‘লাল কাজল’ ছবি তৈরির গল্প

‘লাল কাজল’  ছবি তৈরির গল্প

গত শতকের আশির দশকের প্রথম পর্যায়ে মুক্তি পেয়েছিল ‘লাল কাজল’। এটি পরিচালক মতিন রহমানের অভিষেক চলচ্চিত্র, যেখানে এক বন্ধ্যা নারীর করুণ কাহিনি মূর্ত হয়ে উঠেছে।...‘লাল কাজল’ হলো মূলধারার মধ্যেও ভিন্ন কিছু করার প্রচেষ্টা। এই ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রটির নির্মাণের গল্প এখানে তুলে ধরা হলো।

 

এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের একটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র ‘লাল কাজল’। অবশ্য এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ ছবিটি দেখলে তার কাছে এটিকে তেমন আহামরি কিছু মনে নাও হতে পারে। কেননা নিকট অতীতে এবং এখন মূলধারার চলচ্চিত্রেও বাস্তবতার পাশাপাশি নান্দনিকতা ফুটে উঠছে। কিন্তু গত শতকের সত্তর-আশির দশকে এ ধরনের ছবি বিরলই ছিল। ‘লাল কাজল’ তেমনই একটি প্রচেষ্টা। ছবিটি সেই সময়ের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের বাঁধাধরা ফর্মুলা বা ছককে ভাঙতে চেয়েছে। অন্য কথায়, ছবিটি দেখে দর্শক যেমন বিনোদন পেয়েছে তেমনই বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিও এখানে লক্ষ করেছে।

‘লাল কাজল’ ছবিটির পরিচালক মতিন রহমান দীর্ঘ আট-নয় বছর কাজ করেছেন স্বনামধন্য পরিচালক আজিজুর রহমানের সহকারী হিসেবে। তিনিই মতিন রহমানকে চলচ্চিত্র পরিচালনা করার সুযোগ করে দেন। বিষয়টি তিনি সংগোপনে নিজের মধ্যেই লালন করেছিলেন। তাই তো ১৯৮১ সালের একদিন যখন এক প্রযোজক এফডিসির ছয় নম্বর সম্পাদনা কক্ষে যান আজিজুর রহমানের মতামত নেওয়ার জন্য যে তিনি একটি ছবি বানাতে চাইছেন মতিন রহমানকে দিয়ে, তখন আজিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘মতিন কী ছবি বানাবে? ও তো কিছুই জানে না।’ গুরুর মুখে এমন কথা শুনে সেদিন মতিন রহমান ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। ঘটনাটি জানার পরে মতিনের দুই বন্ধু শাহ আলম কিরণ ও নূর হোসেন বলাই শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন আজিজুর রহমানকে। কিন্তু মতিন রহমান তাদের নিরস্ত করেছিলেন। অবশ্য তখনো তিনি বুঝতে পারেন নি সামনে তার জন্য একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। উল্লেখ্য, সাংবাদিক-সাহিত্যিক মাহফুজ সিদ্দিকীর ‘প্রেম তুই সর্বনাশী’ গল্প অবলম্বনে প্রথম ছবিটি বানাতে চেয়েছিলেন মতিন রহমান।

১৯৮১ সালের কথা। সেই বছরেরই একদিন এটিএম শামসুজ্জামান ‘লাল কাজল’-এর গল্পটি বলেন আজিজুর রহমানকে। গল্পটির স্রষ্টা হলেন ফজলে রহমান। গল্পটি পছন্দ হয় আজিজুর রহমানের। তিনি মতিন রহমানকে নির্দেশ দেন, ‘প্রতিদিন শুটিং-এর পরে রাতের বেলা তুমি এটিএম ভাইয়ের বাসায় যাবে। তিনি এই গল্পটির চিত্রনাট্য লিখবেন আর তুমি তাকে সাহায্য করবে।’

গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী মতিন রহমান প্রতিদিন রাতে পুরোনো ঢাকার সুত্রাপুরে যেতেন, এটিএম শামসুজ্জামানের বাসায়। সারা রাত কাটাতেন সেই বাড়িতে। এটিএম শামসুজ্জামানের নানা নির্দেশ পালন করতেন। কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, এরকম নানা লেখকের নানা বই তিনি এটিএমের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির র‌্যাক থেকে বের করতেন। সেইসব বইয়ের বিশেষ বিশেষ অংশ পাঠ করতেন। এর মধ্যে কোনো এক সময়ে ‘লাল কাজল’-এর চিত্রনাট্যের একটি অংশ লেখা হতো। এভাবে মাসখানিক পর চিত্রনাট্যটি পুরোপুরি লিখে শেষ করলেন এটিএম শামসুজ্জামান। ছবিটির সংলাপ লেখকও তিনি।

চিত্রনাট্যে ছবিটির এই গল্পটি ফুটে উঠেছে— গ্রামের এক গরিব ঘরের মেয়ে ফুলজান। রূপসী কিন্তু বন্ধ্যা। বিয়ে হয় কিন্তু সন্তান হয় না বলে সেই বিয়ে টিকে না। একপর্যায়ে ফুলজানের বিয়ে হলো লিয়াকতের সঙ্গে। সুখে-দুঃখে তাদের দাম্পত্যজীবন ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন রাগের মাথায় লিয়াকত তালাক দিলে ফুলজান স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসে। এবার রূপসী ফুলজানের প্রেমে পড়ে বাদশা। ফুলজানকে সে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাদশা’র মা রাজি হন না। তিনি তাঁর একমাত্র সন্তানকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এই বিয়েতে বাদশা সুখী হবে না। তার ঘরে সন্তান আসবে না। আর বন্ধ্যা নারী হলো অপয়া। তারা যে সংসারে যায়, সেই সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি চলে যায়। কিন্তু বাদশা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে—সে ফুলজানকেই বিয়ে করবে। তো মায়ের অমতেই ফুলজানকে বিয়ে করে বাদশা। বাসররাতে স্বামীর সোহাগভরা কথা শুনে মুগ্ধ হয় ফুলজান। কিন্তু পরদিন সকালেই সে আবিষ্কার করে, গাছের ডালে ঝুলছে বাদশার নিথর দেহ। মর্মান্তিক এ দৃশ্যটি দেখে ফুলজান আর্তনাদ করে ওঠে। বাতাসে ফুলজানের মাথা থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। সংগত কারণেই বাদশার মৃত্যুর পরে সেই গৃহে ফুলজানের ঠাঁই হয় না। ফুলজান এবার ঢাকা শহরে পাড়ি জমায়। গ্রামের পরিচিত বান্ধবী ফুলমতির মাধ্যমে এক ধনী গৃহে সে কাজ পায়। আয়ার চাকরি। সেই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের জীবন নিয়ে মত্ত; আমোদ-ফুর্তিতে বিভোর তারা। একমাত্র মেয়ে বেবীকে দেখাশোনার তাই সময় হয় না তাদের বাবা-মার। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছোট্ট মেয়েটি তাই আয়ার কাছ থেকে মায়ের স্নেহ পেয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলে। একদিন সে ফুলজানকে বলে, সে যেন তাকে নিয়ে দূরে চলে যায়, দেশ থেকে বিদেশে। বেবীর কথায় প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে ফুলজান বেবীকে নিয়ে পালিয়ে যায়; দেশের সীমানা অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এ সময় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে সে নিহত হয়। মৃত্যুর আগে শরীরের রক্ত দিয়ে সে বেবীর কপালে কাজলের চিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়, যেন তার কল্যাণ হয়—কারও বদ নজর না লাগে।

একদিন এই স্ক্রিপ্টটি নায়িকা শাবানার সামনে পাঠ করা হলো। শোনার পরে শাবানা বললেন, ‘এটি আমি প্রযোজনা করব, আমার ব্যানার থেকে।’ কিন্তু শামিম রহমান, আজিজুর রহমানের স্ত্রী, ‘লাল কাজল’-এর প্রযোজক, তিনি প্রত্যাখ্যান করেন শাবানার এই প্রস্তাব। তিনি শাবানার শত অনুরোধের মুখেও অটল থাকেন। শাবানার মান-অভিমান কোনো কিছুই তিনি গায়ে মাখেন নি। ‘লাল কাজল’কে এসএস প্রোডাকশনের ব্যানারে শাবানাকে প্রযোজনা করতে তিনি দেন নি। তখন শাবানা ছবিতে অভিনয় করবেন না বলে জানান। অবশ্য পরে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। রাজি হন ছবিতে অভিনয় করার জন্য।

সেই সময়ে এদেশের চলচ্চিত্রের জগতে একটি রেওয়াজ ছিল, পহেলা বৈশাখে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন ছবির নাম ঘোষণা করার। তো ১৩৮৮ সালের পহেলা বৈশাখে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলো এবং সেখানে দেখা গেল যে, ‘লাল কাজল’ নামে একটি ছবি নির্মিত হবে শামীম রহমানের প্রযোজনায় এবং সেটি পরিচালনা করবেন মতিন রহমান।

বিজ্ঞাপনটি পড়ে মতিন রহমান হতবাক হয়ে যান এবং কিছুটা আবেগপ্রবণও। তিনি বলেন, ‘নিজের অর্জিত পয়সায় সহকারীকে দিয়ে ছবি বানাবেন, এমন উদারতা এদেশের চলচ্চিত্র জগতে বিরল। এজন্য আমি চিরদিন পরিচালক আজিজুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’

ছবির অভিনয়শিল্পীদের প্রসঙ্গে আগেই শাবানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ ফুলজানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন প্রবীর মিত্র (লিয়াকত), ফারুক (বাদশা), রওশন জামিল (বাদশার মা), আনোয়ারা (ফুলমতি), উজ্জল (বেবীর বাবা), জুলিয়া (বেবীর মা), বিন্দিয়া (বেবী)। উল্লেখ্য, শাবানাসহ ছবিটির অভিনয়শিল্পীদের সবাই বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করেছেন।

ছবিটির শুটিং হয়েছে ঢাকার এফডিসিতে, সাভারে এবং ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। ক্যামেরা ওপেন হয়েছিল সাভার থানার কাছে মনু মিয়ার বাড়িতে। সেখানেই একটি শট প্রথম ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল। যেখানে বাদশা রূপী ফারুক তার মা রূপী রওশন জামিলের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘মা, আমি এই মাইয়াডারেই বিয়া করুম।’

ছবিটির শুটিংয়ের সময় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সাহায্য করেছিল। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্ডারের অঞ্চলটি তৈরি করা হয়েছিল।

‘লাল কাজল’-এর শুটিংয়ের সময় নানা ঘটনা সংঘটিত হয়। যেমন বাদশার (ফারুক) ফাঁসির দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করার সময় নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান রেজা লতিফ ও পরিচালক মতিন রহমান। সব বাধা পেরিয়ে যখন দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করতে যাচ্ছেন ক্যামেরাম্যান তখন গাছের ডাল ভেঙে ঝুলন্ত ফারুক নিচে পড়ে যান। দৃশ্যটি টেক করতে পারেন না ক্যামেরাম্যান। পরে অবশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে সমর্থ হন তিনি।

শুটিংয়ের সময়ে আরেকটি সমস্যা ছিল মেঘলা আকাশ। ফলে সময়মতো এবং নির্বিঘ্নে শুটিং করা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় ছবির অন্যতম অভিনেতা প্রবীর মিত্র একদিন মতিন রহমানকে নিয়ে গেলেন জ্যোতিষী আলী ইমামের কাছে, গোপীবাগে। তিনি মন্ত্রপড়া তাবিজ দিলেন মতিন রহমানকে, দুতিনটি আংটিও দিলেন পরার জন্য। যেন তিনি নির্বিঘ্নে শুটিং করতে পারেন। সুন্দরভাবে কাজ হয় ‘লাল কাজল’-এর। প্রযোজকের কোনো আর্থিক ক্ষতি না হয়।

‘লাল কাজল’-এর শুটিং মূলত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ীই হয়েছে। তবে শেষ দৃশ্যটি কিছুটা পরিবর্তন করতে হয়েছিল পরিস্থিতির কারণে। যেমন চিত্রনাট্যে ছিল দেশের সীমানা অতিক্রম করার সময় পাহাড়ে উঠছিল ফুলজান ও বেবী। কিন্তু দেখা গেল বেবীর কষ্ট হচ্ছে। সে একপর্যায়ে পা পিছলে পড়েও যায়। তখন স্ক্রিপ্ট রাইটার ও ছবির অন্যতম অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেছিলেন যে, ‘বাচ্চাটিকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। যত কষ্টই হোক শাবানাকেই কাঁধে করে বিন্দিয়াকে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে হবে।’ তাই হয়েছিল। ফুলজানরূপী শাবানাই শিশুশিল্পী বিন্দিয়াকে বহন করেছিলেন কাঁধে।

‘লাল কাজল’-এর দুটি প্রতীকী শট রসিক দর্শকদের আনন্দ দিয়েছিল। যেমন বাসরঘরে বাদশা (ফারুক) নববধূ ফুলজানকে (শাবানা) কাছে টেনে নিচ্ছে। কাট টু গনগনে মাটির চুলার ভেতরে একটি কাঠ ঢুকে যাচ্ছে। আবার বেবীর বাবা (উজ্জল) বেবীর মাকে (জুলিয়া) গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। কাট টু গাড়ি বারান্দায় পাইপের পানি দিয়ে গাড়িটি ধুইছে ড্রাইভার। পাইপ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। এছাড়া খাঁচার ভেতরে মুরগি। বাইরে ঘোরাফেরা করছে তার বাচ্চারা। এই শটের সঙ্গে ফুলজানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে মাতৃত্বের প্রতি তার কামনাকে বোঝানো হয়েছে।

ছবিটির শেষ দৃশ্যটিও নান্দনিক দ্যুতিতে উদ্ভাসিত। সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে ফুলজানের (শাবানা) দেহটি কেঁপে ওঠে। এই সময়ে স্লোমোশনে দেখা যায় যে, সে উঠছে। পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাতাসে তার মাথার আঁচলটি তারকাটায় লেগে গেছে। সে নিচে নামছে। ইন্টার কাটে দেখা যাচ্ছে, ফুলজানের শাড়ির আঁচলটি আস্তে আস্তে তারকাঁটায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এক নারীর পতন হচ্ছে, তার স্বপ্নেরও মৃত্যু হচ্ছে।

একটি দৃশ্য রয়েছে, সেখানে চিত্রগ্রাহক রেজা লতিফের শ্রম ও আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। দৃশ্যটি হলো, ক্যামেরার ফোরগ্রাউন্ডে বাদশার লাশ। ওপারে বেদনায় কাতর ফুলজান। বাতাসে ধীরে ধীরে তার মাথার আঁচলটি সরে যাবে। লং শটে এক টেকে এটি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন রেজা লতিফ। অবশ্য এজন্য তাকে এবং পরিচালকসহ অন্যদেরও ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছিল। যেহেতু সেটি লংশট ছিল সেহেতু অন্য কেউ ফুলজান রূপী শাবানার মাথায় আঁচলটি সরিয়ে দিতে পারছিল না। তাই শাবানার পেছনে একটি বৈদ্যুতিক স্ট্যান্ড ফ্যান রাখা ছিল, যেন সেই ফ্যানের জোরালো বাতাসে মাথার আঁচলটি সরে যায়। কিন্তু কিছুতেই তা সরছিল না এবং পরিচালকসহ অন্যদেরও উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়ছিল। শেষ পর্যন্ত একপর্যায়ে শাবানার মাথার আঁচলটি সরে যায়। তখন সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

ছবিতে চারটি গান রয়েছে। ‘নজর লাগবে বলে কাজলের টিপ দিলাম মাগো’ এবং ‘আমার বউ কেন কথা কয় না’— গান দুটি জনপ্রিয় হয়েছিল। গানগুলো গেয়েছিলেন সাবিনা ইসলাম ও এন্ড্রু কিশোর। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সংগীত পরিচালক সত্য সাহা।

‘লাল কাজল’-এর প্রিমিয়ার হয়েছিল ধানমন্ডিতে অবস্থিত তৎকালীন ফিল্ম আর্কাইভ-এ। সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মমতাজউদ্দিন আহমদ এবং আহমেদ জামান চৌধুরী। ছবিটি দেখার পর তারা সবাই প্রশংসা করেছিলেন এটির নির্মাণশৈলীর জন্য। তবে মমতাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘পরিচালক, আপনি তো গুলিটা ফুলজানকে মারেন নি, গুলিটা মেরেছেন প্রযোজকের বুকে।’ তার অভিমত ছিল ছবিটি প্রচলিত রীতি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই শেষ দৃশ্যটি আবার নতুনভাবে ধারণ করে ফুলজানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কি না— এমন একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন তিনি। প্রযোজক শামীম রহমান বলেছিলেন যে, ‘ছবিটি যেভাবে শেষ হয়েছে, এ নিয়ে আমার আত্মতৃপ্তি আছে। তাই দৃশ্যটির কোনোরকম পরিবর্তন চাচ্ছি না আমি।’

‘লাল কাজল’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮২ সালের ৭ মে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি হলে। ঢাকার বলাকা সিনেমাহলে মর্নিংশোতে ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন পরিচালক মতিন রহমান। গিয়ে দেখলেন হলভর্তি দর্শক। অবশ্য ছবিটি দেখার সময় তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। যা হোক মতিন রহমান ভেবেছিলেন, দর্শকদের বেশ ভালো লেগেছে ছবিটি। হয়তো সফল হবে এটি। কিন্তু ম্যাটিনি শো থেকেই ক্রমশ দর্শক কমতে থাকে। হ্যাঁ, বক্স অফিসে ‘লাল কাজল’ সফল হয় নি। তবে দর্শক-সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তে হীরেন দে লিখেছিলেন, ‘ছবি নিয়ে যাদের ব্যবসা, তারা একটা সংস্কার মানেন। ছকের বাইরে পা দিতে নেই। লাল কাজলের সাহস সেই সংস্কার ভাঙার উদ্যোগে। অথচ নির্মাতারা এমন ধারণা প্রচার করেন নি যে তারা বক্স-অফিস নামক ব্যাপারটার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্য কিছু করতে চেয়েছেন।...পরিচালক মতিন রহমানের প্রথম কাজ হিসেবে এই ছবিতে যে বলিষ্ঠতার ছাপ (বিশেষ করে প্রথম অংশে) আছে তা চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে দৈনন্দিন জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি ধরে দিতে পেরেছেন। এটা কম কথা নয়। তাই সম্ভাবনাময় পরিচালক হিসেবে মতিন রহমান মনোযোগের দাবিদার। চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ-লেখক এটিএম শামসুজ্জামান লিয়াকত ও বাদশা পর্বের পরিস্থিতি রচনায় যত দৃঢ় ও লক্ষভেদী (বাদশার আত্মহত্যার পটভূমি ও পরিস্থিতি আরও ব্যাখ্যা করা যেত না কি?) সেই তুলনায় বেবী পর্ব কিছুটা শিথিল বলে মনে হয়েছে (শট ডিভিশনের কল্যাণেও এই শিথিলতা আসতে পারে)। সন্তানধারণের জন্য তুক-তাকের ব্যাপারটিকে কোনো কথা না বলে যেমন কুসংস্কার হিসেবে স্পষ্ট করা হয়েছে, তেমনই ভূইফোঁড় বিত্তবান লোক সমষ্টির জীবনযাত্রাকে ডিসকো দিওয়ানে, সন্তান সামলাবার জন্য আয়ার ওপর নির্ভর করায় এবং চিত্রতারকাদের কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তেমনই বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ ঝরে পড়েছে আনোয়ারার মুখের কথায় ও চলনে-বলনে। তালাক দেওয়ার পরে (রাগের মাথায় তালাক নাকচও হতে পারে) লিয়াকতের (প্রবীর মিত্র) বাড়ি ছেড়ে ফুলজানের চলে যাওয়ার সময় ঘরের জানলা দিয়ে লিয়াকত যখন বউকে চলে যেতে দেখছে সেই মুহূর্ত রচনাটি হৃদয় স্পর্শ করে। বাদশার অপমৃত্যুতে ফুলজানের অসহায়তা ও বাদশার মার বিলাপও মনে দাগ রেখে যায়। দুটি মিলনদৃশ্যের পরে উনুনে জ্বলন্ত কাঠ দেওয়া ও পাইপের পানি দিয়ে গাড়ি ধোঁয়া রসাভাসের কারণ ঘটিয়েছে। তবে ফুলজানের মানসিক প্রতিক্রিয়াকে তীব্র করে তোলার জন্য গাছ কাটার দৃশ্য প্রয়োগ মন্দ নয়।’

Leave a Reply

Your identity will not be published.