পৃথিবীতে অনেক রকম ভালো কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে, বই পড়া। বই পড়া নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের উক্তি বা বাণী লোকমুখে প্রচলিত। তবে প্রত্যেক পাঠকই আলাদা। লেখক ও শিক্ষক ইফতেখার মাহমুদ একজন তুখোড় পাঠক। নিজের ও অন্যের বই পড়াকে তিনি কীভাবে দেখেন- অন্যদিন পাঠকদের জন্য রইল সেই বিষয়ক রচনা...
আমি ধীরে বই পড়ি। কখনো যদি কোনো বই একসাথে পড়তে হয়, দেখেছি-- মনীষা, আমাদের মেয়ে, আগে পাতা উল্টাতে চায়। ওর দুপাতা হয়েছে, আমি তখনও প্রথম পাতাতেই। ছোটরা হয়তো দ্রুত পড়তে ভালোবাসে।
বই শেষ করা নিয়ে অস্থিরতা বোধহয় আমি পার করে এসেছি। বইটা পড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে থাকি, শেষ করে ফেললাম এ ধরনের কোনো তাগাদা অনেকদিন থেকেই নেই।
একই বই ফের পড়েছি, যেমন একই সিনেমা আবার দেখেছি। একই গান যে কারণে ফের শুনি, বারবার শুনি, এমন অনেক বই আছে, যেগুলোর কোনো কোনো অংশ বারবার পড়তে ইচ্ছে করেছে, পড়েছি। এজন্য বই সাথে থাকা ভালো লাগে। যে ঘরে আমি ঘুমাই সে ঘরেই বইপত্র রাখা।
আমার মনে হয়, অনেকের বই পড়তে এজন্য ভালো লাগে না যে, লোকে তাদের বারবার বলেছে, বই পড়া একটা ভালো কাজ। ভালো কাজ করতে বলা লোকের অভাব নেই, হাজারটা ভালো কাজের উপদেশ আমাদের চারপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। খামোকা নিজে থেকে ওসব বরণ করে নিতে তাদের মন সায় দেয় না। অবশ্য এই কারণটা সত্য নাও হতে পারে।
বই পড়তে গিয়ে ছোটবেলাতেই আমি আসলে আনন্দ আর সুন্দরের দেখা পেয়েছি। মানুষের ভেতরের অন্ধকার যেমন কেউ কেউ খুঁজে বেড়ায়, তারা হয় গোয়েন্দা স্বভাবের, কেউ কেউ তেমনি খুঁজে বেড়ায় মানুষের নির্ভার কোমল অংশটুকু। অচেনা মানুষের দুঃখ, সুখ, ব্যথা, ত্যাগ বা ব্যর্থতা, স্বপ্ন--আমার মনে হয়, আমার জীবনকে কিছুটা হলেও, ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। বই পড়ে পড়ে আমার জীবনে ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না।
যারা বই পড়ে, তাদের যে আমি আলাদা চোখে দেখছি--এমনটা কি সত্যি? যে সিনেমা দেখে না, কিংবা গান গায় না, কিংবা রক্তদান কর্মসূচিতে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যায় না, তাদের যেমন বেছে বেছে আমরা অপছন্দ করা শুরু করি না, তেমনি, বই পড়া বা না পড়া, একজন মানুষকে খুব একটা, আমার কাছে অন্তত, শুরুতেই ভিন্ন করে দেয় না। তবে যে বই পড়ে, তার অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করে। যে বই পড়াকে অবজ্ঞা করে, তার মূঢ়তা সম্পর্কেও আমি ওয়াকিবহাল।
লোকেরা নানা জিনিস শেখায়। যেমন, কী বই পড়তে হবে, কোন বই পড়লে কী উপকার, কোন বই কী কারণে খারাপ। এইসব জানতে আমার খারাপ লাগে না। সমালোচনা পড়ি আমি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই, তাদের কথা অগ্রাহ্য করে চলতে পারি। বইপড়ার ভুবনে আমি কাউকেই চরম গুরুত্ব দিইনি।
আমার যা ভালো লাগেনি, আমি জানি যে, সেটা আমার ভালো লাগেনি। যা আমি পছন্দ করি, তা আমিই পছন্দ করেছি, সেটাও আমার জানা। এগুলো খুব গোলমেলে জিনিস, আমার কথার মধ্যেও খানিক ভেজাল অবশ্যই আছে, তবুও মোটাদাগে বলতে গেলে কথাটা এই যে, বই পড়া নিয়ে আমি মোটামুটি স্বাধীন জীবন পেয়েছি বলে মনে হয়।
লেখকদের আমি সবচেয়ে ভালোবেসেছি। তাদের মতো গভীর সংবেদনশীল বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিপ্রবণ জীবন, অনেকের মতো, আমারও আরাধ্য। আগ্রহ ও ভালোবাসা নিয়ে আমি লেখকদের সাথে মিশেছি। এখনো সে আগ্রহে ভাটা পড়েনি। বইপড়ার জীবনের এটা হয়তো একরকম বর্ধিত কৌতূহল।
অনেক কিছু লেখা হয়েছে, আরও হবে, খুবই অল্প পড়া হবে আমার, আফসোস অতটা নেই এসব নিয়ে। যেভাবে, সব মানুষের সাথে দেখা হলো না বলে আফসোস নেই, সব গান শোনা হলো না, সব স্বাদ পাইনি বলে আফসোস হয় না, তেমনই সব বই পড়ব না বলে খেদ জন্মে না মনে।
এর আরেকটা মানে এই যে, সবকিছু বাদ দিয়ে আমি বই পড়ি না আর। বই পড়াকে আমার কাজ বানানো যায় নি। মাঝে মাঝে কাজ বাদ দিয়ে পড়ি, বেশির ভাগ সময়ই অন্য কাজের জন্য বই পড়ি না। দুই একটা বই আছে, বছরে দুয়েকটার বেশি হয় না এরকম, যেটা পড়ার জন্য এক-দুদিনের ছুটি নেয়া লাগে। বাকি সব বই, পড়ি বাসায়, রাস্তায়, অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কোনোটা বা খানিক পড়ে নতুন বইয়ে চলে যাই। মনে পড়ে না ফেলে আসা অসমাপ্ত সে পাঠের কথা।
একটা মানুষ যেমন হয়, তার অনেককিছুই, মানুষটার মতো হয়। মানুষ ঢিলেঢালা, তার খাওয়া-দাওয়া করিৎকর্মার মতো হবে বা ধার শোধ দেয়ায় সে তৎপর হবে, আমার তা মনে হয় না। মানুষ যেমন, বই পড়াতেও সে তেমন। অনেকে বই পড়ে না জানি, কিন্তু এমনও তো আছে, বই পড়ে কিন্তু ভেজাল দেয়া থাকে সে প্রকল্পে, 'পড়া' হয়ে ওঠে না কোনোদিন।
আমি যে আমার চারপাশের লোকেদের খুব বই পড়তে বলি এমন না, মাঝে মাঝে বলি হয়তো, তবে যারা আমাকে কোনো বিশেষ বই পড়তে বলেছে, এমন যদি হয় যে সে বই আমি পড়েছি এবং সে বই পড়ে যদি আমি অভিভূত হয়ে থাকি, তবে তাদেরও আমি চিরদিনের জন্য ভালোবেসেছি।
শিক্ষকদের কেউ কেউ, আত্মীয়দের কেউ কেউ, বন্ধু, বড়ভাই, আপা বা অন্যকেউ--যেই আমাকে কোনো বইয়ের সন্ধান দিয়েছে, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেছি। আগেও বলেছি, অন্যের বই পড়া নিয়ে আমি খুব যে প্রভাবিত, তা মনে হয়। শুনতে পাওয়া এইসব বই সব পড়া হয়, তা নয়। কিছু পড়েছি হয়তো। কিছু পড়তে চেয়েছি, হয়তো পড়া হবে। হয়তো হবে না। না হোক, তবু আমি চাই, প্রিয় বইয়ের কথা যারা বলে, তাদের কথা যেন আমার কানে আসে। আমি স্বাধীন এবং খানিক পরনির্ভরশীল এটা বলাই বোধহয় ভালো।
আমি বইয়ের ভেতর লিখে রাখি। নানা রকম মন্তব্য। দাগ দিই। পেছনে, কাভারের ভেতরের দিকে নানাকিছু লিখি। অন্যরা কেউ এই বই পড়লে হয়তো অসুবিধার মধ্যে পড়তে পারে, তবে বই পড়ার সময় এটা আমার মনে থাকে না। সব বইয়েই যে দাগ দিই, বা লিখি, তা না। কিছু বইয়ে নোট লিখে রাখি। এইসব আমার খুব প্রিয় বই। কিছু আছে পড়া শেষে, কাগজে কিছু লিখে রাখি। সেই কাগজ বইয়ের ভেতর গুঁজে দিই। অনেক বছর পরে, ঐ চিরকুট বা নোট পড়ে খুব অবাক লাগে।
তুমুল বই পড়া কিছু বন্ধু আমার আছে। তারা হয়তো অন্য অনেকেরই বন্ধু। প্রচুর বই পড়ে, এমন লোকেদের সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। বইপড়ারা খুব বেশি বাহাদুরি করে না। বাহাদুররা বই পড়ে না। কাজ করা আর কাজ করা দেখানো লোক আলাদা আলাদা হয়। বইপড়াদের অপছন্দ করার কোনো কারণ ঘটেনি আমার জীবনে।
একই বই, আরেকবার পড়তে গিয়ে দেখি, ভুলে গেছি। কিংবা মনে হয়, অনেক কিছুই মনে যে শুধু নেই তা নয়, আগের বার পড়েছি তাও মনে হয় না। সিনেমার ক্ষেত্রে আমার এরকম হয়। পরের এমন কিছু জিনিস দেখতে পাই, যা প্রথমবার পাইনি। আমি দুবার ফিল্ম এপ্রিশিয়েন কোর্স করেছি, দু-জায়গায়, কী করে সিনেমা বুঝতে হয়, দেখতে হয়, স্বাদ পেতে পারা যায় পুরোটা, তা নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। বইপত্র কিছু পড়েছি। তারপরও জহুরী টাইপের বন্ধুরা যখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখনই কেবল কিছু জিনিস দেখতে পাই। বই পাঠেও এরকম হতে পারে বলে মনে হয়।
বই পড়া নিয়ে যা কিছু লেখা গেল, তার মধ্যেও স্ববিরোধ আছে। অস্বীকার করে গণ্ডগোল পাকাতে চাই না। মনে হলো নিজের দুকথা লিখে রাখি। বেশি 'আমি', 'আমি' হয়ে গেল যদিও।
বই পড়া শিখিয়েছে যারা, যারা লেখে, যারা বই পড়ে জানিয়েছে সেই বইয়ের কথা, যারা বই ছাপিয়েছে যত্ন করে, পেছনে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে লিখিয়ে নিয়েছে, সমর্থন জুগিয়েছে লেখার মতো অসম্ভব কাজটি করে যেতে, ভাবতে বসলে--যারা বই পড়ে, সকলের কাছে তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
বই পড়া যারা ভালোবাসে, তাদের জীবনের অনির্বচনীয় আনন্দ কেবল বইপড়া ভালোবাসাদেরই জানা আছে। এইটুকু ঈর্ষণীয়।
ইফতেখার মাহমুদ-এর লেখা ইবুক পড়তে ক্লিক করুন এখানে
Leave a Reply
Your identity will not be published.