অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ থাকছেন কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ।
সিরাজগঞ্জ শহরে ইসমাইল হোসেন শিরাজী, ফুলবাড়িতে জিএম হিলালী ও আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীনের জন্মভূমি দেখার পরে আমরা চলেছি শাহজাদপুরে। ওখানকার ঘোড়শাল গ্রামের উদ্দেশে, সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর জন্মভূমিতে।
লোকাল বাসের যাত্রী আমরা। পথ অত্যন্ত সংকীর্ণ ও এবড়ো-থেবড়ো। ভগ্ন দশার এই পথ দিয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে আমাদের বাহনটি যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পরই থামছে। লোকজন হুড়মুড় করে নামছে এবং উঠছে। তখন চালক বাড়িয়ে দিচ্ছে গাড়ির গতি। আর প্রবল ঝাঁকুনি এবং হেলেদুলে গড়িটি অগ্রসর হওয়ায় যাত্রীদের তখন বেহাল অবস্থা। এ ধরনের গাড়িকেই পুরোনো ঢাকার লোকেরা বলে ‘মুড়ির টিন’। যথার্থ অভিধাই বটে! আর সেটি আমরা টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে।
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে শাহজাদপুরের ঘোড়শাল—আটচল্লিশ কিলোমিটার পথ। এই সামান্য পথ পাড়ি দিতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। বিরক্তিকর ভ্রমণ। একঘেয়েমির কারণেই ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙে আসতে চাইছে শরীর-মন। জানি না আমার সঙ্গী অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকারের অবস্থা কেমন!
ঘোড়শাল বাজারে বাস থামল। এটাই শেষ স্টপেজ। সব যাত্রীই বাস থেকে নামল। নামলাম আমরাও।
চারদিকে দোকানপাট। মুদি দোকান থেকে শুরু করে ফলের দোকান। ডানদিকে চেয়ে দেখি, দোতলা একটি অট্টালিকা। একটি কলেজ। ঘোড়শাল সাহিত্যিক বরকতুল্লাহ্ কলেজ। সরল রেখার মতো কলেজ ভবনটির অবয়ব। দুই প্রান্তে উপরে উঠার সিঁড়ি। সামনে বিশাল মাঠ। সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে—১৯৯৩ সালে এটি স্থাপিত হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯৭ সালে। বাস্তবায়নে ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট। ব্যাপারটি ভালো লাগার মতোই। এখানকার একজন কৃতী সন্তানের নাম বহন করছে এখানকার একটি কলেজ—এটা সত্যি প্রশংসনীয়।
আমি যখন নানা কথা ভাবছি তখন যে বিশ্বজিৎ কলেজের উদ্দেশে ছুটে চলেছে—তা টের পাই নি। যখন টের পেলাম তখন বিশ্বজিতের কাজ সারা অর্থাৎ সে কলেজ ভবনের ছবি ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলেছে।
বাজারের একটি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দোকানিকে জিজ্ঞেস করি, সাহিত্যিক বরকতুল্লাহর বাড়ি কোথায়?
ওই তো, দোকানি পেছনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, বেশি দূর না। বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাইয়া যাইবেন।
আমাদের কথোপকথনের মাঝেই বিশ্বজিৎ এসে দাঁড়াল। তাকে দেখালাম কীভাবে যেতে হবে আমাদের। তারপর ছুট আর ছুট।
ছুটে চললাম দুজনে মাঠ পেরিয়ে। ধানক্ষেত পেরিয়ে। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে। মানুষের বাড়িঘর অতিক্রম করে।
এক সময় পৌঁছে যাই মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র জন্ম ভিটায়। তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। অবশ্য এর মধ্যে দু’ একজনের কাছে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে। বাড়িটির পথ-নির্দেশ তাদের কাছ থেকেই পেয়েছি।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর বাড়িটি দুটি অংশে বিভক্ত। মূল বাড়ির আগে একটি অংশ। দুটি অংশেই বিরাট উঠোন। বাইরের অংশে চারচালা একটি টিনের ঘর। চারচালা টিনের ঘরটির বরাবর একটি ঘর। এটিও টিনের ঘর। তবে আটচালা এবং দোতলা। বাইরের অংশের উঠোনে দাঁড়িয়ে ভেতর বাড়ির দিকে তাকিয়ে বিশ্বজিৎ উঁচু কণ্ঠে বলে, কেউ কি আছেন?
চল্লিশোর্ধ্ব একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। ‘আপনারা কোথা থাইকা আইছেন না।’ কী চান?’ তিনি জিজ্ঞেস করেন। ‘ঢাকা থেকে এসেছি আর আমরা কিছু চাই।’ বিশ্বজিৎ জবাব দেয়। ‘তাইত আপনারা ক্যান আইছেন?’ ভদ্রলোক কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চান। বিশ্বজিৎ তখন আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুলে বলে। ভদ্রলোকটির চোখে-মুখে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ফিরে আসে। তিনি জানান, এই বাড়ির কেয়ারটেকার সে। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন। তিনিই তখন বাড়িটির সবকিছু ঘুরেফিরে আমাদের দেখান। তার থেকেই আমরা জানতে পারি যে, বাইরের অংশের চারচালা টিনের ঘরটি বৈঠকখানা। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত। এই ঘরেই গ্রামের লোকজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠতেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ।
হ্যাঁ, ১৮৯৮ সালের ২ মার্চ এখানে— সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ঘোড়শাল গ্রামে জন্মেছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্। তাঁর বাবা হাজি আজম আলি এবং মা তসিরন বিবি।
এই গ্রামের অর্থাৎ ঘোড়শালের মানুষ হাজি আজম আলিকে চিনতেন একজন কবিরাজি চিকিৎসক হিসেবে। শিক্ষিত ও ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নাম-ডাক ছিল।
হাজি আজম আলির ছিল দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ লেখাপড়া শেষ করে গ্রামেই এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। কাজের ফাঁকে সাহিত্যচর্চার অভ্যাসও তাঁর ছিল। তাঁর অপ্রকাশিত লেখা থেকে বোঝা যায় যে, লেখালেখিতে মোহাম্মদ রহমতুল্লাহর বেশ দখল ছিল। যদিও তাঁর কোনো লেখাই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি।
বড়ভাইয়ের সাহিত্যচর্চা থেকেই মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কি? না, এ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে পাশের গ্রাম বেলতৈলের মিডল ইংলিশ স্কুল ও শাহজাদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা শেষে যখন ১৯১৪ সালে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে, তখন একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মাঝে বসবাসের সৌভাগ্য তাঁর হয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও লেখক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, তাঁর সহকর্মী রমাপ্রসাদ চন্দ্র, অধ্যাপক ড. রাধাগোবিন্দ বসাক—এইসব জ্ঞানসাধকের নিবিড় সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে তার। তাঁদের বক্তৃতা ও আলাপ-আলোচনা তরুণ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকে চঞ্চল করে তোলে। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এছাড়া ১৯১৫ সালে রাজশাহীতে যে ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়—তাতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা-কলকাতার নামি সাহিত্যিকরা। তাদর সান্নিধ্য ও কথাবার্তাও মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকে সাহিত্য-জগতের দিকে ধাবিত করে। তিনি রাজশাহী কলেজের ম্যাগাজিনে লিখে চলেন অবিরাম প্রবন্ধ ও কবিতা। একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করেন এবং তার দুটি প্রবন্ধ (‘ভগ্ন দেউল’ ও ‘পদ্মাবক্ষে’) শ্রেষ্ঠ রচনার স্বীকৃতি পায়।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, লেখালেখির শুরুতেই এই দুটি প্রবন্ধে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্র উন্নত গদ্য-রচনাশৈলী লক্ষ করা যায়। তখন তিনি বিএ শ্রেণির ছাত্র। এই সময়েই, ১৯১৭ সালে (মাঘ, ১৩২৪) কলকাতা থেকে প্রকাশিত ও মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত ‘আল এসলাম’-এ বের হয় একটি প্রবন্ধ ‘ছাত্র সমাজে জাতীয়তা’। লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রশংসিত হয়। এখান থেকেই প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্’র সাহ্যিচর্চা গতি লাভ করে। পরে যখন এমএ পড়ার জন্যে বরকতুল্লাহ কলকাতায় যান, তখন সেখানকার লেখক-কবিদের অনেকের সঙ্গে পরিচিত হন। ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘সওগাত’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। ‘সওগাত’-এ দার্শনিক প্রবন্ধ এবং ‘মোসলেম ভারত-এ ফরাসি সুফী কবিদের জীবনী ও কাব্যালোচনা।
ঘোড়শালে মোহম্মদ বরকতুল্লাহ’র বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা—কেয়ারটেকার ভদ্রলোকের সঙ্গে। মনে পড়ে, এই বাড়িতে যখন ছুটিতে আসতেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, রাজশাহী কলেজে পড়ার সময়—তখন গ্রামের পুথি পাঠক ও কথকদের কাছে শুনতেন ‘সোহরাব রাস্তম’, ‘হানিফার লড়াই’—এইসব পুথিপাঠ এবং এভাবেই তার ব্যক্তি-মানসে সচেতনভাবে একজন শ্রোতা ও লেখকের অস্তিত্ব তিনি আবিষ্কার করেন।
ঘোড়শাল গ্রামের কলেজ শুধু নয়, গ্রামের সবার মনেই যে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র নামটি গাঁথা—গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই তা আমরা টের পেয়েছি। এখন যেমন টের পাচ্ছি তার পৈতৃক বাড়িতে। বাড়ির সর্বত্রই তার স্মৃতি ছড়িয়ে।
এই যে এখন মূল বাড়ির আটচালা দোতলা ঘরে আমরা দাঁড়িয়ে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পুরোনো আমলের একটি পালঙ্ক। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বললেন এই পালঙ্কে শুতেন বরকতুল্লাহ। তিনি না বললেও আমরা অনুমান করতে পারি, এই পালঙ্কে তার স্ত্রী জোবেদা খাতুন ঘুমুতেন। এমনকি তাঁদের চার ছেলে ও ছয় মেয়েও হয়তো কখনো না কখনো এখানে শুয়েছে। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক পুরোনো আমলের একটি টুল ও টেবিলের দিকে অঙুলি নির্দেশ করে জানালে যে, এই দুটি আসবাবপত্রের সঙ্গে বরকতুল্লাহ’র স্মৃতি বিজড়িত। তারপরই তিনি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরলেন। বিশ্বজিৎ ফ্রেম থেকে ছবিটি তুলে একটি চেয়ারের উপরে রেখে সেটিকে ক্যামেরা-বন্দি করার কাজে মগ্ন হলো।
যৌবনের প্রান্ত সীমায় যখন ছিলেন বরকুল্লাহ—সেই সময়ের ছবি। তার পরনে কোট-শার্ট; চোখে চশমা। চুল উল্টো দিকে আঁচড়ানো। প্রশস্ত কপাল।...এই ছবির মানুষটি সৃজনশীল সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন না বটে কিন্তু চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে তার নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। বিশেষত তার অমর গ্রন্থ ‘পারস্য প্রতিভা’ সেই স্বাক্ষরই বহন করছে। দুই খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থে ফারসি কবি ও দার্শনিকদের সাহিত্যকীর্তি এবং দর্শন সম্পর্কে অত্যন্ত গভীর বর্ণনা রয়েছে। বলা যায়, বরকতুল্লাহ পারস্যের ধ্রুপদী কাব্য-প্রতিভার আনন্দালোকে বাস করতেন। বাঙালি পাঠক-সমাজ ফারসি ভাষায় অনভিজ্ঞতার কারণে যখন সাদী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, রুমীর কাব্য পড়তেন না তখনই তিনি বাংলা ভাষায় তাদের রচনা এবং কাব্যরস পরিবেশন করেন। এই গ্রন্থের ভাষা ছিল সাধু-ভাষা কিন্তু তা অত্যন্ত শক্তিশালী, বক্তব্যভঙ্গি ঋজু, ব্যাখ্যায় পরিচ্ছন্ন, বর্ণনায় সাবলীল ও মনোরম, যুক্তিতে শাণিত এবং উপস্থাপনায় আকর্ষণীয়। বলা দরকার, ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রে বরকতুল্লাহ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ‘বান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রখ্যাত লেখক রায় বাহাদুর কালীপ্রসন্ন ঘোষ বিদ্যাসাগরকে। তার লেখার চিন্তাশীলতা বরকতুল্লাহকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। তিনি মনে করতেন, যদি মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কালীপ্রসন্ন ঘোষের মতো ভাষা ও বর্ণ-বিন্যাসের সাহায্যে উপস্থাপন করা যায়, তবে তা নিঃসন্দেহে মুসলমানদের কাছে গ্রাহ্য হবে। তাই তিনি ‘পারস্য প্রতিভা’ লেখায় মনোনিবেশ করেন এবং এ জন্যে কলকাতার ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) তাকে যেতে হয়, চার চারটি বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, পড়াশোনা এবং গবেষণা চালাতে হয়।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ দর্শনশাস্ত্রে এমএ করেছিলেন ( অবশ্য তিনি ‘ল’ পাসও করেছিলেন এবং লাভ করেছিলেন ওকালতির সনদ।)। তাই দর্শন চর্চাও ছিল তাঁর অন্যতম একটি প্রিয় বিষয়। তারই ফসল ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থটি। বরকতুল্লাহ্র দার্শনিক চিন্তার অত্যন্ত বিচক্ষণ বক্তব্য বহন করছে এই গ্রন্থটি। বলা যায় যে, আধুনিক বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যথার্থ দার্শনিক কলাকৌশল, যুক্তিমালা ও পরিভাষার প্রয়োগে গ্রন্থ রচনা করেছেন।...‘মানুষের মন’-এর বিষয় সূচি ছিল: অনন্ত তৃষা, আদিম প্রেরণা, জীবন ও নীতি, ধ্রুব কোথায়, জড়বাদ, পরমাণু জগৎ ও প্রাণশক্তির উন্মেষ, চৈতন্যবাদ, বস্তুরূপ ও বস্তু, জীবন প্রবাহ, বিজ্ঞান যুগে ধর্ম ও সভ্যতা, পারমাণবিক জগৎ ও জীবন। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু যথেষ্ট জটিল ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ভাষার সরলতা বিষয়ের জটিলতাকে অনেকাংশেই অপসৃত করেছে। এটি একটি সহজ ও সুখপাঠ গ্রন্থ হিসেবে পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ‘ধ্রুব কোথায়’ প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা যেতে পারে—‘মানুষ ভাবিতে ভালোবাসে যে, মরণের পরও আবার একটা জগৎ আছে। সেখানে এমনি নদ-নদী, এমনি তরুলতা, এমনি আনন্দ উৎসব, এমনি সংসার আবার আমাদিগকে অভ্যর্থনা করিবে। কিন্তু এতসব থাকিতে হইলে এ সকলে একটা নিয়ন্তা তো চাই। এ-সব তো আপনা আপনি সুসজ্জিত থাকিতে পারে না। অন্তত আমাদের ধারণায় তো তাহা আসে না। অতএব জগতের মূলে কোনো সজ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি এই সকলের নিয়ন্তা রূপে আছেন কিনা, অথবা এ জগৎ জড় মৃত্তিকার রূপান্তর মাত্র, সে প্রশ্নের একটা মীমাংসা হওয়া মানুষের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। জগৎ এবং জীবন যদি জড়শক্তিরই লীলাবিভঙ্গী হয় তবে তো মৃত্যুই জীবনের যবনিকা। জীবনের যত আশা-আকাক্সক্ষা এখন অতৃপ্ত রহিয়া গেল, তাহা চিরতরে এমনি অতৃপ্তই থাকিয়া গেল, আর তাহা কখনও গোলাপ হইয়া সর্বাঙ্গীন হইয়া ফুটিতে পাইবে না। অথচ ইহাই যদি সত্য হয়, তবে আমাদের ভালো লাগে না বলিয়াই ইহাকে উড়াইয়া দেওয়াও তো চলিবে না। এই সমস্যাই যুগে যুগে নানা আকারে নানাভাবে মানুষের চিত্তকে আলোড়িত করিয়া আসিয়াছে।”
বরকতুল্লাহ’র আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘কারবালা’। ১৯৫৭ সালে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে বরকতুল্লাহ’র আরেকটি সত্তার উন্মেষ ঘটে। কেননা এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ইতিহাসের ভাষ্যকার হিসেবে।
‘কারবালা’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে, এখানে বরকতুল্লাহ কারবালা কাহিনিকে সুষ্ঠু ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কারবালার কাহিনি যে একঠি খণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র ছিল না, এর যে গভীর ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল—যা ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে—এই বিষয়েও সচেতন ছিলেন বরকতুল্লাহ। তাই তো তিনি কারবালা যুদ্ধের পটভূমি হিসেবে নবীবংশের ইতিবৃত্ত যেমন জুড়ে দিয়েছেন, তেমনি কারবালার ঘটনার পরিণতি ও প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলাম জগতে যে দীর্ঘ-কালব্যাপী দ্বন্দ্ব-বিক্ষোভ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে তারও ইতিহাস এতে সংযোজিত করেছেন।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ আরও কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছেন ‘নবীগৃহ সংবাদ’ (মক্কা খণ্ড), ‘নয়াজাতি স্রষ্টা হযরত মুহম্মদ’, ‘হযরত ওসমান’। তবে এই গ্রন্থগুলোতে বরকতুল্লাহর শক্তিমত্তার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটে নি।
ভাবনার জগৎ থেকে মন ফিরে আসে। নিজেকে আবিষ্কার করি ঘোড়শালে, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র পৈতৃক ভিটায় তথা বাড়িতে। দেখতে পাই এই বাড়ির কেয়ারটেকার ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশ্বজিৎকে। আটচালা দোতলা একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তারা। ঘরটির সামনে খড়ের স্তূপ। হ্যাঁ, এতক্ষণ এই ঘরের ভেতরেই ছিলাম আমরা। এখানেই রক্ষিত রয়েছে বরকতুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত পালঙ্ক ও অন্যান্য আসবাবপত্র। বিশ্বজিৎ কী যেন বলছে কেয়ারটেকার ভদ্রলোককে। তাদের কাছে যাই। শুনতে পাই কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বলছেন, এটি ছিল গুদামঘর। তিনি বাম দিকে অঙুলি নির্দেশ করেন। গুদামঘর থেকে আমরা মূলবাড়ি পেরিয়ে বাইরের অংশে উপস্থিত হই। এখানে গুদামঘরের সামনের অংশ। দুই পাশে কয়েকটি কাঁঠাল গাছ।
আচ্ছা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র সময়ের কোনো গাছ কি এখন রয়েছে—যে গাছের ফল তিনি খেয়েছেন? প্রশ্নটি মনে উদয় হওয়া মাত্র কেয়ারটেকার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করি। তিনি সহাস্যমুখে পুবদিকে অঙুলি নির্দেশ করে বলেন, হ্যাঁ, ওই আম গাছটি তার আমলের। আমরা বোধ করি, কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বরকতুল্লাহ সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। দায়িত্ব ও কাজের বাইরেও বোধহয় বরকতুল্লাহ’র প্রতি তার শ্রদ্ধা রয়েছে। যেমন, আমরা যে এখানে ছুটে এসেছি—এটি তো আমাদের কাজ। কিন্তু হৃদয়ের টানও নিশ্চয় রয়েছে।
মনে পড়ে যায়, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ দীর্ঘদিনব্যাপী উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে এখনকার প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস থেকে অবসরের আগে তিনি খুলনা ও বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিছুদিন ছিলেন শিক্ষা দফতরের ডেপুটি সেক্রেটারি। বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক ছিলেন তিনিই। ১৯৭০ সালের ২ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার আগে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অসীমে মিলে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী জোবেদা খাতুন, ১৯৬৭ সালে।
প্রবন্ধ সাহিত্যে অসামান্য অবদান রয়েছে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর। এর স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পান বহু পুরস্কার। যেমন, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬০), পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সিতারা ই-ইমতিয়াজ খেতাব ও স্বর্ণপদক (১৯৬২), দাউদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), প্রেসিডেন্ট মেডেল (১৯৭০), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৪, মরণোত্তর)।
বিশ্বজিৎ-এর হাতে বরকতুল্লাহর ছবি। সে কেয়ারটেকার ভদ্রলোকের হাতে সেটি ফিরিয়ে দেয়। হ্যাঁ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এখন ছবি। কিন্তু শুধুই কি ছবি? মন বলে, না। ঘোড়শাল গ্রামের মানুষ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসই এ কথার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.