[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব।]
বেলগ্রেডের সীমা-পরিসীমা
‘সারা দিনের প্রোগ্রামে আমরা কোথায় কোথায় যাব?’ জিজ্ঞেস করি গাইডকে।
‘যাচ্ছি যখন, দেখতে পাবা। অস্থির হোয়ো না।’ সৌজন্যহীন উত্তর।
স্রদজান রিসটিচ ফ্রি ল্যান্সিং ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করেন। বিদেশি টিমের সঙ্গে তাকে পাঠানো হয়। সার্বিয়ার পর্যটন বিভাগ তাকে প্রায়ই ভাড়া করে। ভদ্রলোকের হাবভাব বেশি। চুপচাপ থাকেন, জিজ্ঞেস করলেও উত্তর শুধু হুঁ-হ্যাঁ। এই যদি তার আচরণ হয়- তার কাছ থেকে কী জানব?
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে বেলগ্রেডের সীমায়, সড়ক-উপসড়কে, অলিগলিতে। আমি গাড়ির সামনের সিটে। গাড়ি এগিয়ে চলে উত্তর দিকে। ন্যাম সম্মেলন উপলক্ষ্যে শহরের নতুন রূপ, সাজানোগোছানো। সড়কের মাঝের ডিভাইডারের ওপর লম্বা লাইন জুড়ে বিভিন্ন দেশের পতাকা। বিভিন্ন রঙের ফেস্টুনে শোভিত পুরো এলাকা। মোবাইল ক্যামেরায় উঠতে থাকে ছবির পর ছবি। বস্তু থেকে ছুটে আসা আলো ঢোকে চোখের কর্নিয়ায়। যা মগজে স্থায়ী আসন গেড়ে রাখতে সাহায্য করে।
৩৬০ বর্গ কিলোমিটারের বেলগ্রেড সার্বিয়ার রাজধানী। দেশের সবচেয়ে বড়ো শহর। সাভা ও দানিয়ুব নদীর মোহনায় এটি। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী থাকার সময় এই বেলগ্রেডের আয়তন ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯০ বর্গকিলোমিটার; যা বাংলাদেশের আয়তনেরও বেশি। সময়ের সঙ্গে ক্ষয়ে গেছে এর সীমা-পরিসীমা।
১৯৮৬ সালে যুগোস্লাভিয়া নামে কোনো দেশ শেষবারের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়। ১৯৯০-এর পর দেশটি ভেঙে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আর স্লোভেনিয়া সৃষ্টি হয়। সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো মিলে ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া নামে কিছুদিন টিকে থাকে। ২০০৬ সালে লাগে কফিনে শেষ পেরেক, মন্টেনিগ্রোও স্বাধীন হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে যুগোস্লাভিয়া নামটি হারিয়ে যায়, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যায় শব্দটি। শেষ রক্ষা হয় নি সার্বিয়ারও, কসোভো নামে একটি অংশও আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
চারপাশে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টি একটু খাটাস টাইপের। যাতে মায়ামহব্বত নাই, নেই রোমান্টিকতা। ঠান্ডায় হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। বছরে এই শহরে বৃষ্টি হয় ৭০০ মিলিমিটার। আর গড় তাপমাত্রা ১১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বাংলাদেশের বৃষ্টির সঙ্গে পৃথিবীর আর সব দেশের বৃষ্টিতে ফারাক আছে। ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি গলি, যানজটের রাস্তা, গ্রামের মেঠোপথ কিংবা নদীর বুকে যখন বৃষ্টি নামে, মুগ্ধতার আবেশে চোখ বুজে আসে। কচু পাতার উপর পানির গড়াগড়ির সৌন্দর্য চোখ ছাপিয়ে যায়। ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি সৌদি আরবের বৃষ্টিতেও তাকিয়ে থাকার মতো কোনো অনুষঙ্গ নেই।
পুরো শহর জুড়েই চার, ছয় বা আট লেনের সড়ক। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সিগনালে মৃদু জ্যাম। রাস্তার ধারে লেন জুড়ে পার্কিং, যার জন্য একটা ফিও পরিশোধ করতে হয়।
‘পরিচ্ছন্ন শহর তোমাদের। যানজট নেই, রাস্তাঘাটে ভিড় নেই। নিয়ম মেনে গাড়িও চলছে। গাড়ির চাপ সব সময় এমন কম থাকে? নাকি নিয়ন্ত্রিত রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছ?’
শব্দ করে হাসে ক্রিভো। এবার আমার গাড়িতে তার পালা। দিনের শুরুতে পরিচয় হয়েছিল। মিষ্টি মেয়ে, এক হাতে অনেক কিছু সামলাচ্ছে। তাকে খেয়াল করি, খেয়াল আমার প্রতিও তার। সবকিছুতে আমার আগ্রহ দেখে খুশি ক্রিভো। কথা বলি, জানতে চাই, কত প্রশ্ন এই শহর, নগর, মানুষ সম্পর্কে। তার মতো করে বলার চেষ্টা করে। মাঝেমধ্যে হাতের ফোন থেকে খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় তথ্য।
‘বেলগ্রেড নগরীতে বাস করছেন ১৪ লাখ বাসিন্দা। সুষ্ঠুভাবে যেন তারা চলাচল করতে পারে, সেজন্য চেষ্টা রয়েছে সরকারের। চাইলে তুমি বাসে উঠতে পারো, উঠে বসতে পারো ট্রামে। ট্যাক্সি, মেট্রোসার্ভিসও রয়েছে। এখানে ১০০-রও বেশি বাস লাইন রয়েছে। একেক অঞ্চলের জন্য একেক রঙের বাস।’
আমরা প্রাইভেট গাড়িতে করে ঘুরছিলাম। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠা হয়ে ওঠেনি একবারও। চোখে পড়ে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙের ট্রাম আর পাবলিক বাস। ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট বাসের ধীরগতির চলাচলও চোখ এড়ায় না। বেলগ্রেডের সব গাড়ির যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক আছে। গাড়ির ড্রাইভার আইন মেনে চলেন। ঢাকার ড্রাইভাররা আইন ভেঙে চলেন, তাদের থাকে বেপরোয়া গতি। অন্যকে পেছনে ফেলে সামনে যাওয়ার জন্য লড়াই করেন। গাড়ির যন্ত্রপাতিও লক্কড়ঝক্কড় মার্কা।
ঢাকার কথা মনে করি। পরিকল্পিত শহরের মানদণ্ড অনুযায়ী একটি শহরে সড়ক থাকার কথা ২৫ ভাগ। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। ৪ লাখের মতো গাড়ি ঢাকার রাস্তায় চলাচল করলে স্বাভাবিক গতি বজায় থাকে। কিন্তু গাড়ি আছে ১৭ লাখ ৩৩ হাজার। এই হিসাবটা করেছিল বিটিআরসি ২০২০ সালে। বাড়তি গাড়ির ঝামেলায় ঢাকায় দিনে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের হিসাব বলছে, ঢাকার যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে বছরে ২৪ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) হিসেবে মাঝে মধ্যেই বসবাসের অযোগ্য হিসেবে তালিকার প্রথম দিকে থাকে ঢাকা।
বৃষ্টিতে ভেজা পথঘাট পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভেজা জবুথবু হলুদ গাছপালা। বাংলাদেশের গাছপালা আকাশ থেকে পড়া পানি পেলে যেন সজীব হয়ে ওঠে। বাঙালি রমণীর মনের মতো উৎফুল্ল হয়ে ওঠে পত্রপল্লব। কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশের মতো এই সার্বিয়ার গাছপালাও খানিকটা নীরস, উচ্ছ্বাসহীন। আমাদের সামনে, বাঁয়ে, ডানে, পেছনে বেলগ্রেডের বাস, ট্রলিবাস, ট্রাম। এই নগরীতে ১৩০টি রুটে অনবরত ছুটে চলে এই যানগুলো। কোথাও দেখি মেট্রো পাতাল ভেদ করে গেছে, কোথাও উঠেছে পাতাল ফুঁড়ে। অন্যান্য শহরে যাতায়াতের জন্য রয়েছে দ্রুতগতিতে শোঁ করে চলা বুলেট ট্রেন।
বেলগ্রেডে তখন আষাঢ়ে বৃষ্টি। অলিগলি, বাঁক-মোড় পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল একটা ভবনের সামনে। সঙ্গে থাকা গাইড আর নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অত্যন্ত সচকিত। ত্বরিত গতিতে গাড়ি থেকে নেমে ছাতা মেলে ধরলেন, গাড়ি থেকে অতিথি বের হবেন। অথচ তারা এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে একাকার-সেদিকে খেয়াল নেই। ওনারা সামনে এগিয়ে গেলেন। আর আমি তো ‘বেওয়ারিশ’ আগন্তুক। মিলানা ঘাড় বাঁকা করে পেছনে তাকালেন, চোখের ইশারা করলেন আমায়—
‘কী হবে তোমার! কিছু করতে পারছি না। অপেক্ষা করো, না হলে ভেজো।’
আমার জন্য ওর ‘দরদ’ দেখেই ভালো লাগে। এমন নারীর ইশারায় আটলান্টিকে সাঁতরানো যায়!
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.