রিজিয়া রহমান: জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী

রিজিয়া রহমান: জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী

বাংলাদেশের শিকড় সন্ধানী কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। ১৬ আগস্ট তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন।

রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সেখানে কেটেছে শৈশব, কিশোরীবেলার কয়েকটি বছর। তবে তাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার বাবা আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা মরিয়াম বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী।

রিজিয়া রহমান পড়াশুনা করেছেন ফরিদপুরে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে এবং ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে। তিনি স্নাতকোত্তর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে।

কবিতা দিয়ে লেখালেখির সূচনা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় কলকাতার ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার ছোটদের পাতায় ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম লেখা। একটি কবিতা। পরে ওই পত্রিকায় আরও কয়েকটি লেখা ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ‘টারজান’ নামে একটি গল্প।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৬০ সালে আবার রিজিয়া রহমানের লেখা প্রকাশিত হয়, একটি গল্প, দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়। পরে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা একটি কবিতা। ১৯৬৭ সালে ‘লাল টিলার আকাশ’ নামে একটি গল্প লিখেন রিজিয়া রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। যদিও শুরুতে ম্যাগাজিনটির সম্পাদনা বোর্ড গল্পটি ছাপতে চায় নি অশ্লীলতার অভিযোগে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অনুরোধে তা প্রকাশ করেন।

রিজিয়া রহমানের প্রথম গ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এই গল্পগ্রন্থের শিরোনাম গল্পটি রিজিয়া লিখেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ঘিরে। পরে প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮), ‘চার দশকের গল্প’ (২০১১), ‘দূরে কোথাও’...। জীবন ও জগতের নানা বিষয় তাঁর গল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছে। শব্দ প্রয়োগের বিষয়েও তিনি শুরু থেকেই সচেতন ছিলেন ‘শরাব’ কিংবা ‘লাল পানি’ না লিখে তিনি ‘হুইস্কি’ই লিখতেন।

গল্প-উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর ভাষ্য ছিল, “এখন এই ২০১৫-তে এসেও আমি বঙ্কিমের ভাষায় উপন্যাস লিখতে পারি না। কিংবা শরতের মতো গল্পের ভাষা এখন কেউ লিখবে না। এটা মনে রাখতে হবে যে, লেখার ভাষাটা যাতে উন্নত ও সমসাময়িক হয়।”

নানা ধরনের এবং নান্দনিক দ্যুতিতে উদ্ভাসিত গল্প লিখলেও রিজিয়া রহমান সাধারণ পাঠকদের কাছে একজন ঔপন্যাসিক হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। শুরুতে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘বিকল্প’ নামে একটি উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন লিখেছিলেন। কিন্তু এটি শেষ করতে পারেন নি। পরে ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘরভাঙ্গা ঘর’ উপন্যাসটি। ১৯৭৪ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে দেখা যায় নদী ভাঙন বা মহাজনদের ঋণের কারণে একদল মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসে বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছে। বস্তির মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

রিজিয়া রহমানের লেখা উল্লেখযোগ্য অন্য সব উপন্যাস হলো— উত্তর পুরুষ (১৯৭৭), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮), বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০), সূর্য সবুজ রক্ত (১৯৮১), একাল চিরকাল (১৯৮৪), বাঘবন্দী (২০০৬), আবে রওয়াঁ (২০০৬), আলবুর্জের বাজ (২০১০)।

‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে রিজিয়া রহমান চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে আরাকান-রাজ সন্দ সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পতুর্গিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস।

‘রক্তের অক্ষর’ হলো নিষিদ্ধ পল্লির দেহপসারিণীদের মানবেতর দৈনন্দিন জীবনের আখ্যান। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় দেহপসারিণীদের নিয়ে লিখিত একটি প্রতিবেদন পড়ে রিজিয়া এই উপন্যাস লেখার প্রেরণা পান। পুরোনো ঢাকার অধুনালুপ্ত কান্দুপট্টির পতিতাদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে আমরা ইয়াসমিন নামের এক বীরাঙ্গনাকে দেখি—যে নাকি প্রতিবাদী ও সাহসী। শেষ পর্যন্ত সে নিহত হয়। হত্যাকারী ছুরির রক্ত মুছে ইয়াসমিনের পড়া একটি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে—সেখানে লেখা ছিল সেই অমর বাণী: ‘ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি বাট এভরিহোয়্যার হি চেইঞ্জড।’

রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’ (১৯৭৮) উপন্যাসটির আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু বেশ অভিনব। এখানে খণ্ড খণ্ড ঘটনা ও চিত্রের মাধ্যমে তিনি এদেশের মানুষের জাতিসত্তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পর্যন্ত উঠে এসেছে এখানে। হ্যাঁ এটা সত্যি যে সাহিত্যে এ ধরনের কাজ এদেশে নতুন হলেও ভারতে বহু আগেই এমন গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। যেমন রাহুল সাংকৃতায়নের ‘ভোলগা সে গঙ্গা’ এবং বনফুলের ‘স্থাপর’। এ দুটি গ্রন্থের স্টাইল থেকে রিজিয়া রহমান অনুপ্রাণিত হয়েছেন নিঃসন্দেহে কিন্তু বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে একেবারেই নয়।

‘অলিখিত উপাখ্যান’-এর উপজীব্য বিষয় হলো, নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাথা। এটি মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরির পাতা থেকে অনুপ্রাণিত। ...‘শিলায় শিলায় আগুন’ ১৯৫৮ সালের বেলুচিস্তান বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত।...‘সূর্য সবুজ রক্ত’ উপন্যাসে রিজিয়া তুলে এনেছেন এই অঞ্চলে চা-শ্রমিকদের আগমন, ইংরেজ এবং পরবর্তী সময়ে এদেশের চা-বাগান মালিকদের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের ইতিবৃত্ত। মোদ্দা কথা হলো, এই উপন্যাস পাঠে পাঠক হিসেবে এই উপলব্ধিতে পৌঁছি—আমরা এক কাপ সবুজ পানীয় নয়—চা-শ্রমিকদের রক্ত পান করি। ‘একাল চিরকাল’ উপন্যাসটি হলো বড় পুকুরিয়ায় রিজিয়ার সাঁওতালদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণের ফসল। শিকারি থেকে কীভাবে সাঁওতালরা কৃষক এবং পরে শ্রমজীবী হয়ে ওঠে— তাদের এই বদলে যাওয়া জীবনই রিজিয়া তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। অন্যদিকে ‘বাঘবন্দি’ উপন্যাসে রিজিয়া তুলে ধরেছেন বঞ্চনা থেকে মুক্তির আবশ্যকতা। আর ‘আবে রওয়াঁ’ উপন্যাস অতীত ঢাকার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আখ্যান এবং ‘আলবুর্জের বাজ’-এ জঙ্গিবাদের মর্মকথাটি ফুটে উঠেছে অত্যন্ত চমৎকারভাবে।

সংখ্যায় অল্প হলেও শিশুদের জন্যও কয়েকটি চমৎকার বই লিখেছেন রিজিয়া রহমান। এগুলো হলো ‘আজব ঘড়ির দেশে’, ‘ঝিলিমিলি তারা’, ‘মতিলালের বাড়ি ও অন্যান্য গল্প।’

‘অভিবাসী আমি’, ‘নদী নিরবধি’ ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’— রিজিয়া রহমানের এইসব আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। এইসব গ্রন্থে মূর্ত হয়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের শৈশব-কৈশোর এবং লেখক-জীবন। ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপনও। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, সময়। এক জীবনে, নানা সময়ে নানা কিছু দেখেছেন রিজিয়া রহমান। সেই সময়কেই এই গ্রন্থ ত্রয়ীতে তিনি তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে রিজিয়া রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেছিলেন, “আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান ভাগ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এইসব আমি দেখেছি। ওই সময়টা আমাদের সমাজ, সাহিত্য এবং রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়। তাই আমি ওই সময় নিয়ে লিখেছি। বলা যায় যে, ওই সময়টাকে ধরে রাখার জন্যই স্মৃতিকথা লিখছি।”

সাহিত্যের অনুবাদেও সৃজনীলতার সাক্ষর রেখেছেন রিজিয়া। তাঁর এই অনুবাদকর্মটি হলো ‘সোনালী বারুদ’। এটি প্রখ্যাত মালয়েশিয়ান লেখক শাহনুন আহমেদের একটি উপন্যাসের অনুবাদ।

বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রিজিয়া রহমান পেয়েছেন বহু পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৮), হুমায়ূন কাদির সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৮৫), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) এবং এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮)।

জনসমক্ষে সর্বশেষ বক্তব্য রেখেছিলেন রিজিয়া রহমান গত ১২ নভেম্বর ২০১৮-তে। সেদিন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ গ্রহণ করার পরে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে রিজিয়া রহমান জানিয়েছিলেন, পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর জন্য সম্মানের ও গর্বের। দুঃখের ও বেদনারও। কারণ হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাঁর স্মৃতি হয়ে যাওয়ার কথা আর হুমায়ূন আহমেদের থেকে যাওয়ার কথা। উল্লেখ্য, ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রাপ্তির সংবাদ জানানো এবং এ পুরস্কার গ্রহণে তাঁর সম্মতি আছে কি না— এ বিষয়ে অবগত হওয়ার জন্য অন্যদিন-এর সম্পাদকম-লীর সদস্যরা ২০১৮ সালের নভেম্বরের প্রথম পর্যায়ে গিয়েছিলেন রিজিয়া রহমানের উত্তরাস্থ বাসভবনে। তখন অন্যদিন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে যে, রিজিয়া রহমান একুশে পদক পান নি। তখনই অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম  টেলিফোনে বিষয়টি অবগত করেন তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ বিতরণী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘রিজিয়া রহমানের মতো লেখকের একুশে পদক না-পাওয়া আমাদের জন্য লজ্জার। ভবিষ্যতে আমরা সেই লজ্জা মোচনের চেষ্টা করব।’ হ্যাঁ, লজ্জা মোচন হয়েছে। ২০১৯ সালে রিজিয়া রহমান লাভ করেছেন একুশে পদক।

সবশেষে রিজিয়া রহমান সম্পর্কে বলা যায়, তিনি সেই বিরল গোত্রের কথাসাহিত্যিকদের একজন যিনি এদেশের মাটি ও মানুষের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প তাঁর অন্বিষ্ট ছিল না। অর্থের কাছেও নিজের লেখকসত্তাকে বিকিয়ে দেন নি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.