সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১২)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১২)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১২তম পর্ব।] 

ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিড়ম্বনা

ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুটো ছুঁইছুঁই। বুঝতে পারি পেটে ভুখ লেগেছে। চাইলেই কি আর খাবার মেলে? ভেতরে রাগ জমতে থাকে, তবুও মুখে মিষ্টি হাসি চেপে রাখি। ভদ্রতার জ্ঞান আর কি! যেদিকে নিয়ে যায়, যাই আর গাড়িতে বসে চারপাশ দেখি। মনে দয়াটয়া হলো বুঝি, একটা মাঝারি সাইজের ভবনের সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়ির বহর। একটু বিরতি দিয়ে ততক্ষণে আবার গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। অতিথিরা ছাতাবেষ্টিত প্রটোকলে ভবনের ভেতরে ঢুকে যান। আমি প্রটোকলের আওতায় পড়ি না, গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টিতে দাঁড়াই। আহা রে বৃষ্টি! বাংলাদেশের মতো রোমান্টিক বৃষ্টির ধারেকাছেও নাই ইউরোপের খাটাস বরফ বৃষ্টি। শীতল বরফ চুইয়ে পড়া বৃষ্টি যেন, মুহূর্তের মধ্যেই শরীর ঠান্ডায় জমে যাওয়ার শঙ্কা।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমিক কবি। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো সব রোমান্টিক যুগলের মনেই প্রেমাতুর ভাবনা তৈরি করেছে।

‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,

গগণ ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা,

দুলিছে পবনে শনশন বনবীথিকা,

গীতময় তরুলতিকা।’

আশপাশের লোকজনের মুখ হাঁ, ‘এই ব্যাটার এত শখ, ঠান্ডা জলে ঠায় দাঁড়িয়ে! ঠ্যালা বুঝবে কিছুক্ষণ পর, ঠান্ডায় জমে যাবে যখন!’

তাদের মনের ভাব টের পেতে দেরি হয় না। আমার কাঁপুনি শুরু হয়। দৌড়ে ভবনে ঢুকি। ভবন বলতে আসলে একটা রেস্টুরেন্ট, নাম ল্যাঙ্গোস্ট। সাভা নদীর তীরে কোসানসিচেভ ভেনাচ এলাকায়, নদীর ঠিক পাড়জুড়ে। পূর্ব ইউরোপে জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টগুলোর এটি একটি। বেলগ্রেডে ঠিক ২০ বছর আগে রান্নাবান্না শুরু হয় ল্যাংগোস্টের রসুইঘরে।

নদীর ঠিক তীরে এটি দেখি আর ভাবি, রেস্টুরেন্টের আর রকম কী! বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির হিসাবেই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। আর ঢাকায় এর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ হাজারের ঘর। আর, পুরো সার্বিয়াতে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৩০ হাজারের কিছু বেশি। বেলগ্রেডের মতো বিশাল আয়তন নিয়েও রেস্টুরেন্টের সংখ্যা মাত্র ২ হাজারের ঘর ছুঁইছুঁই।

বেলগ্রেডে অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোর একটি ল্যাঙ্গোস্ট। খাবারদাবার চেটেপুটে খাব—সেই আশা নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ শুরুর পর উবে যেতে বসেছে ফরমাল ডিনার বা ফরমাল লাঞ্চের আগ্রহ। দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর রং-ঢং-সঙের খাবার! তা খেয়ে পেট ভরে না, মন পোরে না। উজবেকিস্তানে একটা লাঞ্চে সময় লেগেছিল সাড়ে তিন ঘণ্টা। ভরদুপুরে কাজ ফেলে সাড়ে তিন ঘণ্টা খাবারের পেছনে যদি যায়, দিনের বাকি সময় থাকে আর কতক্ষণ? ল্যাঙ্গোস্টে বসেও সেই বিড়ম্বনার অপেক্ষা করি।

আমি বসে মোবাইল ফোন টিপি। সার্বিয়ান সিমে লোকাল নম্বরে ফোন করা যায়। ইন্টারন্যাশনাল আউটগোয়িং বন্ধ, তবে পাঁচ জিবির ইন্টারনেটের প্যাকেজ। ইন্টারনেট থাকলে আমাজনে গিয়েও ‘শান্তি’তে থাকা যায়। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করি, হোয়াটস আপে কথা বলি। এর ওর ফেসবুক ওয়ালে ঢু মারি। ঘড়ির কাঁটা যেন এখানে ভারী হয়ে গেছে, চলছে ধীরগতিতে। ক্রিভোর সঙ্গে কথা বলি। সময় যায়, তবুও খাবার আসে না।

এপিএস হিসেবে কাজ শুরুর পর পাঁচ দিনের একটা মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্স করতে হয়েছিল। একটা সেশন ছিল দৈনন্দিন আচার-আচরণ নিয়ে। তাতে কথা বলেছিলেন সেই সময়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। তাঁর মতে—

‘ফরমাল লাঞ্চ বা ডিনার— কখনোই পেট পুরে খাবার কোনো অনুষ্ঠান নয়। মনে রাখতে হবে, তুমি ফরমাল অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বাসা থেকে পেট পুরে খেয়ে যাবা, নাকি অনুষ্ঠান শেষ করে এসে বাসায় খাবা?’

কাজেই ল্যাঙ্গোস্টে কী খাবার দেবে— সেটাও ভাবি না। তবে কখন এখান থেকে বের হব—সেই সময় জপতে থাকি। টেবিলে রাখা দেড় লিটারের এক বোতল পানি। ধীরে ধীরে সেটাও শেষ হয়। ঘুরে দেখি রেস্টুরেন্টটা। ফ্রিজে কত শত রকম যে পানীয়— সফট ও হার্ড— সবরকমই। ছবি তুলে পাঠাই ঢাকায়, ড্রিংকস প্রিয় বন্ধুকে। বুঝতে পারি তার মনের উত্থাল-পাতাল অবস্থা।

টেবিলে খাবার সার্ভ করা হয়। আস্ত ডিমের ওপরের অংশ ভাঙা, মাঝে তরতাজা কুসুম। প্লেটে কয়েক টুকরা জবের মাঝে খাড়া করে রাখা ডিম। ব্রয়লার মুরগির ডিম, সাইজে ছোট। ডিমের কুসুম অংশ কত্ করে গিলে ফেলি। ছোটোবেলায় কত খেয়েছি! কাঁচা ডিম আর কাঁচা গরুর মাংস গপগপ করে খাওয়ার সুখ্যাতি (!) ছিল। ছুটিতে বাড়ি গেলে এখনো মা-চাচির মুখে সেই গল্প শুনি।

ল্যাঙ্গোস্টের দুপুরের লাঞ্চে মুরগির এই দুটো ডিম আর ২৫০ মিলিমিটারের একটা পানীয়। পেঁয়াজ-মরিচের সঙ্গে গরম ভাত না খেলে বাঙালির উদর পূর্তি হয়? পেটজুড়ে খিদারা চোঁ চোঁ করে ঘোরাঘুরি করে। সালাহউদ্দিন লাভলুর নাটক ‘হাড় কিপটে’তে অভিনেতা চঞ্চলের মতো দুই গ্লাস পানি মেরে দিই, খিদার দৌড়াদৌড়ি শেষ।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.