ষাট বছরে ‘রূপবান’

ষাট বছরে ‘রূপবান’

এদেশের প্রথম লোককাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র ‘রূপবান’। এটি ১৯৬৫ সালের এই দিনে (৫ নভেম্বর) মুক্তি পায়। পরিচালক সালাহ্উদ্দিন। এখানে আবহমান বাংলার গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। শিকড়সন্ধানী এই চলচ্চিত্রটি সেই সময়ে এদেশের আপামর মানুষকে চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল বাংলা চলচ্চিত্রের নির্মাণ বেড়েছিল; বেড়েছিল দর্শকসংখ্যাও। সঙ্গতকারণেই প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যাও বেড়েছিল; চলচ্চিত্রের ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই চলচ্চিত্রটি নতুন রেকর্ড গড়েছিল। উল্লেখ্য, ছবিটি মুক্তির বছরখানেক আগে ‘রূপবান’ নির্মাণ শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এদেশের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক ফজলুল হক। চলচ্চিত্রটির একটি গান ও বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিংও করেছিলেন বর্তমান রমনা পার্কে। সেই সময়ে নানান সমস্যার কারণে চলচ্চিত্রটি নির্মাণে তিনি আর এগিয়ে যেতে পারেন নি। ফজলুল হকের অনুমতি সাপেক্ষেই পরবর্তী সময়ে সালাহ্উদ্দিন ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।

আজ ‘রূপবান’ মুক্তির ষাট বছর পূর্ণ হলো। এই উপলক্ষে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের গল্প এখানে তুলে ধরা হলো।

‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের কাহিনিধারায় মূর্ত হয়ে উঠেছে, নিরাশপুরের বাদশা একাব্বরের মনে শান্তি নেই। শান্তি নেই প্রজাদের মনেও। তারা অভাব-অনটনে জর্জরিত। সব কিছুর জন্যে তারা মনে করছে যে, বাদশা দায়ী। কারণ তিনি নিঃসন্তান। আটকুড়ে। এই অবস্থায় বাদশা একাব্বর মনের যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে একদিন রাজ্য পরিচালনার ভার উজিরের কাছে দিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যান। এ ঘটনায় রানী মর্মাহত হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বাদশা যদি তাড়াতাড়ি ফিরে না আসেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। এদিকে বাদশা নির্বাসনে যাওয়ার পথে নদী পার হন। তখন তার পায়ে জরির জুতা দেখে নৌকার এক মাঝি একাব্বর বাদশার কথা বলেন। ওই ব্যাডা আটকুইড়া বাদশার নাম কইরা  দিলি আইজকার দিনডা মাটি কইরা। পাজি, নচ্ছাড়া, বাদশা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন তার প্রতি প্রজাদের মনোভাব।... নির্বাসিত একাব্বর বিধ্বস্ত অবস্থায় বনে ঘুরার সময় তপস্যারত এক দরবেশের গায়ে ধাক্কা লাগে। দরবেশ রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে অভিশাপ দেন, ছেলের জন্য তিনি বারো বছর অনুতাপ করবেন। তারপর যখন তিনি জানতে পারেন যে, বাদশা নিঃসন্তান তখন তিনি একটি ফুল দিয়ে বলেন যে, পানিতে ভিজিয়ে তিন রাত্রি রানীকে খেতে দিতে। তিনি সন্তানসম্ভবা হবেন। আরও বলেন যে, তার বারো দিনের ছেলের সঙ্গে বারো বছরের মেয়ের বিয়ে দিতে হবে এবং তাদেরকে বারো বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে। তবেই ছেলের প্রাণ রক্ষা হবে। যাহোক দরবেশের দেওয়া সেই ফুলের বরকতে রাণী এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের মা হন এবং ছেলের নাম রাখেন রহিম। অতঃপর উজির কন্যা বারো বছরের রূপবানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। রূপবান অবশ্য রহিমকে বিয়ে করতে চায় নি কিন্তু পিতার প্রাণ রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়। তারপর পিতা-মাতা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিশু বর রহিমকে নিয়ে রূপবান নির্বাসনে যায়। যাবার পথে কোথাও বাঘ, কোথাও অজগর, কোথাও অন্যসব হিংস্র বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি হয় রূপবান। তবু সাহসে ভয় করে এগিয়ে যায় সে। একদিন নদী পার হওয়ার জন্য মাঝিকে সে দেয় সোনার মোহর। মাঝি তা চিনতে না পেরে এক চতুর বণিককে দিয়ে দেয়, পয়সার বিনিময়ে।... জঙ্গলে একদিন একদল জংলি রূপবানকে আক্রমণ করে। তাকে অই অবস্থা থেকে রক্ষা করে জংলি সর্দার। তিনিই রহিম ও রূপবানকে আশ্রয় দেন। তাদের জন্য বনের মাঝে কুঁড়েঘর তৈরি করে দেন। কিন্তু একদিন এক বাঘ রহিমকে আক্রমণ করতে উদ্যোগী হলে জংলি সর্দার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জঙ্গলের অন্যদিকে বসবাসরত মাসির কাছে পৌঁছে দেন। মাসি রহিম ও রূপবানকে আশ্রয় দেয়। মাসি যেহেতু মালিনীর কাজ করে রূপবানও সেই কাজ করে।... রহিম বড় হয়। মক্তবে পড়ে। অত্যন্ত মেধাবী সে। সেখানে সাইয়েদ বাদশার মেয়ে তাজেলের সঙ্গে রহিমের দ্বন্দ্ব হয়। তাজেল তার বাবাকে বলে কৌশলে রহিমের মক্তবে আসা বন্ধ করার চেষ্টা করে। রহিমকে জানানো হয় জরির জামা পরে আর ঘোড়ায় চড়ে না এলে সে মক্তবে আসতে পারবে না। কিন্তু জংলি সর্দারের সাহায্যে রহিম ঠিকই ঘোড়ায় চড়ে এবং জরির জামা পরে মক্তবে আসে।... তাজেল রহিমকে বিয়ে করতে চায়, একথা শুনে ওর বাবা, সাইয়েদ বাদশা, রহিমকে শান্ত্রী দিয়ে ধরে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখে। রহিমের ওপর অত্যাচার চলে। এদিকে রূপবানের রূপ-যৌবন মুগ্ধ করেছিল সাইয়েদ বাদশাকে। সে রূপবানকে করায়ত্ত করতে গেলে বাধা দেয় তাজেল। জংলিরাও দলবেধে ছুটে আসে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পালায় সাইয়েদ।... কারাগার থেকে রহিমকে মুক্ত করে দেয় তাজেল। নিশাপুরে খবর যায় যে, রহিম বিপদে পড়েছে। বাদশা একাব্বর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এগিয়ে আসেন। জংলি সর্দারও যোগ দেয়। যুদ্ধে পরাজিত হয় সাইয়েদ বাদশা। সে পালায়। কিন্তু পথের মাঝে মাসি, রূপবান ও রহিমকে দেখে সে রূপবানকে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেই সময় সেখানে হাজির হয় একাব্বর বাদশা ও জংলি সর্দার। একাব্বর সাইয়েদের দিকে তরবারি তুলে ধরেন। তখন তাজেল দৌড়ে এসে ক্ষমা ভিক্ষা করে। রূপবানও তার কথায় সুর মিলায়। তাই একাব্বর সাইয়েদকে ক্ষমা করেন। অতঃপর রহিম ও রূপবানকে নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে চলেন। জংলি সর্দার ও মাসি অশ্রুসিক্ত চোখে তাদের বিদায় জানায়।

চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা (রূপবান), চন্দনা (তাজেল), সিরাজুল ইসলাম (একাব্বর বাদশা), তন্দ্রা ইসলাম ( একাব্বর বাদশাহর স্ত্রী বা রাণী), আনোয়ার হোসেন (জংলি সর্দার), ইনাম আহমেদ (সাইয়েদ বাদশা), রহিমা (মাসি), সুভাষ দত্ত (মক্তবের ওস্তাদ), মঞ্জুর হোসেন (নৌকার মাঝি), তেজেন চক্রবর্তী (উজির, রূপবানের বাবা)সহ আরও অনেকে। সালাহউদ্দিন প্রোডাকশন্স-এর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। প্রযোজনা ও পরিচালনা সালাহ্উদ্দিন। চিত্রগ্রাহক এম এ সামাদ। সম্পাদক বশীর হোসেন। সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা। কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও নীনা হামিদ। শিল্প নির্দেশক হাসান আলী ও এম এ সবুর। শব্দগ্রাহক এম এ জহুর ও অন্যান্য। ব্যবস্থাপক সফদর আলি ভুঁইয়া। মেকাপ শহীদ ও সোবহান। কস্টিউম কালী বাবু।

এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা দরকার। ১৯৬৫ সালে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্প মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়। এই ক্ষেত্রে অন্ধকারে আলো দেখান সালাহ্উদ্দিন। তিনি বাংলাদেশের শহরে-গ্রামে জনপ্রিয়  যাত্রাপালা রূপবানকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে অবশ্য চিত্রকর্মী সফদর আলী ভুইয়া তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সাহায্য করেছিলেন ফজলুল হক, যা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘রূপবান’-এর অন্যতম সহকারী পরিচালক হারুন অর রশীদ এর ভাষ্য হচ্ছে, সালাহ্উদ্দিন পুবাইলে গিয়ে দুই-তিন রাত থেকে ওখানকার এক যাত্রা দলের পরিবেশিত ‘রূপবান’ যাত্রাপালাকে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিলেন। বলাই বাহুল্য কাহিনি, সংলাপ ও গান যাত্রা থেকে সংগৃহিত। একটি-দুটি গান অবশ্য নতুন ছিল। যেমন, আবদুল আলীমের গাওয়া গান—যা মাঝির লিপে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ‘ঢেউ উঠছে সাগরে রে/ক্যামনে পাড়ি ধরি রে...।’

সালাহ্উদ্দিন যখন ‘রূপবান’ নির্মাণে হাত দেন তখন কেউ কেউ আড়ালে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে বলতেন, ‘ধারাপাত, সূর্যস্নান-এর সালাহ্উদ্দিনের শেষে এই  পরিণতি!’

অবশ্য ‘রূপবান’-এর ব্যবসায়িক সাফল্য বিষয়ে সালাহ্উদ্দিনের সংশয় ছিল। তবুও একসময় সব সংশয় ঝেরে ফেলে কিছু টাকা জোগাড় করে ‘রূপবান’ নির্মাণে হাত দেন তিনি। যাত্রাপালায় যেসব স্থূল জিনিস ছিল সেগুলো বাদ দিয়ে সহজ-সরলভাবে চিত্রনাট্য-সংলাপ লেখা হলো। চলচ্চিত্রে যাতে লোকজ উপাদানের গন্ধ থাকে সেই চেষ্টায়ও তিনি করলেন। এই বিষয়ে কিছুটা গবেষণাও করেছিলেন তিনি।

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ছবির বাজারও দখল করতে চেয়েছিলেন সালাহ্উদ্দিন। তাই ‘রূপবান’ বাংলা ও উর্দু—দুই ভাষাতেই নির্মিত হয়। শুটিংয়ের সময় একই শট দুবার নেওয়া হতো। একবার বাংলা সংলাপে, আরেকবার উর্দুতে। এমনকি সাইলেন্ট শর্টও দুবার গ্রহণ করা হয়েছে। বলা যায়, ‘রূপবান’ই এদেশের প্রথম দ্বিভাষিক চলচ্চিত্র। আয়াজ হাশমী নামে উর্দু ভাষী স্থানীয় এক সাংবাদিক-কবি-সাহিত্যিক বাংলা সংলাপ ও গানের চমৎকার উর্দু অনুবাদ করেছিলেন।

‘রূপবান’-এর ইনডোর শুটিং হয়েছিল বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে, তৎকালীন একটি বিল্ডিংয়ে। এখানে লাহোরের আতাউল্লাহ শাহ হাশমী নামে এক চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীর একটি স্টুডিও ছিল। নাম ঢাকা স্টুডিও। এখানে বাদশা একাব্বরের দরবারের সেটসহ আরও কয়েকটি সেট তৈরি করে ইনডোরের শুটিং করা হয়েছিল।

‘রূপবান’-এর আউটডোর শুটিং হয়েছিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। সেখানকার খাসিয়া পল্লিতে, বন, টিলা, নানা জায়গায় শুটিং হয়। জংলি সর্দারের বাড়ি, মাসির বাড়ি, রূপবানের কুঁড়েঘর, সবই সেখানকার খাসিয়াপল্লিতে তৈরি করা হয়েছিল।

 ফেঞ্চুগঞ্জের উদ্দেশে ইউনিট রওনা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে। তখন শীতকাল। সবাই দলবেঁধে  ট্রেনে রওনা দিয়েছিল। মাইজগাও নামে একটি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে খাসিয়াপল্লির উদ্দেশে সবাই যাত্রা করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তখন যাতায়াত ব্যবস্থা এখনকার মতো সুন্দর ছিল না। টেলিফোনে যোগাযোগও সহজ ছিল না। তাই ঢাকার সঙ্গে এক প্রকার বিচ্ছিন্নই ছিল ছবিটির ইউনিট।

আউটডোরে একসময় একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ক্যামেরার একটি লেন্স কাজ করছিল না। অগত্যা ঢাকায় একজন লোককে পাঠানো হয়েছিল, এফডিসি থেকে আরেকটি লেন্স আনার জন্য। সে গেল তো গেলই। আর ফিরে না। তখন সালাহউদ্দিন চিত্রগ্রাহক এম এ সামাদকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন শুটিং শেষ করেন। কোনো সমস্যা হলে, চিত্রগ্রহণে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লো সেই দায়িত্ব তার। পরিচালকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে এম এ সামাদ দৃশ্যধারণ করলেন। পরে ফিল্ম ডেভেলপ করে দেখা গিয়েছিল যে, সবই ঠিক আছে। আরেকটি কথা, লাইটিংয়ের সমস্যার দরুন আউটডোরে কোনো রাতের দৃশ্য রাখা হয় নি।

উল্লেখ্য, চিত্রগ্রাহক এম এ সামাদ ‘রূপবান’-এর দরবার সেটটি দুতিনদিন ধরে লাইটিং করেছিলেন। রূপবানরূপী সুজাতার মুখমণ্ডলে আশাপ্রদ এফেক্ট আনার জন্য সুজাতার প্রতিটি শটে লাইটিং-এ সামাদ সাহেব প্রচুর সময় নিতেন। এতে অবশ্য ভালো রেজান্ট এসেছিল। কাট লাইটে সুজাতার আকর্ষণীয় চেহারা বেরিয়ে এসেছিল। ফটোগ্রাফি টোনও ছিল চমৎকার।

রহিমের চরিত্রে অভিনয় করেছিল এক কিশোর। তার অভিনয়ের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে দৃশ্য ধারণের সময় তার ভুল হতো। তাই তার কোনো শট এক বা দুবারে ওকে হতো না। এনজি হতো। সত্যি কথা বলতে কী, তখন শিশুশিল্পী পাওয়া কঠিনই ছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে এক কিশোর নানা ধরনের খেলা দেখাতো। তাকে দিয়ে মক্তবের পাগলাটে টাইপের ছাত্রের চরিত্রটি করানো হয়েছিল। তার শটও এনজি হতো। আসলে মক্তব্যের দৃশ্যেই বেশি এনজি হয়েছিল।

শুটিংয়ের সময় নানা মজার ঘটনাও ঘটেছিল। যেমন, একদিন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ আউটডোর লোকেশনে শুটিংয়ের সময় হইচই শোনা গেল। ব্যাপার কী ? পরিচালক সালাহ্উদ্দিন কৌতূহলী হলেন। জানা গেল, এক আশি বছরের বৃদ্ধ চিড়া মুড়ি গামছায় বেঁধে দশ মাইল পথ হেঁটে চলে এসেছেন, রূপবান রূপী সুজাতাকে দেখার জন্য। কিন্তু শুটিংয়ে বিঘ্ন ঘটবে বলে ইউনিটের লোকজন তাঁকে বাধা দিয়েছে, সুজাতার কাছে যেতে দিচ্ছে না। সব শুনে সালাহ্উদ্দিন বৃদ্ধকে সুজাতার কাছে নিয়ে যেতে বললেন। হ্যাঁ, শুটিং তখন হচ্ছে না। ...বৃদ্ধ সুজাতার দিকে অপলক চেয়ে থাকলেন। ধীরে ধীরে তাঁর ফোকলা মুখে হাসি ফুটে উঠল। তৃপ্তির হাসি। বৃদ্ধ বললেন, এখন আমি মরেও শান্তি পাব। আবার শুটিং শুরু হলো। বৃদ্ধ অদূরে নীরবে বসে তা দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। কেননা তখন চলছিল একটি করুণ গানের শুটিং।

‘রূপবান’-ই হলো সেই সিনেমা যার জন্য এদেশের অগণিত মানুষ নৌকা বা গরুর গাড়িতে গ্রাম থেকে মফস্বল শহরে এসেছে। জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র দেখেছে। এমনও হয়েছে টিকেট মেলে নি। তাই অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকা কিংবা গরুর গাড়িতে দিনরাত অপেক্ষায় থেকেছে। এই অপেক্ষার সময়ও নানা ঘটনা ঘটেছে। যেমন এক গর্ভবতী গৃহবধূ গরুর গাড়িতেই সন্তান প্রসব করেছিল।

দিনাজপুরের লিলি টকিজে ‘রূপবান’ দেখতে ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছিলেন গ্রামের কয়েক শ নারীপুরুষ। তারা সেদিনের টিকিট পায় নি। পরের দিনের টিকেট তারা পেয়েছিল। তারা এখন থাকবে কোথায় ? সিনেমাহলের মালিক তখন সিনেমাহলের মধ্যেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি বড় বড় ডেকচি ভর্তি খিচুরির ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন।

‘রূপবান’ এদেশের মানুষের মধ্যে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল যে, একটি সিনেমাহলের সামনে ঝোলানো ছেঁড়াফাটা পুরোনো ব্যানারও নিলামে বিক্রি হয়েছিল।

চলচ্চিত্রটির অন্যতম সহকারী পরিচালক হারুনর রশীদ জানাচ্ছেন, ঢাকা স্টুডিওতে ধারণকৃত অংশটুকুর সরাসরি নেগেটিভ করা হয়Ñকোনো রাশপ্রিন্ট বের করা হয় নি। এতে সময় ও খরচের সাশ্রয় হয়েছিল।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘রূপবান’ ব্যবসায়িক সাফল্যের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়েছিল। ছবিটির নির্মাণ খরচ ছিল ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অথচ ‘অতি জনপ্রিয় সুপার হিট এই ছবিটি ওই সময় ১২ লক্ষ টাকা মুনাফা করে’ (বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প/মির্জা তারেকুল কাদের, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩, পৃ. ৩৬৭)। যদিও ছবিটির অন্যতম সহকারী পরিচালক হারুনর রশীদের ভাষ্য মতে ছবিটির ব্যবসা কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে বেশি লাভবান হয়েছিল পরিবেশক পপুলার ফিল্মস অ্যান্ড থিয়েটার্স।

‘রূপবান’ এদেশে লোকগাথাভিত্তিক ছবি তৈরির ধারার জন্ম দেয়। তাই তো একে একে নির্মিত হয় ‘গুনাই বিবি’, ‘আপন দুলাল’সহ বহু চলচ্চিত্র।

‘রূপবানে’র আগে এদেশে কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে প্রযোজক ৪টি কিংবা ৫টি প্রিন্ট করতেন। কিন্তু ব্যাপক চাহিদার কারণে ‘রূপবান’-এর ১৭টি প্রিন্ট করতে বাধ্য হন প্রযোজক-পরিচালক সালাহ্উদ্দিন। ছবিটি মুক্তির পর এদেশে বাংলা ছবি নির্মাণের সংখ্যা যেমন বেড়েছিল সিনেমাহলের সংখ্যাও বেড়েছিল।

‘রূপবান’-এ আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। লোকগাথার গন্ধ পাওয়া যায় এখানে। ফলে এই চলচ্চিত্রে প্রচুর গান রয়েছে। ছোট-বড় ছাব্বিশটি গান। বলা যায়, এ ছবিতে গান ও সংলাপ পাশাপাশি গাঁথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গান সংলাপের কাজ করেছে।

 

চিত্রনাট্য থেকে

দৃশ্য-৯

জঙ্গল। নির্বাসিত একাব্বর বিধ্বস্ত চেহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

একা : কোনো সাড়া নেই। আমার ডাকে কেউ সাড়া দেবে না। আমি শুধু—আমি শুধু অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। কোনো আলো নেই, কোনো আলো নেই। খোদা, এখনো কি আমার ফরিয়াদ শোনার সময় তোমার হয় নি ? আমার ডাক শোনার কেউ নেই, আমার ডাক শোনার কেউ নেই। মৃত্যুই আমার কাম্য।

 

হঠাৎ তপস্যারত এক দরবেশের গায়ে ধাক্কা লাগে। দরবেশ গর্জে ওঠেন।

দরবেশ : কে রে তুই নরাধম, মূর্খ ? আমার বারো বছরের এবাদত ভেঙ্গে দিলি ? তোকে দিলাম এই অভিশাপ—ছেলের জন্য তুই বারো বছর করবি অনুতাপ।

একা : (দুঃখের হাসি হেসে) আমার তো ছেলে নেই দরবেশ সাহেব।

দরবেশ : দরবেশের অভিশাপ মিথ্যা হবে না। তোর ছেলে হবে।

একা : আমার ছেলে হবে ?

দরবেশ : হ্যাঁ, তোর ছেলে হবে। তবে তার আয়ু মাত্র বারো দিন।

একা : আপনার কথা ফিরিয়ে নিন দরবেশ সাহেব। ছেলেই যদি পাব তবে তাকে কেড়ে নিতে কেন চাইছেন ?

দরবেশ : ওরে পাগল, সবই খোদার ইচ্ছা। তোর ছেলেকে বাঁচাতে পারিস এক শর্তে।

একা : কী সে শর্ত দরবেশ সাহেব ?

দরবেশ  : তোর বারো দিনের ছেলের সঙ্গে বারো বছরের মেয়ের বিবাহ দিতে হবে এবং বিবাহ রাত্রেই পুত্র ও পুত্রবধূকে বারো বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে। তবেই তোর ছেলের প্রাণ রক্ষা হবে।

একা : কী কঠিন শর্ত আপনার দরবেশ সাহেব ?

দরবেশ  : ওরে পাগল, সবই খোদার ইচ্ছা। আমি শুধু উছিলা মাত্র। আর আমার কথাই কি সব ? দ্রব্যগুণও চাই। এই ফুলটি নিয়ে যা। পানিতে ভিজিয়ে পরপর তিনরাত তোর স্ত্রীকে খেতে দিবি।

 

দৃশ্য-১০

একাব্বর বাদশার প্রাসাদ অঙ্গন। দাউদাউ আগুন জ্বলছে। রানী সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে চাচ্ছে। দাসী কাকুতি-মিনতি করে বাধা দিচ্ছে।

দাসী : বেগমসাহেবা, এ কাজ করবেন না, বেগমসহেবা এ কাজ করবেন না।

(সে রানীর পা ধরে)

রাণী : সরে যা কানিজ। আমি তোকে হুকুম করছি, সরে যা। (দাসীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আগুনের দিকে এগিয়ে যায়।) খোদা, তুমি আমাকে বাঁচতে দিলে না। এখন মরবার অধিকার দাও।

বাদশা একাব্বর দৌড়ে সেখানে প্রবেশ করেন।

একা : বেগম, আমি ফিরে এসেছি বেগম। ফিরে এসেছি।

তিনি রানীকে জড়িয়ে ধরে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া থেকে রক্ষা করেন।

 

দৃশ -১১

রানী : কানিজ...

কানিজ : (কক্ষে ঢুকে) বেগমসাহেবা।

রানী : আবে জমজম...

দাসী ফিরে গিয়ে পেয়ালায় পানি নিয়ে আসে। রানী সেই পানিতে দরবেশের দেওয়া ফুল ডুবিয়ে দেন।

রানী : খোদা, তুমি আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছ। জনগণের বিশ্বাস যেন অটুট থাকে।

রানী সেই পানি খেয়ে ফেলেন।

 

দৃশ্য -১২

একাব্বর বাদশার দরবার। সিংহাসনে বসে একাব্বর।

উজির : প্রজাদের ক্ষেতে এবার প্রচুর ফসল হয়েছে। দেশে আর কোনো অভাব থাকবে না জাঁহাপনা।

একা : তবু আমার নির্দেশ রইল উজির সাহেব, প্রজারা তাদের ফসল বিক্রি করে যেটুকু দিতে চাইবে শুধু সেইটুকু রাজকোষে সঞ্চিত করবেন। তাদের উপর যেন কোনোরকম জুলুম না হয়।

দাসী কুর্নিশ করতে করতে দরবারে ঢোকে—

দাসী : তসলিম জাঁহাপনা।

একা : কী খবর কানিজ ?

দাসী : শুভ সংবাদ, জাঁহাপনা।

একা : শুভ সংবাদ ?

দাসী : খোদার রহমতে রাজপ্রাসাদ আলোকিত করে এক শাহজাদা জন্মগ্রহণ করেছেন জাঁহাপনা।

একা : আলহামদুলিল্লাহ্!

অন্য সকলে : আলহামদুলিল্লাহ!

একা : (মুক্তাখচিত হার এগিয়ে দিয়ে) এই নাও কানিজ, তোমার পুরস্কার।

দাসী  পুরস্কার পেয়ে খুশিমনে যাওয়ার জন্য ফিরতেই বাদশা আবার তাকে ডাকেন,

একা : আর শোনো কানিজ। নিরাশপুরের আশার প্রতীক নবজাত শাহজাদাকে সযত্নে দরবার কক্ষে নিয়ে এসো।

দাসী : জো হুকুম জাঁহাপনা।

Leave a Reply

Your identity will not be published.