সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (চতুর্থ পর্ব)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (চতুর্থ পর্ব)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।] 

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু আইনেই!

‘বাংলাদেশে কয়টা পত্রিকা বের হয়? টেলিভিশনগুলো বিজ্ঞাপন পায়? উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মিডিয়ার টুঁটিও চেপে ধরা হয়। তোমাদের দেশের হালহকিকত কী?

আরটিএসের স্পেশাল প্রজেক্ট এডিটর আনা মার্জিয়া সিমোনোভিচ। তার প্রশ্ন, বাংলাদেশের মিডিয়া নিয়ে।

প্রকাশিত পত্রিকা আর টিভির কথা না হয় বলেই দিলাম। মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কী বলব?

‘বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বেড়েটেড়ে এখন প্রায় ১৮ কোটি। সেখানে নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ১৩৭টি। এর বাইরে রয়েছে কত শত যে অনলাইন!’

উত্তর শোনার পর সিমোনোভিচের চোখ কপালে ওঠে! বিস্ময় নিয়ে তার উচ্চারণ, ‘তোমাদের গণতন্ত্র অনেক শক্তিশালী।’

মৃদু হাসি। জানতে চাই সার্বিয়ার অবস্থা। শুরু হলো ননস্টপ একটা লেকচার।

‘মুক্ত গণমাধ্যমের দেশ সার্বিয়া, যেখানে গণমাধ্যমের ভিত্তি বেশ শক্ত। যেমনটা রয়েছে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। জনগণ সব সময় প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবে। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা তৈরি করা যাবে না। টেলিভিশন, ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্রগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেমন রয়েছে, তেমনই বেসরকারি ব্যবস্থাপনাতেও মিডিয়া হাউজও পরিচালিত হয়।’

শহরের তাকোভসা এলাকায় আরটিএসের অফিস। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, টেলিভিশন ও বেতার- তিনটাকে একসঙ্গে করলে যা হয়, তেমনি আরটিএস। আরটিএস সরকারের হয়ে কাজ করে। যদিও এই সংস্থা নিয়ে রয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের চরম অসন্তুষ্টি।

আনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ মেলে। অন্যদিকে চলছে জোভাংকার প্রদর্শনী। আমি কয়টা ছবি তুলে এদিকে চলে আসি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের লেকচারের বদলে মিডিয়া নিয়ে গল্পগুজবে মন দিই।

‘উন্নয়নশীল দেশে মিডিয়ার অবস্থা নাজুক থাকে।’

‘সেটা কেমন?’

তাত্ত্বিক প্রশ্ন। সিমোনোভিচ সার্বিয়ান সরকারি গণমাধ্যমে কাজ করে। সরকারের বিপক্ষে কথা বলবে না, সেটাই হওয়া উচিত। তবে, পেশায় যেহেতু সাংবাদিক, তার উপস্থাপনা একজন রাজনীতিকের চেয়ে ভিন্ন হবে, এমনই আশা করি।

‘সার্বিয়াতে মিডিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত কোনো অনুমোদন লাগে না। ব্যবসায়িক একটা ট্রেড লাইসেন্স করলেই হলো। এসব লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছে একটি স্বাধীন সংস্থা- রিপাবলিক ব্রডকাস্টিং এজেন্সি (আরবিএ)। সংবিধান এই অধিকার দেয়। মিডিয়ায় কোনো সেন্সরশিপ নেই। চলচ্চিত্রে যা খুশি তা-ই দেখানো যায়। নির্মাতারা খেয়ালখুশিমতো কনটেন্টে চলচ্চিত্র, নাটক-গান রচনা করতে পারেন।’

তাজ্জব লাগে। আইন করে মিডিয়া-চলচ্চিত্রে সেন্সর না দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা ভাবা যায় না। যদিও শাসকগোষ্ঠী কতক্ষণ এমন আইনকানুনের ধার ধারেন, সেটাও বিতর্কের বিষয়। 

পাল্টা প্রশ্ন আমার, “কাগজে কলমে থাকা আর বাস্তবতা কি এক? বিশ্বের অনেক দেশের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সমালোচনা আছে সার্বিয়াতেও। মতপ্রকাশের অধিকার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন মহলের। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ‘প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স রিপোর্ট-২০১৯’ বলছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯০তম স্থানে রয়েছে সার্বিয়া।” তারা রিপোর্টে দেখিয়েছে, সার্বিয়াতে বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেট বা সাংবাদিকরা পক্ষপাতমূলক সম্পাদকীয় নীতির মুখোমুখি হচ্ছে হামেশাই। গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের নানাবিধ চাপও আছে।

হেসে দেয় সিমোনোভিচ। মাস্ক ততক্ষণে মুখ থেকে হাতে চলে এসেছে। চেহারায় লাবণ্য আছে যেমন, তেমনি ভারিক্কি দেহের গঠন, একটু মোটাসোটা। সেটা তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে বরং। সাদা চেহারায় সাদা দাঁতের হাসি। তার বর্ণনা এমন-

‘দেশটির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে বড়ো ভূমিকা ছিল মার্শাল টিটোর। সমালোচকরা তির ছুড়েন তাঁর দিকেই, স্বৈরাচারী শাসক আখ্যায়িত করে। তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি মহান গণতান্ত্রিক নেতা। তবে তাঁর কিছু সমালোচনাও আছে। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত সার্বিয়ান মিডিয়া একটু চাপে ছিল। নব্বই সালের পর থেকে নিয়ন্ত্রিত খোলস থেকে বের হয় মিডিয়া-জগৎ। সেই সময়ে, সরকার-সমর্থিত মিডিয়া ছিল দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে বড়ো হাতিয়ার। সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এ সময় স্বাধীন গণমাধ্যম সৃষ্টির পেছনে লেগে থাকেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে এখানে দুই পক্ষই সরব।’

মার্জিয়া সিমোনোভিচের বক্তব্যে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে ঠিকই, তবে খানিকটা পক্ষপাতিত্ব রয়ে যায় শাসকগোষ্ঠীর প্রতি। এক্কেবারে ঝেড়ে কেশে সরকারকে সমর্থন করেন- এমন অবশ্য নয়। তবে মিডিয়াতে সেন্সরশিপ না থাকার সুবিধাটাই আমার কাছে বড়ো সুযোগ বলে মনে হয়।

‘দেশটিতে তথ্য অধিকার, সম্প্রচার, জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অবাধ প্রবেশ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আইন রয়েছে। নির্বাচনের সময় কাভারেজ নিয়ন্ত্রণের জন্যও রয়েছে ভিন্ন আরেকটি আইন। পাবলিক ইনফরমেশন আইন সুস্পষ্টভাবে সাংবাদিকতার গোপনীয়তা রক্ষা করে। গুরুতর কোনো অভিযোগ ছাড়া ফৌজদারি বিধিতে সাংবাদিকদের আটকানো যায় না। আয়ের উৎস প্রকাশেও সাংবাদিকরা বাধ্য নন। শোনো, এখনকার আইনকানুন সব নাগরিকদের পক্ষে। তবে শাসকগোষ্ঠী চাইলে সেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তোমাকে আটকাতে পারবে।’

সিমোনেভিচ একপাক্ষিক বক্তব্য দেন না। তাকাই ওর দিকে। ভদ্রমহিলার বয়স কত হতে পারে? ৪৫-৪৬। ইউরোপের নানা বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।

‘মজার বিষয় জানো?’ আনা মার্জিয়া সিমোনোভিচের জিজ্ঞাসা।

‘ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আমরাই, সার্বিয়ান জনগণ বেশি টেলিভিশন দেখি।’

এই যুগে এসেও লোকজন টেলিভিশন দেখে?

সার্ব জনগণ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ঘণ্টা টেলিভিশন দেখে, যা ইউরোপের সর্বোচ্চ গড়। দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ লোকজন তথ্য, সংবাদ ও বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের ওপর নির্ভর করে। পত্রিকার ওপর ভরসা ১১ শতাংশের। অনএয়ারে আছে, এমন টেলিভিশন চ্যানেল সাতটি। ২৮টি আঞ্চলিক এবং ৭৪টি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। সার্বিয়াতে রেডিও স্টেশন আছে ২৪৭টি। এর মধ্যে জাতীয় কাভারেজ রয়েছে ছয়টি রেডিও স্টেশনের।

‘তুমি কী বলছিলে যেন? টিভিতে কাজ করতে? টিভি না পত্রিকা- কোন মাধ্যমের সাংবাদিকতা বেশি উপভোগ্য?’

পরিচয়ের প্রথমেই বলেছিলাম, গণমাধ্যমে কাজ করার ১০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা আমার। তাই তার জানতে চাওয়া। এ ছাড়া, দুজনেই সংবাদকর্মী বলে মিডিয়ার আলাপে এত মত্ত আমরা।

‘বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যা ১০৩টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলের সংখ্যা চারটি। ৪৫টি রয়েছে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেতার কেন্দ্র ১৪টি। সরকার অনুমোদিত বেসরকারি এফএম রেডিও ২২টি এবং কমিউনিটি রেডিও ১৮টি। আর, সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা হলো, ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে।’

কথা বলার ফাঁকে চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে গেল সে। আরটিএসের রিসিপশনের কাছে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো অনেকগুলো পত্রিকা। তার মধ্যে থেকে ভেসারঞ্জে নভোস্তি, ব্লিক, কুরির একটা করে কপি নিয়ে এল।

‘এখানে মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ কী?’

‘রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের একটা কৌশল সব সময় থাকে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন থেকে স্বল্প আয়ের কারণে মিডিয়াগুলো এখনো টিঁকে থাকার লড়াই করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর চাপ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে।’

‘ওই দিকের প্রদর্শনী তখনো চলছে। তুমি চাইলে জয়েন করতে পারো।’

তাকিয়ে দেখি। বিশাল একটা লেকচার চলছে। তার থেকে অন্তত মার্জিয়া সিমোনোভিচের সঙ্গে গল্প করাই ভালো। সে ডেকে নিয়ে যায়। ছোট্ট টেবিলে চারটি চেয়ার পাতা, মাঝের দুটি চেয়ার খালি রেখে বসি আমরা। কফি মেশিন থেকে দুটি কফি নিয়ে আসে। গল্প করি।

(চলবে...)

Leave a Reply

Your identity will not be published.