটায় রাত ১:২০ মিনিট। সেই সময়ে সঙ্গত কারণেই আমার  প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। বিমান আকাশে ওড়ার বেশ কিছু সময় পরে আমাদের রাতের থাবার পরিবেশন করা হয়। আমার কাছে বিমানের খাবারের মান ও আতিথেয়তা  যথেষ্ট ভালো লেগেছে।  

আমরা ঢাকায় পৌঁছলাম বাংলাদেশ সময় সকাল ১১:১০ মিনিটে। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে আমাকে লাগেজ বুঝে পেতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। তারপর প্রাপ্ত টোকেন জমা দিয়ে আমি জমজমের পানির বড় একটি  বোতল বুঝে পাই। 

বাইরে এসে দেখি আমার বড় ভাগিনা আমাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সে আমাকে সালাম করে জড়িয়ে ধরল। একটু সামনে এগুতেই  দেখি আমার পরিবারের সদস্যরা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজের আবেগকে তখন ধরে রাখতে পারিনি। আমার দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল। মনে মনে তখন মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে লক্ষ কোটি শুকরিয়া জানালাম, তিঁনি আমাকে হজ করিয়েছেন বলে। 
পরিবারের সবার কুশলা জিজ্ঞেস করে গাড়িতে উঠে বসলাম। পথে হজের অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বলতে বাসায় চলে এলাম। নিজ পৈতৃক বাড়িকে সালাম দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলাম। 

হজ হচ্ছে আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় । জীবনে যতদিন বেঁচে থাকব আমি হজের সেই স্মৃতিময় দিনগুলির কথা কখনো  ভুলব না। ভুলব না আমার সহযাত্রী, আপনজন, শুভাকাক্সক্ষী ও সহপাঠী সকল ইকো বন্ধুদের ভালোবাসার কথা। 

হজ করা এই আমি রাসুল পাক (স.)-এর সুন্নত পালন করতে দাড়ি রেখে দিয়েছি। চেহারা ও জীবনাচরণে আমার অনেক পরিবর্তন এসেছে। আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বকে অনুভব করতে শিখেছি। অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছি মক্কা-মদিনাকে। আমার এই ভালোবাসা ইহলোক পরলোক, দুই ভুবনেই বজায় থাকুক।  
 

Leave a Reply

Your identity will not be published.