গোলাম মোস্তফা কবি ও সাহিত্যিক। গদ্য ও পদ্য, দু’ধরনের রচনাতেই পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু প্রধানত ইসলাম ও প্রেম। কবিতার ভাষা সুললিত ও ছন্দ গতিশীল। বহু ইসলামি গানের রচয়িতা। গদ্য রচনার মধ্যে রাসুলুল্লা’র (সা.) জীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’ (১৯৪২) বহুল সমাদৃত। লিখেছেন মোমিন রহমান।
আবার আমরা পথে নেমেছি। আবার এদেশের সোনালি অতীতের আলোকিত মানুষদের শেকড় সন্ধানে ছুটে চলেছি।...আমাদের এবারের যাত্রায় সেই আলোকিত মানুষটি হলেন কবি গোলাম মোস্তফা। যিনি জন্মেছিলেন ঝিনাইদহ জেলার মনোহরপুর গ্রামে।
ঢাকা থেকে আমরা এসেছি ঝিনাইদহ শহরে। এখানকার কবি গোলাম মোস্তফা সড়কের অদূরের ভ্যানস্ট্যান্ড থেকে একটি ভ্যানে চড়ে বসলাম আমরা অর্থাৎ আমি ও অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকার।
ভ্যানগাড়ি ছুটে চলেছে। চারপাশে খোলা প্রান্তর। ধানখেত। হাওর। হাওরে ফুটে রয়েছে সাদা শাপলা। ঝিনাইদহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে অসাধারণ তা বোঝাই যাচ্ছে। ইতিহাসমনস্ক আমার মনে পড়ে গেল যে, ঝিনাইদহের নামকরণ নিয়ে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায়, ঝিনাইদহ নাকি ছিল মণিমুক্তার দেশ। এখানকার নবগঙ্গা নদীতে তৎকালে প্রচুর পরিমাণে ঝিনুক পাওয়া যেত। সেই থেকেই হয়তো ‘ঝিনাইদহ’ নামটির উৎপত্তি। ইতিহাস আরও বলে, ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত ঝিনাইদহ শহর ছিল মাহমুদশাহী পরগনার তহসিল কাছারি। শহরটি একসময় ওয়ারেন হেস্টিংস-এর পুলিশ প্রশাসনের অধীনে ছিল। ১৮৬২ সালে এটি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। তখন এটি যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। নিকট অতীতে ঝিনাইদহ স্বয়ং জেলায় পরিণত হয়।
আধঘণ্টা চলার পর ভ্যানগাড়ি থামল। জায়গাটির নাম শৈলকুপা। এই নামে একটি থানাও আমরা দেখতে পেলাম চোখের সমুখে। এখানকার আশেপাশে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে আমাদের চোখে পড়ল—লাল ইটের তৈরি দোতলা একটি দালান। শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। একসময় এটি ‘শৈলকুপা হাইস্কুল’ নামে পরিচিত ছিল। এই স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন কবি গোলাম মোস্তফা।
কিন্তু কবি গোলাম মোস্তফা জন্মেছেন কোথায় ? কোথায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি ? হ্যাঁ, এই শৈলকুপায় অবস্থিত মনোহরপুর গ্রামে এক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে গোলাম মোস্তফার জন্ম। জন্মদিনটি ছিল ৭ পৌষ, রোববার। জন্মসালটি খুব সম্ভবত ১৮৯৫। যদিও শৈলকুপা হাইস্কুলে গোলাম মোস্তফাকে ভর্তি করানোর সময় তাঁর আব্বা বয়স প্রায় বছর দুই কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সবাই জানে গোলাম মোস্তফার জন্ম ১৮৯৭ সালে।
আমরা এখানে এসেছি গোলাম মোস্তফার জন্মস্থান মনোহরপুরের টানে। কাজেই চলো মন মনোহরপুরে। মন তো চোখের পলকেই কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছে যায়। কিন্তু আমাদের এই রক্তমাংসের তৈরি স্থূল দেহের তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দু’পায়ে হেঁটে মনোহরপুর যেতে সময় লাগবে। ওখানে ভ্যানগাড়িও চলাচল করে না। একমাত্র বাহন হলো রিকশা। কাজেই একটি রিকশা ঠিক করলাম আমরা—যেটি আমাদের নিয়ে যাবে মনোহরপুরে।
রিকশায় চড়ে মনোহরপুরে যাচ্ছি আমরা। গ্রামের মেঠোপথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে সামনে এগোচ্ছি। কিছুটা অসুবিধা তো হচ্ছেই, কিন্তু আমাদের চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি সব কষ্ট আমাদের ভুলিয়ে দিচ্ছে।...আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনই যেখানে মুগ্ধ হচ্ছে, সেখানে গোলাম মোস্তফার কবি-হৃদয় তো অবশ্যই আবেগে আপ্লুত হতো। হ্যাঁ, শৈলকুপার প্রকৃতিই গোলাম মোস্তফাকে কবি করে তুলেছিল, এখানকার গ্রামীণ আবেষ্টনী ও নিসর্গ-শোভা কিশোর গোলাম মোস্তফার রোমান্টিক মানস-প্রবণতা ও আবেগ-অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯১১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি জনৈক ছাত্র-বন্ধুকে চিঠি লিখেন—কবিতায়। সেটিই তাঁর প্রথম রচিত কবিতা। তবে ১৯১৩ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ কবিতাটিই তাঁকে পাদ-প্রদীপের আলোর সামনে তুলে ধরে।
এক সময় রিকশা থামে মনোহরপুরে কবি, গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনে প্রচুর খোলা জায়গা। মাঝে মাঝে আম-জামরুলসহ নানা ধরনের গাছ। এই বৃক্ষের আবেষ্টনীর মধ্যে টিনের একটি ঘর। ঘরটির চারপাশে উন্মুক্ত বারান্দা। পাকা মেঝে। পরে আমরা জানতে পারি যে, এই ঘরটিই ছিল কবি গোলাম মোস্তফার বৈঠকখানা। এখানে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। কখনো কখনো গানের আসরও বসত। ‘বাংলার কোকিল’ বলে খ্যাত কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিনও এখানে গান গেয়েছেন। এই সূত্রে আমাদের মনে পড়ে যায়, গোলাম মোস্তফা একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞও ছিলেন। গান লিখেছেন, গানে সুর দিয়েছেন। তাছাড়া ‘বাদশা তুমি দীন ও দুনিয়ার’, ‘হে খোদা দয়াময় রহমানুর রহিম’, ‘নিখিলের চির-সুন্দর সৃষ্টি, আমার মুহাম্মদ রসুল’ ইত্যাদি ইসলামি গান আজও আমাদের মনে আবেদন সৃষ্টি করে। বিশেষত আরবি কিয়ামের (ইয়া নবি সালাম আলাইকা/ ইয়া রসুল সালাম আলাইকা) ছন্দ ও সুরে গোলাম মোস্তফা রচিত বাংলা কিয়াম পবিত্র মিলাদ শরিফে ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয় : ‘তুমি যে নুরের-ই-রবি/ নিখিলের ধ্যানের ছবি/ তুমি না এলে দুনিয়ায়/ আঁধারে ডুবিত সবই’।
বৈঠকখানা থেকে কিছুটা দূরে মূল বাড়ি। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পর দেখা গেল, বিরাট একটি উঠোনের চারদিকে টিনের তৈরি কয়েকটি ঘর।...আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন গোলাম মোস্তফার মেজ ভাইয়ের (মুন্সী গোলাম কাওসার) ছেলে মুন্সী শওকত আলী ওরফে মুকুল। মধ্যবয়সী এই মানুষটিই বর্তমানে গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে তিনি বসবাসও করছেন।
কুশলাদি বিনিময়ের পর মুন্সী শওকত আলী সাহেব আমাদের একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটিতে ঢুকে আমরা লক্ষ করলাম, একপাশে জানালার ধারে গোলাম মোস্তফার ব্যবহৃত খাট রক্ষিত রয়েছে। পাশেই তাঁর ব্যবহৃত একটি টেবিল। বাঁশের তৈরি ঘরের সিলিংয়ে টিনের তৈরি বোর্ডে লেখা রয়েছে গোলাম মোস্তফা রচিত কবিতা-গানের পঙ্ক্তিমালা। দু’পাশের দেয়ালে টাঙানো নানা আলোকচিত্র ও ছবি। এইসব আলোকচিত্র ও ছবিতে যেমন রয়েছেন গোলাম মোস্তফা স্বয়ং তেমনি রয়েছেন তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সেকালের সুপরিচিত মানুষজন। যেমন কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাস উদ্দিন...। একটি আলোকচিত্রে দেখা গেল, গোলাম মোস্তফার কোলে এক বছরের একটি শিশু। চোখ ও মুখের গড়ন দেখে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। মুন্সী শওকত আলী জানালেন যে, শিশুটি হলো এখনকার প্রখ্যাত অভিনেত্রী, নির্মাতা ও উপস্থাপিকা নিমা রহমান। উল্লেখ্য, নিমা রহমান হলেন গোলাম মোস্তফার নাতনি মেজ মেয়ে হাসিনা রহমান হাসনার মেয়ে।... শিশুকোলে গোলাম মোস্তফার আলোকচিত্র দেখে মনে পড়ল যে, একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর সময়ে গোলাম মোস্তফা ছিলেন সুপরিচিত, বিশেষত কিশোদের উপযোগী কবিতা রচনায় তিনি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। যেমন তার রচিত অবিস্মরণীয় ‘কিশোরদের’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি প্রবাদে পরিণত হয়েছে : ‘আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল-বন নন্দনে/ ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।... ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’।
ঘরের আরেক পাশের দেয়ালে টাঙানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড। এখানে লেখা রয়েছে গোলাম মোস্তফার জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে নানা তথ্য। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, গোলাম মোস্তফার পিতা কাজী গোলাম রব্বানী, মা মোছাঃ শরীফা খাতুন, পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার। আর আমরা তো জানিই যে, গোলাম মোস্তফার পিতা ও পিতামহ—দুজনে শুধু শিক্ষিতই ছিলেন না, কাব্যচর্চার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। বলা যায়, গোলাম মোস্তফা পারিবারিক ও ঐতিহ্যিক সূত্রেই সাহিত্যচর্চার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, অনেকটা উত্তরাধিকারও অর্জন করেছিলেন।... কালো বোর্ডে আমরা আরও দেখতে পাই যে, গোলাম মোস্তফার প্রাথমিক শিক্ষা দামুকদিয়া ও ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালায়। ১৯১৩ সালে শৈলকুপা হাইস্কুল থেকে মেট্রিক, ১৯১৬ সালে দৌলতপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রিও লাভ করেন।... তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ভারতের ব্যারাকপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। এরপরে পর্যায়ক্রমে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুল, কলকাতা মাদ্রাসা, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট ডিমনস্ট্রেশন হাই স্কুল, হুগলী কলেজিয়েট স্কুল, বাঁকুড়া জেলা স্কুল ও ফরিদপুর জেলা স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৫০ সালে এই স্কুল থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।... কবিতা দিয়ে সাহিত্যচর্চার শুরু। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’ (১৯২৪), তবে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ উপন্যাস ‘রূপের নেশা’ (১৯১৯)। তিনি সব ধরনের লেখাই লিখেছেন। এমনকি গান ও পাঠ্যপুস্তকেরও রচয়িতা তিনি। ‘বিশ্বনবী’ তাঁর অমর গ্রন্থ। বলা যায়, মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যে ইসলামি কৃষ্টির রূপায়ণে মগ্ন ছিলেন গোলাম মোস্তফা।
কালো বোর্ডে আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি গোলাম মোস্তফার সন্তানদের পরিচিতি। বড় ছেলে মোস্তফা আনোয়ার—ভারত-পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ বৈমানিক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে করাচি বিমানবন্দরে এক শোচনীয় বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মেজ ছেলে মোস্তফা আজিজ। চিত্রশিল্পী। এদেশের প্রথম পেনসিল স্কেচের শিল্পী। ১৯৯৩ সালে তার মৃত্যু হয়। সেজ ছেলে মোস্তফা মনোয়ারকে তো সবাই চেনে। তিনি একজন চিত্রশিল্পী, সাবেক টেলিভিশন প্রযোজক, নাটক নির্মাতা, পাপেট শিল্পী। ছোট ছেলে মোস্তফা ফারুক পাশা। বিশিষ্ট পিয়ানোবাদক। বর্তমানে পোল্যান্ডে রয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি লাভ করেন আন্তর্জাতিক পোলিশ পদক। বড় মেয়ে ফিরোজা খাতুন। কবি গোলাম মোস্তফা উচ্চবিদ্যালয়, মনিমুকুর বিদ্যালয় ও হিন্দোল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা। মেজ মেয়ে মিসেস হাসিনা রহমান হাসনা। ১৯৮৫ সালের ১৪ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ছোট মেয়ে রাশিদা হক হেনা। সুগৃহিণী। জাতীয় স্মৃতিসৌধের ডিজাইনার সৈয়দ মঈনুল হাসানের মা।
গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ির যে টিনের ঘরে আমরা অবস্থান করছি—এর চারপাশের সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে যে, এ যেন এক মিনি জাদুঘর। এখানে এলে যে-কেউ কবি গোলাম মোস্তফা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করতে পারবেন। এই ঘরে রক্ষিত দ্রব্যসামগ্রীর যে যত্ন নেয়া হয়—তারও ছাপ বিদ্যমান।
মুন্সী শওকত আলী ওরফে মুকুল সাহেবের আতিথেয়তার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের এক পর্যায়ে। তারপর আমরা তার সঙ্গে বের হই গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্যে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা লক্ষ করি, বাড়ির চারদিকে শুধু উন্মুক্ত জমিই নেই, জমির ওপরে রয়েছে নানা ধরনের গাছ—আম, লিচু, জামরুল ইত্যাদি। মুকুল সাহেবের সূত্রে জানা গেল, কবি গোলাম মোস্তফার লাগানো একটি আম গাছের কথা। কাঁচা-মিঠে আমের জন্যে গাছটি নাকি এলাকায় বিখ্যাত। এই কথার প্রমাণ আমরা পেলাম কিছুক্ষণ পরেই। মুকুল সাহেবের ছোট মেয়ে প্লেটে করে আমাদের জন্যে কাঁচা আমের কয়েকটি টুকরো নিয়ে এলো। জানা গেল, এই আম কবি গোলাম মোস্তফা রোপিত গাছের আম।... প্লেট থেকে আমের একটি টুকরো মুখে দেওয়ার পর টের পেলাম অম্ল-মধুর স্বাদে মুখটি ভরে যাচ্ছে। টক আর মিষ্টির এমন অদ্ভুত ভারসাম্য বহু বছর অনুভব করি নি।
আমরা জানি যে, গোলাম মোস্তফার পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত পাংশা থানার অধীন নিবে-কৃষ্ণপুর। সেখান থেকে এক পর্যায়ে মোস্তফা সাহেবের পূর্বপুরুষেরা চলে আসেন ঝিনাইদহের মনোহরপুরে। এখানে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন।...গোলাম মোস্তফা রাজধানী ঢাকায় বসবাস করতেন। তবে জন্মভূমি মনোহরপুরের আকর্ষণ তাঁর কাছে বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নি। প্রায় প্রতি বছরই তিনি স্বগ্রামে গমন করে সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় কিছু সময় কাটাতেন। বিভাগ-পূর্বকালে তিনি প্রায় ছয় বছর স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত থেকে নানা ধরনের গ্রামীণ সমস্যা সমাধানের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।
গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ির কিছুটা সামনে মনোহরপুর জামে মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে ১৮৯৯ সালে। এই মসজিদটিতে বালক থেকে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত গোলাম মোস্তফার যাতায়াত ছিল। তিনি জীবনের নানা পর্যায়ে কতবার যে এখানে নামাজ পড়েছেন তার কোনো হিসাব দেওয়া যাবে না।...কাজেই মনোহরপুরে এলে মোস্তফা-অনুরাগীদের উচিত অবশ্যই এই মসজিদে যাওয়া এবং সম্ভব হলে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া।
গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়িকে ডানে রেখে কিছুদূর অগ্রসর হতেই চোখের সামনে দেখতে পেলাম—কুমার নদী বয়ে চলেছে। এই নদীও কবি গোলাম মোস্তফার বিভিন্ন কীর্তি-কলাপের সাক্ষী। কখনো কখনো হয়তো এই নদীই গোলাম মোস্তফার কবি-সত্তাকে জাগ্রত করেছে। তাঁর কলম থেকে বের হয়েছে কবিতার নানা পঙ্ক্তিমালা।
নদীর সঙ্গে মানুষের জীবনের বেশ মিল রয়েছে। নদীর জোয়ার-ভাটার মতোই মানুষের উত্থান-পতন, নদীর বাঁক-পরিবর্তনের মতোই মানুষের জীবনের পরিবর্তন। কুমার নদীর দিকে চেয়ে আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় গান শুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলাম—‘ও নদীরে/ একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে/বলো, কোথায় তোমার দেশ/ তোমার নেই কো অবশেষ।’... নদী যেমন সাগরে গিয়ে মেশে, মানুষও তেমনি কালের বুকে চিহ্ন রেখে হারিয়ে যায় অসীমে। কবি গোলাম মোস্তফাও কালস্রোতে অক্ষয় চিহ্ন রেখে আকস্মিকভাবে সেরিব্রাল থ্রমবসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর রাত এগারোটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১নং কেবিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এই মনোহরপুরে, এই পৃথিবীতে, কবি গোলাম মোস্তফার পায়ের চিহ্ন আর পড়ে না, তবু এদেশের- মানুষের হৃদয়ে আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর স্থায়ী আসন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.