দেড়যুগের ব্যবধানে ভুলে গেছি। ধরে নেয়া যাক নাম ছিল তার ‘সুবিক সুন্দরী’। সুডৌল গড়ন। মোটা মতো মুখাবয়ব। চ্যাপ্টা নাক। উজ্জ্বল ফর্সা রং। আধুনিক পরিচ্ছদে বড় আকর্ষণীয়া। ফিলিপিন্সের সাংবাদিক। আমাদের ম্যানিলা ভ্রমণের ক’টি দিন সঙ্গ দিতে যোগ দেয় ভ্রমণদলে। সমপেশার স্থানীয়ের সঙ্গে অতিথির মেলবন্ধন ঘটাতে আমন্ত্রণকারীদের এ আয়োজন। ভ্রমণপরিক্রমাকালে সে যত কাছে ঘেঁষে, আমি তত দূরে।
বেরসিক নই মোটে। ম্যানিলায় ওয়েলকাম ডিনারের রাতে দাগা খাই কেতাদুরস্ত কর্পোরেটসুন্দরী ডিভিনা ডিলিয়নের কাছে। সেই দাগার পর ভ্রমণের হাসি-হুল্লোড় কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার এন্তার এন্তেজাম সুবিক সুন্দরীর।
লাজুক-আড়ষ্টতার শানে নুযুল অগ্রজ কবি হাসান হাফিজের শিখিয়ে দেওয়া কয়েকটি ‘তাগালোগ’ বাক্য। তাগালোগ ফিলিপিন্সের ভাষার নাম। আশিয়ানের ছয় দেশ যাচ্ছি শুনে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাগালোগের কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দিলেন হাসান ভাই। বললেন, প্রয়োজনে কাজে লাগবে। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী বটে! ম্যানিলা পৌঁছানোর রাতেই ভাষা জাহির করতে গিয়ে দাগা খেতে হলো। পরে শহর-নগর পরিভ্রমণে ফিলিপিনোফোবিয়ায় আক্রান্ত হলাম। লাস্যময়ীদের এড়িয়ে চলাই যেন বড় কাজ হয়ে দাঁড়াল।
জুনের অপরাহ্নে ‘নিনো আকিনো’ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রেখে মনে হলো, আসিয়ানভুক্ত দেশে পুরুষের চেয়ে নারীকণ্ঠের কলরব আকাশ ছুঁইছে। নিনো এ্যাকুনোই ডেস্কে মধুর কণ্ঠের কলরব। বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে এসেছে দুই রূপসী। আঁটোসাঁটো পোশাকে কেতাদুরস্ত। গৌড়বর্ণা। ক্ষুদ্রচোখ। বৃহদাকার মুখমন্ডল। চ্যাপ্টা নাসিকা। মুখে পরিষ্কার ইংরেজি। কথাবার্তায় লাস্যময়ী, হাসি-ঠাট্টায় পারদর্শী। হাসান ভাইকে ধন্যবাদ দিই মনে মনে, এমন দেশে এসে পড়েছি, তার শিখিয়ে দেওয়া তাগালোগ এস্তেমাল করা যাবে এন্তার।
সন্ধ্যায় পাঁচ তারকা হোটেল ম্যান্ডারিন অরিয়েন্টালে ওয়েলকাম ডিনারের আয়োজন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। আসিয়ানে মেয়ে বেশি— এ ধারণা আরও পোক্ত হয় ডিনারে অভ্যাগতদের ঝাঁক ঝাঁক জটলা দেখে। দেখি, স্থানীয় যারা যোগ দিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগ তন্বী-তত্রুণী। একজন অতিথিকে ঘিরে দু’তিনজন। এধরনের ডিনারের মেইনকোর্স খাওয়া বিলম্বিত হয়। শুরুর দিকে চলতে থাকে অতিথি আগমন, ফিসফাস, পরিচয়। এখানেও চলছে পরিচয়-কুশল-গুঞ্জন। হাতে হাতে জুস-শরবত-রঙিন শরাব। ঢুলু ঢুলু চোখে সবাই এদিক-সেদিক হেঁটে আলাপ-গুঞ্জন-পানমত্ত। একজনকে ইশারায় ডেকে নিঃসংকোচে তাগালোগ এস্তেমাল শুরু করে দিলাম, ‘মাগান্দা বাবায়ে— এ্যাই সুন্দরী, এদিকে এসো।
সুন্দরীদের কেউ কেউ বাহুলগ্ন হওয়ার আদলে কাছ ঘেঁষে আকুল আগ্রহে আলাপে উন্মুখ। নয়নকাড়া একজনকে বললাম, ‘মাবু হ্যায়’—কেমন আছো?
উত্তর এল, ‘মাবু তি’—ভালো।
তারকা হোটেলের বলরুমে সুপরিসর জলসাঘর আলোয় আলোয় ভরা। ঝলমলে পোশাকে নরনারীরাও কুজন-কোলাহলে উদ্ভাসিত। স্থানীয়দের মাতৃভাষায় কথা শুরু করেছি দেখে আহ্লাদে ডগমগ অনেকে। আলাপআগ্রহীরা ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘিরে দাঁড়াল। বেশিরভাগ কথা চলছে ইংরেজিতে। বেয়ারারা ঘুরে ঘুরে এ্যাপিটাইজারের প্লেট অভ্যাগতদের সামনে ধরছে। তাতে ফ্রাইড মাশরুম, চিকেন উইংস, ফিসফিঙ্গার। আলাপচারিতার পরিবেশ উষ্ণতায় রূপ নিলে একজনকে ডেকে নিই আলাদা। ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে ফেলি, ‘মাহাল কিতা? কাম অন’। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মুহূর্তে ধাক্কা এল। কথার ধাক্কা। পানাহারের প্রভাবে একটু অনবধান হলেও হিসেবে সে পাক্কা। মুখে মুচকি হাসি ধরে রেখে ‘তাগালোগ’ ভাষায় অনতিদূরে আলাপরতা মেজবানসুন্দরী ডিভিনা ডিলিয়নকে কী সব বলল। তাগালোগ বাক্য হাসান ভাই শিখিয়ে দেন নি, আমিও শিখি নি। সুন্দরী ডিভিনা ডিলিয়ন হোস্টপক্ষের বড় কর্তা। কপট হাসিতে ইংরেজিতে সতর্ক করল— ‘ডিয়ার, এটা ম্যানিলা, ব্যাংকক নয়। আর কোনো ফিলিপিনোকে একথা না বলাই উত্তম। ফিলিপিনোরা বহিরঙ্গে আধুনিক, মননে ধর্মপ্রাণ। পরপুর“ষকে ভালোবাসায় গোঁড়ামি আছে তাদের।’
অতিথিকে এর চেয়ে মধুরকণ্ঠে সতর্ক করার ভোকাবুলারিময় বাক্য আর বুঝি হয় না। সুন্দরী ডিভিনার মুখ ইতিমধ্যে শক্ত ও রক্তিমবর্ণ। নিঃসৃত বাক্যগুলো কানে অসহ্য ও কর্কশ শোনাচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে মেইন কোর্সের দিকে পা বাড়াই।
বন্ধুভাগ্য
ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা যাওয়া ঠিক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আখতারকে ই-মেইল করি: ‘আখতার, আসছি। সময় দিতে তৈরি থেকো’। বিকালে নিনো একুইনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর মধ্য জুনের আবহাওয়া মন চনমনে করে দিল। ইমিগ্রেশন পার হতেই একঝাঁক ফিলিপিনো সুন্দরীর অভ্যর্থনা। দু’জনের গাইডেন্সে মাকাতি এভিনিউ’র হোটেল তক যাত্রা আরও সুখকর হলো। পাঁচতারকা হোটেল ম্যান্ডারিন ওরিয়েন্টালে র“ম বরাদ্দই ছিল। ফ্রন্টডেস্ক থেকে চাবি নিয়ে র“মের দিকে পা বাড়াতেই তন্বি ফিলিপিনো নিয়ে এল ওয়েলকাম ড্রিংকস। কক্ষে অপেক্ষা করছিল আরেক চমক। বিশাল আকারের গিফট হ্যাম্পার। হোস্ট কোম্পানির ম্যানিলায় স্বাগতপত্র, দামি কলম, প্যাড, কোর্টপিন, গেঞ্জি, টুপি সংবলিত ব্যাগ। সবকিছুতে লেখা একটি নাম ‘মালাম্পায়া’। এই ভ্রমণে আসলে দেখতে এসেছি ফিলিপিন্সের ‘মালাম্পায়া’ সাগরপ্রান্তিক জ্বালানিযজ্ঞ। প্রকল্পসুবাদে আগুসুহিন উপত্যকার যাযাবর জেলেজীবনের দিনবদল।
পূর্ব কথামতো বন্ধু আখতারকে ফোন করে রুম নম্বর দিলাম। আখতার পরিবারের সঙ্গে কিশোর বয়স থেকে ম্যানিলার বাসিন্দা। আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত তার বাবার পোস্টিং সেখানে। মা-ভাইবোনসহ ম্যানিলাবাসী থাকতেই আমাদের সঙ্গে সে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা মধ্য আশির দশকে।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে কাপড় পাল্টানোর মধ্যেই দরজায় বেল। দরজা খুলে দেখি আগš‘ক সতীর্থ বন্ধু আখতার। চোখে ভারী লেন্সের চশমা, মুখে যুবক বয়সের সেই ব্রণ, গভীর বুদ্ধিময় চোখ। স্বল্পবাক আখতার বয়সে আমার ছোট। পাওয়ারওলা চশমায় বড় ও গম্ভীর লাগত। কিš‘ ম্যানিলার এই মন ফুরফুরে সন্ধ্যায় তাকে আমার চেয়ে ছোট, প্রাণবন্ত, কথাপ্রিয় ও প্রাণোচ্ছ্বল মনে হলো। ভাবলাম, সন্ধ্যাটা কাটবে ভালো।
‘দোস্ত, তাড়াতাড়ি চলো। বাইরে আনন্দজোয়ার। ভরসন্ধ্যায় এ শহরে ঘরে বসে থাকার মানে নেই’ বলে আখতার তাড়া দিল।
জুতোয় পা ঢুকিয়ে ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বললাম, ‘চলো।’
মাকাতির আয়ালা থেকে বাসে ‘হিল পুইয়ান’ রেলস্টেশনের স্টপে নামলাম। আখতারই গাইড। এ নগরে নতুন আগš‘ক বলে আমি তার ফলোয়ার। হিল পুইয়ান থেকে মেট্রোরেল চাপলাম। অফিস ফেরতা মানুষের গিজগিজানো ভিড়। এখানেও সেই একই কথা, ছেলের তুলনায় মেয়ে বেশি। স্টাইলিশ, আধুনিক পোশাকসজ্জিত, নানারকম চেহারা। নারীপু্রুষ ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়ানো। দেশবিদেশের পর্যটকের পাশাপাশি লাস্যময়ী নাকচ্যাপ্টা ফিলিপিনো। ভেদাভেদ নেই। একমাত্র পরিচয় তারা সব গন্তব্যগামী। বাঙালি মুসলিম আত্মপরিচয়ের রক্ষণবাদী মানসপটে অস্বাভাবিক। এখানে রক্ষণশীলতার ভাবনাই যেন অস্বাভাবিক।
মেট্রোর ডিজিটাল সাইনে যখন ‘ইউনাইটেড নেশন’ নামটি স্ক্রলড হয়, আমরা নেমে পড়ি। মানে আমরা নামলাম জাতিসংঘ স্টেশনে। ওপরে উঠলেই আকাশস্পর্শী ভবনের সারি চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আমাদের বা আমার। মার্কিন মুলুকে জাতিসংঘের সদর দফতর দেখেছি আগে। এশিয়ার আ লিক দফতর চোখের সামনে আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসে। ম্যানিলায় এই এক মজা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সদর দফতরসহ অনেক বিশ্বসংস্থার এশীয় অফিস। বহুতল ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেট হাউজ।
‘একদিকে আকাশছোঁয়া দালান, অন্যদিকে বিস্তর বস্তি। এ নগরে সবই আছে’ আখতার জানাল।
মেট্রো ম্যানিলার রাস্তায় রাস্তায় আমরা ইতিউতি হাঁটি। ছোটবেলার সেই মক্কা-মদীনা বায়োস্কোপওলার ছড়ার আদলে আখতার একের পর নাম বলে ভবন দেখায়, আমি দেখি। এইটা এডিবি হেড অফিস, ওইটা জাতিসংঘ, এইটা অমুক ব্যাংক, সেইটা তমুক ব্যাংক। ভবন দেখি, রাস্তা দেখি, রাস্তায় সারবাঁধা গাড়ি আর মেট্রোম্যানিলার মানুষ। কর্পোরেট মানুষ, আমার মতো বিস্ময়বিমুগ্ধ পর্যটক মানুষ, ছাপোষা চাকুরে মানুষ। আমার কাছে এ শহর নতুন। যা দেখি, তাই ভালো লাগে।
ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি এলে বললাম, ‘আখতার চলো কোথাও বসি, কিছু খাই।’
আখতারের সে পরিকল্পনা দাগানোই ছিল। না বললেও কিছুক্ষণের মধ্যে সে রেস্তোরাঁয় ঢুকত। আমরা ‘ম্যাক্স’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে বসলাম। ফিলিপিনো স্টাইলের খাবারের জন্য এর নাম। আখতার মেনু দেখে অর্ডার করল। দু’বন্ধু উদরপূর্তি করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে কাটাই। তারপর সান্ধ্য আঁধারে আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াই।
আখতার বলল, ‘রাত নেমেছে। এখন মাবিনি’র দিকে দেখার মজা।’
বললাম, ‘মাবিনি কী?’
‘মেট্রোপলিটান সিটির নাইট লাইফ এলাকা। আনন্দের হাটবাজার।’
হাঁটতে হাঁটতে মাবিনি এন্টারটেইনমেন্ট এরিয়ায় পা রাখি। চারদিকে বাদ্য বাজনা, নাচ-গান, তর“ণ-তর“ণীর হুল্লোড়। নগরীর সব তরুণ-তরুণী যেন ভেঙে পড়েছে মাবিনিতে।
আখতার আনন্দ কোলাহল আর চোখ ধাঁধানো আলো থেকে চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করল। দূরে বহুতল ভবনের ফাঁকে অপরূপ পূর্ণচন্দ্র মায়াময় আলো ছড়াচ্ছে। সে আলো নগরীর কৃত্রিম রঙা থেকে অনেক বেশি স্থায়ী। আখতারের কথায় সংবিত ফিরল আমার। সে বলল, ‘বন্ধু, এ চন্দ্রালোকিত রাত। এ রাত আনন্দ কোলাহলে মিশে যাওয়ার রাত।’
মালাম্পায়া
পশ্চিম ফিলিপিন্স গভীর সমুদ্রবক্ষের জ্বালানিক্ষেত্র। ম্যানিলা থেকে পাঁচ শ’ কিলোমিটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় পালাওয়ান আইল্যান্ড। যেখানে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ভূগর্ভস্থ নদীর আকর্ষণ। সৌন্দর্যময় এই কোরাল আইল্যান্ড থেকে আশি কিলোমিটার সমুদ্রগভীরে মালাম্পায়া। এই গ্যাসকান্ডকে কেন্দ্র করে শেল আর মালাম্পায়া অথরিটি সুবিক বে থেকে নদীবিধৌত সমুদ্রকূলবর্তী আগুসুহিন যেতে হয় ফেরি বা রেলে। সড়কপথ নেই। ভ্রমণের লক্ষ্য মালাম্পায়া সুবিক উপত্যকার দুর্গম আগুসুহিন দ্বীপের বদলে যাওয়া যাযাবর জেলেজীবন। মালাম্পায়া নাম খচিত গেঞ্জি, টুপি, কলম, নোটবুক নিয়ে আমরা পুরো সজ্জিত।
মালাম্পায়া ক্ষেত্রের সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে থাকা সৃষ্টির নেয়ামত এই জ্বালানি। পাঁচ শ’ কিলোমিটার দূরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাখা ঘুরিয়ে দ্বীপদেশ ফিলিপিন্সকেই শুধু আলো ঝলমল করে নি, আগুসুহিন দ্বীপের সুন্দরী গৃহবধু আর্লিং যোশিফিনের জীবনের চাকাও ঘুরিয়ে দিয়েছে। সংসারে এনে দিয়েছে প্রশান্তির প্র”ছায়া। গৃহবধূ যোশেফিন ভাতুরে স্বামী ম্যাং এমিলোকে নিয়ে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে ঘুরে যাযাবর জেলেজীবন কাটাত। এখন দুই ছেলেমেয়ে স্বামীকে নিয়ে তার সুখ অন্তহীন। মালাম্পায়া অথরিটি প্রকল্প লোকেশন ঘিরে থাকা দূরান্তের দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়নে মালাম্পায়া মাইক্রোক্রেডিট শুর“ করে। বুদ্ধিমতী সুন্দরী জেলে যোশেফিন পাঁচ হাজার পেসো ঋণে স্থানীয় ওয়ালিস ট্যাম্বো বানানোর কারখানা তৈরি করতে বিলম্ব করে নি। যাযাবর জেলেবধূ ঘরে ট্যাম্বো বানায়। এমিলো সুবিক, আগুসুহিন আর বারাংগের বাজারে বিক্রি করে। মেয়ে জেনালিনকে নিয়ে যোশেফিনও বাজারে ট্যাম্বো বিক্রি করে। একমাত্র ছেলেকে স্কুলে পাঠায়। তাদের সংসারে মালাম্পায়ার সুখ।
মালাম্পায়ার হেড অব অপারেশন্স ভ্রমণকালে বললেন, ‘যাযাবর জেলেজীবনের বদল দেওয়ার বিনা জামানতে ক্ষুদ্র ঋণের এই ধারণা তোমাদের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ধার করা।’
আমাদের খুশি দেখে কে?
সুবিক সুন্দরী অফার পিছু ছাড়ে না।
সুবিক সুন্দরী বলে, ‘চলো যাই সুবিক বে।’
বলি, ‘সুবিক কেন?’
উত্তর: ‘ভ্রমণের প্রার্থিত গন্তব্য। মার্কিন নেভাল ফোর্স-এর ঘাঁটি ছিল। জায়গাটা ঐতিহাসিক। দৃষ্টিকাড়া উপত্যকা। আছে এ্যাডভেঞ্চারের বাহারি এন্তেজাম। ম্যানিলা থেকে ৮০ কিলোমিটার। রাস্তা প্রশস্ত, মসৃণ।’
আমার নিরুৎসাহ দেখে লোভনীয় সব অফার চলতেই থাকে, ‘ভালো রেস্তোরাঁ আছে, ওয়াটারবাইক এ্যাডভেঞ্চারের জন্য আদর্শ, ডাইভ করা যায়, পাশের পাহাড়ে নির্জন বন। এন্তার ছবি তোলা, গল্পের জন্য মিলবে সঙ্গ সারাক্ষণ।’
পাহাড়-বনানীময় উপত্যকা সুবিক বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নেভির ঘাঁটি ছিল। ফিলিপিনোদের সঙ্গে মার্কিন-পিরিতির ফিরিস্তি অনেক লম্বা। ইতিহাস-ওয়েবে পাওয়া যায় কত কিছু। ১৯৯১ সালে মার্কিন ঘাঁটি গুটিয়ে যাওয়ার পর সুবিক হয়ে ওঠে বন, পাহাড়, সমুদ্রপ্রেমী ও নির্জনতাপ্রিয় ভ্রামণিকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। এসব জানি। যাওয়ার পরিকল্পনাও ভ্রমণতালিকায় আছে। কিন্তু সুবিক সুন্দরী আগ বাড়িয়ে কেন এত পটাচ্ছে? বেটি করতে চায় কী! ভাবি আর আগুপিছু করি।
প্রথম রাতের দাগার কারণে নিরুৎসাহিত কণ্ঠে বলি, ‘পাহাড়ময় উপত্যকা, ওয়াটার বাইক, ডাইভিং আকর্ষণ বটে। নির্জন বন দিয়ে কী হবে?’
উত্তর মেলে, ‘তোমার মতো বোকা মানুষ বাপু দেখি নি জীবনে দুটো। সে অরণ্যে প্রচুর পাখি। পাহাড় অরণ্যের ইলানিয়ান ফরেস্টের নির্জনতা পেতে মানুষ মোটা পেসো খরচ করে। বিনে পেসোর অফারে তোমার ইনয় বিনয় আর ভাল্লাগে না।’
দ্বন্দে পড়ি বড়। শেষমেষ এক সকালে আমাদের গাড়ি মেট্রোম্যানিলা থেকে বের হয়ে চমৎকার সড়কে ওঠে। গাড়ির গতি বাড়ে। গন্তব্য সুবিক বে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.