গোপন ভালোবাসা

গোপন ভালোবাসা

সব মানুষের জীবনে কালো অধ্যায় থাকে। সেরকম একটা গল্প আমি আজ আপনাদের বলব। শুনেছি নিজের জন্মে কারও হাত থাকে না। তবে কর্মে থাকে। গল্পটা বলার পর হয়তো আমার শরীরটা রেললাইনে পাওয়া যাবে। অনেক চেষ্টা করেও বহুদিন কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না এটা আত্মহত্যা নাকি নিছক দুর্ঘটনা। তারপর সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে। শুধু মুছে যাবে পরশ নামে কেউ পৃথিবীতে ছিল।

আমার বাবা চল্লিশ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এরকম পাষাণ মানুষ পুরো এলাকায় আর একটিও নেই! অবাক ব্যাপার হলো, তারপরেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিবার তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। বর্বরতার একটা উদাহরণ দিলে আপনাদের বিষয়টা বুঝতে একটু সহজ হবে।

আমার বয়স তখন মাত্র সাত। একবার খুব ইচ্ছে হলো লাল রঙের একটা সাইকেল কিনব। বাবাকে বলার মতো সাহস ছিল না আমার। মাকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুরোধ করছি। বিশেষ সুবিধা করতে পারছি না। অবশেষে একদিন নিজের রুম আটকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলাম। মায়ের মন বলে কথা। কাজ হয়ে গেল, আমার অবস্থা দেখে মা অবশেষে রাজি হলেন। মহসিন কাকাকে দিয়ে নতুন একটা লাল রেন্জার সাইকেল কিনে আনালেন। ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হতো বেলটার। সামনে একটি আর পেছনে দুটি লাইট। সুইচে চাপ দিলেই হ্যাজাকের মতো জ্বলতে শুরু করে। আমি মহাখুশি।

 

আনন্দে কান্না শুরু করলাম। অনবরত চিৎকার করছি, মা মা মা লক্ষ্মী মা, তুমি কত ভালো মা, তুমি কত ভালো! এই জগতে তোমার মতো আর কেউ কেন ভালোবাসে না বলতে পারো ?

মা বললেন, অনেক হইছে। এখন আয় ভাত খা, খেয়ে মাকে উদ্ধার কর।

গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। সাইকেলের বিষয়টা শুনে হঠাৎ যেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। মাকে বেধড়ক পিটুনি শুরু করলেন।

মাগি, চুরি শুরু করছিস! এই টাকা তোর কোন ভাতারে জোগাইছে ? নাকি কারও সাথে শুইছিস ?

বাবা চুলের মুঠি ধরে মাকে টানতে টানতে নিজের কামরায় নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, তারপর আবার পিটুনি শুরু। দরজার ফুটো দিয়ে দেখলাম, মায়ের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।

জোরে জোরে দরজা ধাক্কানো শুরু করলাম আমি।

দরজা খোলো বাবা, আমার সাইকেল লাগবে না। সাইকেল লাগবে না বাবা। দয়া করে দরজাটা খোলো বাবা, বাবা...বাবা!

বাবা বের হয়ে এলেন। তার পুরো শরীর ঘর্মাক্ত। ততক্ষণে তার মদের নেশা চলে গেছে। চোখ টকটকে লাল। মায়ের ঘরটায় তালা দিয়ে হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির আঙিনায়। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।

সাইকেলটা পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিলেন বাবা। আমার ভেতরটা যেন জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল, মুখ দিয়ে তবু একটাও শব্দ করলাম না। মনে হলো আর যাই হোক এই লোক আমার বাপ না। সারা রাত সেখানেই বসে থাকলাম। বাবা বাগানবাড়িতে গিয়ে আবারও নেশায় বুঁদ হলেন। সেখানে আমাদের যাওয়া নিষেধ।

ভোরবেলা একটা বটি নিয়ে গেলাম মায়ের রুমের সামনে। তালা ভাঙলাম। দেখলাম মা আমার শাড়িতে ঝুলছে! টুকটুকে লাল শাড়ি, শরীরটা একদম ধবধবে সাদা। রক্তগুলো টিপের মতো কপালে জমাট বাঁধা। চুপচাপ বসে থাকলাম সেখানে। কত সময় ঠিক মনে নেই। অনেক লোক জড়ো হয়েছিল সেদিন।

দুপুরবেলা পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। খয়েরি পোশাকের কিছু মানুষ মায়ের শরীরটাও সাদা কাপড়ে ঢেকে এম্বুলেন্স করে নিয়ে গেলেন। তিন দিন পর মাকে কবর দেওয়া হলো পাশের বাঁশঝাড়টায়। প্রতিরাতে জোছনার আলো যখন এসে পড়ে মায়ের কবরে, আমি একা দাঁড়িয়ে তখন মাকে ডাকতে থাকি—মা মা মা, তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে মা ? আমার সাইকেল লাগবে না। তবুও তুমি ফিরে এসো।

জোছনার আলো ম্লান হয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ছায়া পড়ে মায়ের কবরে। কবরটা তখন ফুলের সুরভিতে ভরে ওঠে। একসময় মহসিন কাকা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যান। বলেন, খোকা, তোকে কতবার বলছি—রাতের বেলা একা একা এখানে আসবি না।

আমাদের ফাঁকা বাসাটায় আর কেউই আসে না। আগের সেই লোকজনের কোলাহল একদম নেই। শুধু আমি আর মহসিন কাকা।

বাবাকে দেখতে যাবি খোকা ?

না। আর কোনোদিন আমি তাকে দেখতে চাই না।

এভাবে বলতে নেই খোকা। তোর বাবার তো সেদিন নেশার ঘোরে হুঁশ ছিল না। ক্ষমা করে দে। চল যাই একবার।

আমি আর কথা বলি না। চুপ করে থাকি। আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে। মুখ ফুলে যায়। ঘর থেকে বের হই না। একমুহূর্তের জন্যেও কোথাও যাই না।

মা যদি আবার ফিরে আসে! আমি জানি, তিনি ফিরে আসবেন। তাকে আসতেই হবে।

 

ছয় মাস পেরিয়ে গেল। চূড়ান্ত রায়ের আগে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোর্টের এজলাসে। মহসিন কাকা আগেই বলে দিয়েছেন, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমি কিছু জানি না। সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আমি তাকে কিছুই বলি না। কেবল চুপ থাকি। আমার মনে জমা তীব্র অভিমান। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বাবা পরশ, সেদিন রাতে তুমি কোথায় ছিলে ? তোমার মাকে শেষ কখন দেখেছিলে ? তোমার কি কিছু মনে পড়ছে ?

আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকলাম।

বাবার উকিল বারবার জজ’কে বলছেন, ছেলেমানুষ স্যার। তার কী করে মনে থাকবে ? সে তো তখন গভীর ঘুমে।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে একদলা থুতু ফেললাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, আমার মাকে উনি মেরে ফেলেছেন। দয়া করে তাকে বলুন, আমি মায়ের কাছে যাব। আমি মায়ের কাছে যাব। মা মা, তুমি কোথায় ? মা মা মা...

আমি জ্ঞান হারালাম।

মাসখানেক পর বাবার ফাঁসির আদেশ হলো। শুনলাম তিনি নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মহসিন কাকাকে দেখলেই কাঁদেন। বলেন, পরশকে দেখে রাখিস ভাই। বড় হলে বলিস আমি তাকে খুব ভালোবাসি।

বাবার সাথে কোর্টের এজলাসেই ছিল আমার শেষ দেখা। একদিন খুব ভোরে তাকে নিয়ে আসা হলো বাড়ির আঙিনায়। তিনি খাটিয়ায় শুয়ে আছেন। একফোঁটাও কান্না পেল না আমার। আমি দৌড়ে মায়ের কবরটার কাছে দাঁড়ালাম।

মা মা ওঠো, দেখো আল্লাহ তোমার কাছে কী উপহার পাঠিয়েছেন।

ফাঁসির আগে বাবা তার সম্পত্তি আমার নামে উইল করে গেছেন। মহসিন কাকাকে দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মহসিন কাকা বিয়ে করেন নি। আমাকে নিয়ে তিনি প্রতিদিন স্কুলে যান। বারবার বলেন, পরশ মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। স্কুলে শিক্ষক যা বলে, সেভাবেই চলবি।

স্কুল শেষে কাকার সাইকেলে বাড়ি ফিরি। আমাদের তিনবেলার খাবার তিনি নিজেই তৈরি করেন। বাবার জমানো টাকায় কোনোদিন হাত দেন নি। নিজেই টিউশনি করে সংসারের খরচ চালান। তিনি বাবার ফুপাত ভাই। ছোটবেলায় তার বাবা-মা মারা যান। আমার দাদা তখন তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাবা আর মহসিন কাকা বন্ধুর মতো মানুষ হয়েছেন। দুজন বিপরীত চরিত্রের মানুষ কীভাবে এত গভীর বন্ধুত্বে জড়ায়, এটা আমার ঠিক মাথায় আসে না।

 

আজ আমার অনার্স ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। মহসিন কাকা বাসায় মিলাদের আয়োজন করেছেন। এতিম বাচ্চাদের খাওয়ানো হবে। পোলাও, বুটের ডাল, গরুর মাংস, ডিম সেদ্ধ আর মুরগির রোস্ট। ছেলেগুলোকে তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করছেন। সবাইকে খাবার দিতে দিতে বলছেন, পেটভরে খারে বেটা। পরশের রেজাল্ট ভালো হলে আবার খাওয়া পাবি সবাই। 

সন্ধ্যায় ফোন এল আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। আমার চেয়ে মহসিন কাকা বেশি খুশি। মাইকিং করে পুরো এলাকায় জানানো হলো—পরদিন গ্রামের সবার দাওয়াত। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন।

মহসিন কাকা আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন মায়ের কবরে। তার পাশেই বাবা শুয়ে আছেন। বাবাকে উদ্দেশ করে কাকা বললেন, ভাইজান, আপনার ছেলে পুরো গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদের বংশে সে-ই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। একদিন সে বড় ব্যারিস্টার হবে, ইনশাআল্লাহ।...তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমি তাকে ধরে বাসায় নিয়ে এলাম।

পরদিন দুপুরে দাওয়াত শেষে আমাকে নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশে রওনা করলেন মহসিন কাকা। পথে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে বললেন, আজ থেকে তোর নতুন যাত্রা শুরু। এখন থেকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে। তোর সামনে ভালো-খারাপ সব পথই খোলা থাকবে। বর্ণিল পৃথিবীর সব দুয়ার একে একে খুলতে থাকবে। কিন্তু কোন দরজাটা তোর জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে, তোকেই সেটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আল্লাহ ভরসা।

ট্রেনে উঠতেই মাথায় হাত দিয়ে সূরা পড়ে দোয়া করলেন কাকা। তারপর একটা পুরোনো খাম বের করলেন। বললেন, যেতে যেতে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বি এটা। তোর বাবা জেলে বসে লিখে রেখে গেছেন। আমাকে বলেছেন, তুই যেদিন সব বোঝার মতো সাহস অর্জন করবি, সেদিন যেন আমি তোর হাতে এটা দেই। আমার মনে হয়, আজই সেই দিন। 

ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে, মহসিন কাকা হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। এই লোকটাই ছোটবেলা থেকে আমার সবকিছু। আমার কাছে পিতা-মাতা বলতে তিনিই সব। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছিল। জীবনে এই প্রথম তার জন্যে কেমন একটা তীব্র মায়া বোধ করলাম। খুব অস্থির লাগছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল সেদিন।

ট্রেনের জানালা দিয়ে বেশ কিছু সময় বাইরের সবুজ পরিবেশটা দেখলাম। ঝিকঝিক শব্দটা নেশার মতো লাগছিল। হঠাৎ একজন এসে জানাল আমার কিছু লাগবে কি না। মহসিন কাকা তাকে আমার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। জানালেন, কিছুক্ষণ পর তিনি আবারও আসবেন। তখনই হঠাৎ খামটার কথা মনে হলো। আস্তে আস্তে সেটা খুললাম।

অনেক বছর পর বাবার হাতের ছোঁয়া পেলাম। কিছুক্ষণ লেখাগুলোর দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলাম। হাত দিয়ে বাবার স্পর্শ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের পানি চিঠির ওপর পড়তেই খেয়াল হলো ভিজে যেতে পারে। দ্রুতই চোখের জল মুছলাম।

বাবা পরশ,

এখন তুমি বড় হয়েছ। পৃথিবীর ভালো-মন্দ নিশ্চয়ই বুঝতে শিখেছ। জেলখানার এই বদ্ধ ঘরটায় বসে প্রতিদিন ভাবি, আগামীকাল হয়তো তুমি একবার আমায় দেখতে আসবে। পরদিন যখন দেখি তুমি নেই, তখন তোমার মায়ের ঘরে তালা দিয়ে আসার সেইদিনের স্মৃতিটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। মনটা শান্ত হয়। বুঝতে পারি, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। সেইদিনের পাপের শাস্তি আমাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আমিও সেটা মেনে নিয়েছি। উকিলকে বলে নিজের শাস্তি স্বীকার করে তোমাকেও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছি। কারণ আমি জানি, এই জীবনে আমার সামনাসামনি হওয়া মানেই সেই দুঃসহ স্মৃতিটা বারবার তোমার সামনে নিয়ে আসা। এর থেকে আমার চলে যাওয়াটাই ভালো।

ছোটবেলা থেকে আমি ও মহসিন একসাথে বড় হয়েছি। পড়াশুনায় সে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। আমাদের আমলে এই এলাকায় সেই একমাত্র বিকম পাস। চাইলেই সে যে-কোনো বড় চাকুরি করে সংসার করতে পারত। কিন্তু আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় নি সে। আমরা তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। তোমার মা প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমি সারা দিন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। মহসিন কলেজের সাহিত্য পত্রিকার দায়িত্ব নিল। তোমার মায়ের সাহিত্যের প্রতি অনেক দুর্বলতা। কীভাবে যেন তাদের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। খুব অল্পসময়ে তারা দুজন খুব কাছাকাছি চলে এল। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কী বোঝাতে চাইছি। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা গাঢ় হলো। আমি অবশ্য তখনো এসব কিছুই জানতাম না। একদিন কী একটা কাজে কলেজে একাই গেলাম আমি। মহসিনের সেদিন অনেক জ্বর। তোমার মা হয়তো আমাকে চিনত। কাছে এসে বলল, আপনি কি মহসিন ভাইয়ের বন্ধু ?

মেয়েদের সাথে আমার খুব বেশি মেশার সুযোগ হয় নি। তোমার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলাম। সে আবারও বলল, এই যে আপনি, শুনছেন! অসুস্থ নাকি ?

আর কী কী বলেছে তার কিছুই তেমন খেয়াল নেই। আমি দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। তোমার দাদা প্রভাবশালী মানুষ। তার কাছে গিয়ে সরাসরি বললাম, আব্বা আমি বিয়ে করব।

তোমার দাদা অনেক বকাবকি করলেন। বেহায়ার বাচ্চা! নিজে চলতে পারিস না, বউকে খাওয়াবি কী ?

একসময় ঠিক বুঝতে পারলেন, কিছু বলে লাভ নেই। আমার জেদ তীব্র।

তা ছাড়া তিনি হয়তো ভাবলেন, বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনলে হয়তো আমি ভালো হয়ে যাব। তিনি মহসিনকে ডেকে সবকিছু খুলে বললেন। মহসিন তখনো জানে না, পাত্রী কে! সে খুশি মনে বাবাকে বলল, একদম চিন্তা করবেন না। আমি আজই সব খবর নিয়ে আসছি।

কলেজে গিয়ে খোঁজ নিয়ে তোমার মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মাথায় হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। নাসরীন কিছুতেই বিয়েতে রাজি না।

মহসিনকে বলল, দরকার হলে আমি বিষ খাব। আপনি আমাকে যেভাবে রাখবেন, আমি তাতেই রাজি। চলেন দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।

মহসিনের কাঁধে আমার পরিবার ও বন্ধুত্বের ঋণের বোঝা। সেই ভার থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই তার। তাই সে আমাকে কিছুই বলে নি। চিরদিন অভিনয় করে গেছে। তোমার দাদাকে নিয়ে তোমার মায়ের বাড়িতে হাসিমুখে গিয়ে সবকিছু ঠিক করে এসেছে। তোমার মায়ের সাথে সে আর কোনোরকম যোগাযোগ রাখে নি।

নিজেদের ভালোবাসাকে গলাটিপে হত্যা করল মহসিন ও নাসরীন। বিয়ের রাতে মহসিনের মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট হলো। বাঁচামরা নিয়ে টানাটানি। বাবা নিজেই পুরোটা রাত হাসপাতালে ছিলেন। ডাক্তারকে বলেছেন, ‘আমার ছেলে। যেভাবে পারেন সারিয়ে তুলুন।’ সেই যাত্রায় মহসিন বেঁচে যায়। কিন্তু তার অন্তরটা যেন মরে গেছে। আসলে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে। বিয়ের কয়েকদিন পর সে যেদিন ফিরে এল, তোমার মা নতুন একটা খবর দিল আমাকে। আমার জন্যে সেটা ছিল চরম ধাক্কা। তোমার মা সন্তানসম্ভবা। বিয়ের সবেমাত্র কয়েকদিন হয়েছে। পুরোপুরি ভেঙে পড়ল সে। একবার বলল, আপনি চাইলে আমি আত্মহত্যা করব। আপনাকে কোনোভাবেই ধোঁকা দিতে পারব না আমি। আপনি যদি বলেন, এই এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।

পুরো বিষয়টা তখন বাধ্য হয়ে চেপে গিয়েছি। কারণ ভাবলাম, মূল অন্যায়টা তো করেছি আমি। তাদের দুজনের কারোরই কোনো দোষ ছিল না। তা ছাড়া তারা কিছু ভাবার সময়ও পায় নি। মহসিনকে আমি ছোটোবেলা থেকেই চিনি। জেনেবুঝে আমার কোনো ক্ষতি সে কোনোদিন করবে না।

একসময় তোমার মায়ের কোলজুড়ে এলে তুমি। আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। মহসিন আমাদের সাথেই থেকে গেল। হয়তো তোমার মাকে ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে করে নি।

এর মধ্যে একদিন জেলখানায় দেখা করতে এল মহসিন। তার মতো সৎমানুষ কখনো দেখি নি আমি। আমার কাছে ভাইয়ের চেয়েও বেশিকিছু সে। এটুকু নিশ্চিত জানি, যত দিন সে তোমার পাশে থাকবে, তোমাকে নিয়ে চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই আমার।

তাকে বললাম, পরশের সব দায়িত্ব আমি তোকেই দিয়ে রেখেছি এবং পরশ বড় না হওয়া পর্যন্ত বিষয়সম্পত্তির পাওয়ার তোর হাতেই অর্পণ করেছি।

শুনে অনেকক্ষণ কাঁদলো সে।

কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, কী রে বোকা কাঁদিস কেন ?

আপনার ভালোবাসার আমি যোগ্য না ভাইজান। দীর্ঘদিন ধরে একটা অনেক বড় অন্যায় আপনার কাছে গোপন করে এসেছি। এই দায়িত্বটা দয়া করে আমাকে দেবেন না।

মহসিন কিছুতেই শান্ত হয় না! অবশেষে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে তোর ? আমাকে খুলে বল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তোমার মায়ের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা জানাল সে। ভাবলাম পরশ নিয়ে দুশ্চিন্তাটা আজ থেকে আমার দূর হলো। আমি এখন নিশ্চিন্ত। জানি, একদিন তুমি মানুষের মতো মানুষ হবে। তোমার আসল পিতা একজন প্রকৃত ভালো মানুষ। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই খারাপ পথে নিয়ে যায় তোমাকে। 

ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, মহসিন, ভাই আমার। আমি খারাপ মানুষ। পরশকে তুই নিজের মতো দেখে রাখিস ভাই। কথা দে, আজীবন তাকে আগলে রাখবি ?

কাঁদতে শুরু করল সে।

কাঁদিস না। পারলে আমাকে তুই ক্ষমা করিস ভাই। তোর আর নাসরীনের বিষয়টা আগে জানলে আমি অবশ্যই নিজেকে বোঝাতাম। তুই এটা নিশ্চয়ই জানিস। এ জন্যেই হয়তো এত বড় বলিদানটা দিয়েছিস তুই। তোর জায়গায় আমি হলে এটা কখনোই করতে পারতাম না।

আকাশে সেদিন অবাক করা জোছনা। দূরের চাঁদটাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ। তারপর নামাজ পড়ে অনেকদিন পর শান্তির একটা ঘুম দিলাম। একটু পরে আমাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হবে। গতরাতে তোমার মা-কে স্বপ্নে দেখেছি। সে আমাকে হাত ধরে হলুদ সর্ষেখেতে নিয়ে গিয়েছিল। তীব্র রোদে হলুদের বিস্তৃত ফসলের মাঠে অনেকক্ষণ হেঁটেছি দুজন। একসাথে সূর্যাস্তও দেখলাম। তারপর সে হঠাৎ বলল, আমার সাথে চলেন। আমি আর একা থাকতে পারব না!

বাবা পরশ, আমি তোমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো বাবা। জীবনভর তোমাকে শুধু কষ্ট দিয়েছি। একটাই অনুরোধ, পিতা হিসেবে আমার নামটাই আজীবন রেখো তুমি। এই বিষয়ে কিছুই জানে না মহসিন। বলতে পারো এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।

                তোমার হতভাগ্য পিতা

সারা রাত একা একাই কাঁদলাম। কখন রাজশাহী পৌঁছেছি টেরই পাই নি। লোকটা এসে ডাকতেই খেয়াল হলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। হাতের চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। জগতের সব সত্য সবার না জানাই ভালো। বৃষ্টির মধ্যে ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।

Leave a Reply

Your identity will not be published.