অপর্ণা সেনের চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে ওঠে সমাজ-সংসারের নারীরা

অপর্ণা সেনের চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে ওঠে সমাজ-সংসারের নারীরা

এ সময়ে বিশ্বে যে কয়েকজন নারী চলচ্চিত্রকার রয়েছেন-তাদের মধ্যে ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের অপর্ণা সেন অন্যতম একজন। তিনি একজন সুঅভিনেত্রীও। আগামী ২৫ অক্টোবর তাঁর ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে এই রচনাটি পত্রস্থ হলো।

চলচ্চিত্রের আবহাওয়ার মধ্যেই বড় হয়েছেন অপর্ণা সেন। তাঁর বাবা চলচ্চিত্র-সমালোচক ও চলচ্চিত্রকার চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তাই শৈশব-কৈশোরে অপর্ণা নিজ বাড়িতেই শুনেছেন যে, বাবা-মা কিংবা বাবার বন্ধুরা দেশি-বিদেশি নানা চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনায় সরব হয়েছেন। দেখেছেন যে, বাড়ির বারান্দায় প্রজেক্টর বসিয়ে ক্ল্যাসিক বিদেশি সিনেমা দেখানো হচ্ছে। বাবা-মা ও বাবার বন্ধুরা সেইসব ছবি দেখছেন। তিনিও সেই দলে যোগ দিতেন। ছবি দেখার পরে বাবাসহ যখন অন্যরা আলোচনায় মগ্ন হতেন—সেই আলোচনা অপর্ণা শুনতেন কান পেতে। এমনিভাবে চলচ্চিত্র বোধ গড়ে ওঠে অপর্ণার মধ্যে। তার ভাষায়, “ভালো গান-বাজনা ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে যেমন কান তৈরি হয়, তেমনি ছোটবেলা থেকে ভালো ভালো ছবি দেখে, ছবির আলোচনা শুনে আমারও একটা বোধ তৈরি হয়েছিল, চোখ তৈরি হয়েছিল।”

চলচ্চিত্রের সঙ্গে অপর্ণার সম্পৃক্ততা অভিনয়ের সূত্রে। আর অভিনয়ের এই সুযোগ অপর্ণা পান প্রায় হঠাৎই। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’-র ‘সমাপ্তি’-তে। অবশ্য তার আগে অপর্ণা নিজেকে অভিনয়ের জন্যেই তৈরি করছিলেন। উৎপল দত্তের গ্রুপ থিয়েটারে শুরু করেছিলেন অভিনয়চর্চা। যাহোক, ‘সমাপ্তির’-র পরে পড়াশোনার জন্যে বছর কয়েকের বিরতি। স্কুল ফাইনাল দেওয়ার পরে অভিনয় করলেন মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’-এ। পরের ছবি ‘বাক্সবদল’। এমনিভাবে বহু ছবিতে অপর্ণা অভিনয় করেছেন, হয়েছেন প্রশংসিত। তার প্রতিভার স্বাক্ষরবাহী ছবিগুলো হলো- অপরিচিত, সুজাতা, মোহনার দিকে, এখানে পিঞ্জর, কলংকিত নায়ক, সেবিকা, যে যার প্রিয়, নৌকাডুবি, রাগ অনুরাগ প্রভৃতি। অবশ্য বাংলা ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি অপর্ণা একাধিক হিন্দি ও ইংরেজি ছবিতেও অভিনয় করেছেন।

চলচ্চিত্রকার হিসেবে অপর্ণার আত্মপ্রকাশ ১৯৮১ সালে। হঠাৎ করেই। ইংরেজি ভাষার এই ছবির নাম ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’। প্রযোজক শশী কাপুর।

প্রথম ছবিতেই অপর্ণা সবাইকে চমকে দেন। চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মুগ্ধ হন তার নির্মাণশৈলীতে। ম্যানিলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ পায় সর্বোচ্চ পুরস্কার সোনার ঈগল। এই ছবির সুবাদে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ পরিচালনার পুরস্কারটিও দখল করেন তিনি। বলা যায়, এলেন, দেখলেন জয়, করলেন- অনেকটা এভাবেই ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ দিয়ে চলচ্চিত্রের জগতে নিজের জায়গাটি করে নিতে সক্ষম হন অপর্ণা।

‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর মূল চরিত্র অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্কুল শিক্ষিকা মিস স্টোনহ্যাম। তার নিঃসঙ্গ জীবন, ছাত্রীদের প্রতি তার স্নেহ-মমতা, তার জীবিকা, তার ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতা, বঞ্চনা, তার ব্যর্থ প্রেমের দহন, স্বপ্ন, সাধ—সবকিছুকে সুন্দরভাবে দৃশ্যের পরে দৃশ্যে-শট থেকে শটে মূর্ত করে তুলেছেন অপর্ণা। এ ছবি দেখে ভারতীয় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ সম্পর্কেও একটি ধারণা লাভ করেন দর্শক।

নিঃসঙ্গ মিস স্টোনহ্যামের রুক্ষ মরুভূমির মতো জীবনে এক পশলা বৃষ্টির মতোই তাঁর প্রাক্তন ছাত্রী নন্দিতা ও তার প্রেমিক সমরেশের আবির্ভাব। নন্দিতা-সমরেশ তাদের প্রেমের আদান-প্রদানের নিশ্চিত সুযোগ পায় মিস স্টোনহ্যামের ফ্ল্যাটে। এই সূত্রে মিস স্টোনহ্যামের নিঃসঙ্গতা যেন কিছুটা কেটে যায়। তিনি মানসিক তৃপ্তি পান। একদিন নন্দিতা-সমরেশের বিয়ে হয়। স্টোনহ্যাম তাদেরকে নিজের বহু দিনের স্মৃতি জড়ানো গ্রামোফোন আর রেকর্ড উপহার দেন। তারপর এক ক্রিসমাসের রাতে নিজের হাতে তৈরি কেক নিয়ে বিয়েতে যৌতুক হিসেবে পাওয়া সমরেশের বাড়ির দরজা থেকে তাকে অবসন্ন বিমূঢ়তায় ফিরে আসতে হয়। উৎসবমুখর নন্দিতা-সমরেশের জীবনে তার আর কোনো প্রয়োজন নেই। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই—নির্জন শীতের রাতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পথ দিয়ে একাকী হেঁটে যাচ্ছেন মিস স্টোনহ্যাম। হাতে তার সমরেশ-নন্দিতার জন্যে আনা ক্রিসমাস কেক। পথের একটা কুকুর কেকটা মুখে দিতে চায়। স্টোনহ্যাম সযত্নে কেকটা কুকুরের মুখে তুলে দিয়ে জনহীন পথ পেরিয়ে যান।

‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এ অপর্ণার ওপর সত্যজিৎ রায়ের প্রভাব বেশ সুস্পষ্ট। তার মতোই ডিটেলের প্রতি তার নজর। সেটি হোক মিস স্টোনহ্যামের রকিং চেয়ার, সেই চেয়ারের বিবর্ণ দশা—বেড়ালের লাফঝাঁপের ফলে নখের আঁচড়ে অনেক সুতো উঠে যাওয়া; অথবা ডেস্কের পাশের রকিং চেয়ারের গায়ে শুকিয়ে যাওয়া কালির দাগ—যা মাঝে মাঝে লেখার সময় মিস স্টোনহ্যামের কলমের কালির ঝাড়ার ফল। শব্দ ব্যবহারের বেলাতেও তাই গ্রামার ক্লাসের একঘেয়ে ক্লান্ত সুরে পড়ানোর পাশাপাশি যুক্ত হয় ফেরিওয়ালার দীর্ঘ একটানা ডাক। গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে, জনশূন্য গলিতে, শিশিবোতলওয়ালার ক্লান্ত কণ্ঠ ক্রমশ গলির বাঁকে হারিয়ে যায়।

অপর্ণা সেনের দ্বিতীয় ছবি ‘পরমা’ (১৯৮৫)। বাংলা ছবি। এখানে মধ্যবয়সী এক মহিলার পদস্খলন দেখানো হয়েছে। ভাশুরপো’র ফটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গে মহিলাটি অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কেননা ফটোগ্রাফার ছেলেটির সংস্পর্শে এসেই তার ভেতরের মানুষটি বহুদিন পর বেড়িয়ে আসে, তার চাপা পড়া শিল্পীসত্তা (তিনি এককালে ভালো সেতার বাজাতেন) আবার উত্থিত হয়। তাই তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন না। বলা যায়, প্রথম ছবি ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর পর আবার একাকিত্বের প্রতিফলন দেখা যায় ‘পরমা’-তে। তফাত এখানে একাকিত্বের নিরুচ্চার উত্তপ্ত বিদ্রোহ ঘোষণা।

‘পরমা’-য় অপর্ণা প্রায় সত্যজিতের প্রভাবমুক্ত। নির্মাণশৈলীতেও আগের ছবির চেয়ে পরিণত এক চলচ্চিত্রকারকে দেখা যায়।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়—অপর্ণার ছবিতে সমাজ নিশ্চয় আছে কিন্তু সেখানে ব্যক্তিই প্রধান। ব্যক্তিগত সমস্যা, সম্পর্ক ও চরিত্র চিত্রনই তার লক্ষ্য। অপর্ণার ছবির চরিত্র কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি নয়। তার মানে এই নয়, তার ছবির চরিত্ররা সমাজের বাইরের কেউ। এর বড় উদাহরণ ‘পরমা’। যদিও এটাও ঠিক যে, কখনো কখনো পরমা যুক্তির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে নি। তারপরেও এটা অনস্বীকার্য যে, ‘পরমা’-র মতো ছবি নির্মাণ করে অপর্ণা সেন সামাজিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাজ করেছেন।

‘সতী’ অপর্ণা সেনের তৃতীয় ছবি। নায়িকা উমা বোবা। অতীতের এক গোড়া হিন্দু সমাজের গল্প। কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাটির পাত্র না পাওয়া যাওয়ায় তার বিয়ে হয় এক গাছের সঙ্গে। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয় রক্ষণশীল স্কুল শিক্ষকের দ্বারা। মেয়েটির সম্মান বাঁচায় ওই গাছটিই। গাছের পাতার আড়ালে এক বর্ষার রাতে আশ্রয় নেওয়ার সময় বজ্রপাতে মারা যায় উমা।... অপর্ণার সতী একটি বড় মাপের কাজ। উমার চোখ দিয়ে সমাজের যে প্রায় নিখুঁত চিত্রটি অপর্ণা তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে আজকের সভ্য সমাজের মিল কতটা তাও এর থেকে খুঁজে নেওয়া যায়। এতটাই ‘সমকালীন তাৎপর্য’ বহন করছে ছবিটি। প্রতীকী এই কাহিনিতে উমা শেষে সতী হলো কি হলো না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। সত্যি কথা বলতে কী, উমা হচ্ছে এখানে প্রেক্ষিত বা সময়। সমাজ হচ্ছে বিষয়। এই দুয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র গড়ে অপর্ণা তার ভেতর থেকে তুলে এনেছেন উমা বা নারীর অবস্থান।

অপর্ণার চতুর্থ ছবি ‘পিকনিক’। এটি অবশ্য টেলিফিল্ম। এই ছবিরও মুখ্য চরিত্র নারী। তবে অপর্ণার ‘যুগান্ত’-এ পুরুষকেও দেখতে পাই।

অপর্ণার ষষ্ঠ কাহিনিচিত্র ‘পারমিতার একদিন’। পারমিতা নামে একটি মেয়ের একটি দিনের ঘটনা। ঘটনাটা ঘটছে উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়ির অন্দরমহলে। এই বাড়ি ঘিরে রয়েছে পারমিতার অনেক স্মৃতি। ছবিটি তাই কখনো বর্তমানে, কখনো অতীতে।... এই ছবি দুই অসম বয়সী নারীর বন্ধুত্বের কাহিনি। পারমিতা আর সনকা হলেন এই দুই নারী। সনকা হলেন শাশুড়ি, আর পারমিতা তার পুত্রবধূ। তবে দুজনেই এই সম্পর্ককে অতিক্রম করে, যেন দুই সখী। কেউ কেউ হয়তো এই সম্পর্কের মাঝে সমকামীতার গন্ধও খুঁজে পেতে পারেন।

‘পারমিতার একদিন’-এর আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, এই ছবিতে এমন দুটি বিষয় অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে এসেছে-যা আগে কখনো কোনো সিনেমায় দেখা যায় নি। বিষয় দুটি হচ্ছে-স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং স্প্যাসটিকস। ছবিতে দেখা যায়, এই দুটি বিষয়ের কারণেই পারমিতা (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) ও সনকা (অপর্ণা) পরস্পরের মনের কাছাকাছি আসে (অবশ্য স্বামীর অবহেলাও একটি অন্যতম কারণ)। সনকার ছোট মেয়ে খুকু উন্মাদ। স্কিৎজোফ্রেনিক। আর পারমিতার পুত্র বাবলু স্প্যাসটিক। যাকে বলে প্রতিবন্ধী। অপর্ণা সেন এই দুটি বিষয়কে ট্রিট করেছেন একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। এই দৃষ্টিকোণ অবশ্যই মানবিক। অবশ্য শেষপর্যন্ত ‘পারমিতার একদিন’ দেখার পরে সচেতন দর্শকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা যাদের মানসিক অসুস্থ কিংবা শারীরিক অসুস্থ বলে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করে দিয়েছি তারা কি সত্যি সত্যিই অসুস্থ ? নাকি আমরা ?

এরপর অপর্ণা নির্মাণ করেন ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’। এক ভ্রমণের গল্প। একটি বাসে ভারতের নানা প্রদেশের নানা ধর্মের নানা জাতের মানুষের ভ্রমণ। এই ভ্রমণের ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে প্রেম, ভেঙে যাচ্ছে বিশ্বাস। তবে ছবির যে গল্প সেটা একটা খোলসের মতো। আসলে এটা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের আতঙ্কের বিরুদ্ধে একটা আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ।

অপর্ণা পরিচালিত অন্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে, ১৫ পার্ক এভিনিউ (২০০৫), দ্য জাপানিজ ওয়াইফ (২০১০), ইতি মৃণালিনী (২০১১), গয়নার বাক্স (২০১৩), আরশি নগর (২০১৫), সোনাতা (২০১৭), দ্য রেপিস্ট (২০২১)।

অপর্ণার ছবিতে আমরা লক্ষ করি যে, ভারতীয় সমাজ ও সংসারে নারীদের কী অবস্থা ও অবস্থান—সেটি তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, তার ছবিতে প্রতিবন্ধীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় বিশেষভাবে। যেমন,‘পরমা’, ‘পারমিতার একদিন’ এমনকি ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে চলচ্চিত্রকার অপর্ণা সেনের একটি বক্তব্য থাকে।

অপর্ণা সেন সুনামের সঙ্গে পাক্ষিক ‘সানন্দা’ সম্পাদনা করেছেন ১৯ বছর (১৯৮৬-২০০৫)। পরে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ‘পরমা’ (২০১১-২০১৩) এবং ‘প্রথমা এখন’-এ। তিনি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন কলকাতা টিভিতে (২০০৫-০৬)

অপর্ণা সেন তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নয়বার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার; ছয়বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার (পূর্ব) এবং তেরোবার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এ্যাসোশিয়েশন পুরস্কার। পেয়েছেন পদ্মশ্রী। এছাড়া আরও বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.