বেলাশেষের অবশেষ। হরিশংকর জলদাস

বেলাশেষের অবশেষ। হরিশংকর জলদাস

জেলেপাড়ার সবাই বলে, কী হইল?
মতিলাল বলল, মিছা কইল ক্যান মাইয়াডা?
রাজকুমার জেঠা বলল, রাম রাম, একী কথা! এইরকম মিথ্যা!

গুরুচরণের বিধবা পিসিটি একদলা থুতু ফেলে বলল, ছে ছে ছে। এইরকম কাণ্ড জেবনে দেখি নাই। সারা রাইত ধইরে লীলা কেত্তন, সকালে কইল, আমি সতী সাবিত্রী সীতা! রসাতলে গেলরে, পাড়াটা নরক বইনে গেল।

নকুলসর্দারের পুতের বউটি কুমারী ননদিনীর কানের কাছে মুখ এনে চাপাস্বরে বলল, দেইখ রে ননদিনী, মন চাইলে আমাগোরে কইও। আমরাই ব্যবস্থা কইরে দেব। খবরদার শিউলি হইও না। ফুলের গন্ধ ভিন পুরুষ কাউরে শুঁকতে দিয়ো না।

অহল্যা কড়াইয়ে সবজি নাড়তে নাড়তে আপনমনে বলতে থাকল, কিছুই তো বুইঝতে পাইরলাম না! শাশুড়ি মা বইলত, শাস্ত্র নাকি কইছে— মাইয়া মাইনষের বহুরূপ। তাদের চরিত্রখান নাকি দেবতারাও বুইঝতে পারে না। কথাখান মাইনে নিতে পারি নাই তখন। অহন বুঝি, শাস্ত্র মিছা কথা কয় নাই। শিউলি পরমান কইরে ছাড়ছে— শাস্ত্র হাঁচা কইছে।

বিচারদিনের আগের রাত। গভীর। দুই প্রহর পেরিয়ে গেছে। গোটা জেলেপাড়া সুনসান। মাঝে মাঝে পাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো ডেকে উঠছে। শফির খামারের দিক থেকে দলবাঁধা শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে—হুক্কা হুয়া। জেলেপাড়ার সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু তিনজন মানুষ জেগে আছে, মহেন্দ্রের ঘরে। মহেন্দ্র, গৌরী আর শিউলি। জোগেন্দ্র আর নিতাই আজ সমুদ্র গেছে। চণ্ডী ঘুমাচ্ছে তার ঘরে, অঘোরে। অন্যান্য ছোটছাটকরা তাদের নির্ধারিত ঘরের মেঝেতে বিছানো চাটাইয়ে এলেবেলে শুয়ে আছে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি তাদের শরীরে। গোটাপাড়ায় সারা দিন যে গোত্তা খেয়ে বেড়ায় ওরা।  

গৌরীর বিছানার ওপর মুখোমুখি বসেছে তিনজনে। শিউলি অধোবদনে। গৌরীর চোখেমুখে গহিন উৎকণ্ঠা। ভয়াবহ এক বিষণ্ণতা মহেন্দ্রের সারা মুখে লেপ্টে আছে। মহেন্দ্রের শরীরটা এই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে মাটিতে মিশে যাবে। বহুক্ষণ ধরে কী একটা কথা বলবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে মহেন্দ্র। কিন্তু বলতে পারছে না। মনে জোর নিয়ে সে মুখ তোলে, গৌরীর দিকে তাকায়, শিউলির দিকে তাকায়। শিউলির দিকে তাকানোর পর কেন জানি মহেন্দ্র কুঁকড়ে যাচ্ছে। দ্রুত শিউলির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এরকম করলে তো চলবে না। গত দিন এবং আজ রাতের অর্ধেকটা পর্যন্ত স্ত্রী আর কন্যাকে যা বলবে বলে ভেবে রেখেছে মহেন্দ্র, তা না বললে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে! সর্বনাশ কি কম হয়েছে তার? জোগেন্দ্র-নিতাই আর চণ্ডীর গোঁয়ার্তুমির কারণে শিউলির কলঙ্কের কথা পাড়ায় এবং পাড়ার বাইরে চাউড় হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারে নি মহেন্দ্র। তাদেরই কারণে তিল তাল হয়ে গেছে। চৌকিদার এসে আগামীকালের বিচারের কথা বলে গেছে। বিচারে কী হবে তা অনুমান করতে পারছে মহেন্দ্র। বয়স তো তার কম হলো না। ঘটনাটির জন্য তো উভয়েই দায়ী। বামুনের পোলা অপূর্বের চেয়ে বরং তার মেয়ে শিউলি বেশি দায়ী। কারণ সে সীমানা ডিঙিয়েছে। শিউলিই তো নিজের ঘর থেকে বামুনের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হবে শিউলিই তো বেশি। জেলেসমাজে এই ধরনের অপরাধের শাস্তি কী, তা মহেন্দ্রের অজানা নয়। নির্ঘাত ঢেণ্ডেরি  হবে দুজনার। ঢেণ্ডেরি র পদ্ধতি আর প্রতিক্রিয়া যে কী ভীষণ, তা ভালো করে জানে মহেন্দ্র। ঢেণ্ডেরি  থেকে বাঁচার একটা পথ আছে বটে। তা অভিযুক্ত দুজনকে বিয়ে করিয়ে দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। দুজন যে দুই জাতের। একজন জেলে, অন্যজন ব্রাহ্মণ। বামুনে আর জেলেতে বিয়ে হওয়ার নয়। সমাজ সেটা মেনে নেবে না কিছুতেই। জেলেসমাজের চোখে এরচেয়ে গর্হিত কাজ আর নেই। তাহলে ঢেণ্ডেরি র শাস্তিই মাথা পেতে নিতে হবে দুজনকে।

এখানে আরেকটি আশঙ্কার কথা থেকে যায়—যে ব্রাহ্মণ তাদের কুলগুরু, যে ব্রাহ্মণ সারা জীবন তাদের পুজোআচ্চা করে আসছে, সে ব্রাহ্মণের ছেলেকে ঢেণ্ডেরি র শাস্তি জেলেরা মেনে নেবে কি না সন্দেহ। গতকাল তার উঠানে সমবেত অনেকের কঠিন চোখমুখ দেখেছে মহেন্দ্র। অপূর্বের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারটি ওরা যে মেনে নিচ্ছিল না, তা সহজে বুঝতে পেরেছে সে। তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি সালিসে আওয়াজ তোলে—বামুনের পোলাকে কী কইরে শাস্তি দেবেন চেয়ারম্যানসাব? মস্তবড় পাপ হইয়ে যাবে আমাদের। সমস্ত জেলেসমাজ ব্রাহ্মণের অভিশাপে জ্বলে পুইড়ে খাক হইয়ে যাবে। সমাজের এইরকম কথা শুনে চেয়ারম্যান হয়তো ভড়কে যাবেন। আওয়াজ তোলাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না তিনি। সকল শাস্তি তখন শিউলির ওপর এসে বর্তাবে। অপূর্বের হয়তো দু-তিন হাজার টাকা জরিমানা করবেন, ঢেণ্ডেরি দেবেন শিউলিকে। বামুনের পোলাটার বিয়ে হবে একদিন, কিন্তু সতিত্ব হারানোর কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সারা জীবন বাপের বাড়িতে অবিবাহিত জীবন কাটাতে হবে শিউলিকে।

এইসব কথা ভাবতে গিয়ে শিউরে শিউরে উঠেছে মহেন্দ্র। শিউলিকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? সারাটা সময় ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি বের করল মহেন্দ্র। সেই কথাটা বলবার জন্য আজ এত রাতে স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে বসেছে মহেন্দ্র। কিন্তু সেই কথাটা বলতে গিয়ে বারবার শরমে মরে যাচ্ছে সে।

বিকালের দিকে একবার ভেবেছিল, দুই সহোদর আর চণ্ডীর সঙ্গে পরামর্শ করবে ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু মন বলেছে—তা ঠিক হবে না মহেন্দ্র। ওরা কিছুতেই তোমার কথা মেনে নেবে না। উপরন্তু তোমার সঙ্গে তর্কে জড়াবে ওরা। তোমার যুক্তি আর আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ধূলিসাৎ করে ছাড়বে তোমাকে। ওদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যেয়ো না তুমি। বরং তুমি যা ভেবেছ তা-ই করো। মেয়ে তো তোমার, ওদের নয়। চণ্ডীর তো অল্প বয়স। সে যুক্তির চেয়ে শক্তিকে বড় মনে করে। ভাবে—এক ঘুষিতেই প্রত্যেকের দু’পাটি দাঁত খুলে নেব। কিন্তু বাস্তবে তা তো নয়। মন বলে, মেয়েটা তোমারই মহেন্দ্র, জীবনের এই ভুলটার জন্য, সারা জীবন মূল্য দিয়ে যাবে শিউলি। বরং ভুলটাকে চেপে যাও। তাতেই মঙ্গল।

শেষ পর্যন্ত মনকে শক্ত করে মহেন্দ্র বলল, আমরা যে কঠিন সংকটে পইড়েছি, তা তুমি বুইঝতে পারছ চণ্ডীর মা?

গৌরী স্বামীর কথা শুনেও চুপ করে থাকল। চাটাইয়ের কোনা ধরে সে মোচড়াতে লাগল।

মহেন্দ্র ধীরস্থির। অন্য দুই ভাই আর পুত্র চণ্ডীর বিপরীত চরিত্র তার। গৌরী চুপ থাকায় কোনো রাগ করল না মহেন্দ্র।

কণ্ঠকে আরও নিচে নামিয়ে বলল, কিছু বইলছ না যে?

এবার গৌরী ওপরে নিচে মাথা নাড়ল। গৌরীর এইরকম অঙ্গভঙ্গির অর্থ মহেন্দ্র বুঝল না। এই মাথা নাড়াটা তার কোন প্রশ্নের উত্তর? আগেরটার, না পরেরটার? কিছুক্ষণ ভাবল মহেন্দ্র। তারপর আগের প্রশ্নের উত্তর ধরে নিয়ে মহেন্দ্র বলল, যদি সংকটের কথা বুইঝে থাকো, তাইলে এখন আমাদের কী করা উচিত বইলে তুমি মনে করো?

গৌরী বলল, আমি কী বইলব? মাথায় কিছু আইসতেছে না? চণ্ডীর কাকাদের সঙ্গে কথা বইল্লে হয় না?

না, হয় না। ওদের মাথা গরম, অল্প বুদ্ধি। ওদের মাথা মোটা বইলে এত বিরাট কাণ্ডটা হইয়ে গেল। মহেন্দ্র একটু থামল।

এই ফাঁকে গৌরী বলল, তারপরও বলি কী, ওদের লগে কথা বইল্লে বুঝি ভালা হয়।

মহেন্দ্র বলল, না, ভালা হয় না। ব্যাপারটা আরও লেজে-গোবরে হইয়ে যাবে।

গৌরী বলল, লেজে-গোবরের আর কী বাকি আছে বলো! সমস্ত পাড়ায় ঢি ঢি পইড়ে গেছে।

মহেন্দ্র আচমকা বলে উঠল, শিউলিরে বাঁচাইতে হবে গৌরী।

স্বামীর মুখে বহুদিন পর নিজের নাম শুনে চমকে তাকাল গৌরী। বিয়ের প্রথম প্রথম চুপিসারে নাম ধরে ডাকত। চণ্ডী হওয়ার পর আর কোনোদিন গৌরী বলে ডাকল না লোকটি। আজ বহু-বহুদিন পর স্বামীর মুখে তার নাম শুনে হঠাৎ রোমাঞ্চ অনুভব করল গৌরী। কিন্তু শিহরণ প্রকাশ করার সময় এ নয়।

নিজেকে সংযত করে স্বামীর দিকে গভীর চোখে তাকাল গৌরী। তারপর বলল, তোমার কথা বুইঝতে পারছি না আমি। শিউলির কীরকম বাঁচা-মরার কথা বইলছ?

মহেন্দ্র অনেকক্ষণ চুপ থাকল। গৌরীকে কী বলবে তা যেন নিজের মধ্যে গুছিয়ে নিল। তারপর শিউলির দিকে তাকাল। দেখল— শিউলি মাথা নিচু করে আছে। তার চোখ বরাবর মেঝে অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহেন্দ্র।

তারপর তার দিন-রাতের ভাবনাগুলোর কথা গৌরীর সামনে বলে গেল।

সবশেষে বলল, শিউলি আমাদের মেইয়ে, নিতাই-জোগেন্দ্রের নয়। সারাটা জীবন শিউলি যখন বাপের বাড়িতে দাসীর মতো কাজ কইরে যাবে, তখন ওরা এগিয়ে আইসবে না। ওরা তখন ওদের সংসার লইয়া মশগুল থাইকবে। চণ্ডীও কখনো বোনকে আশ্রয় দেবে না। সারা জীবন ঘৃণার চোখে দেইখবে শিউলিরে।

তাইলে কী কইরব আমরা! গৌরী চূর্ণবিচূর্ণ গলায় বলল।

এক কাজ কইল্লে কেমন হয় চণ্ডীর মা?

কী কাজ?

অস্বীকার কইরবে। শিউলি বইলবে—সে অপূর্বর ঘরে যায় নাই। তাদের মইধ্যে প্রেম নাই। গত রাইতে দুইজনের মইধ্যে কিছুই হয় নাই। মৃদুকণ্ঠে বলল মহেন্দ্র।

কী বইলছ তুমি!  বিস্মিত গৌরী বলে ওঠে।

এইটাই শিউলির বাঁচার উপায়।

তাইলে জোগেন্দ্র-নিতাই-চণ্ডীর কী হইবে? বিচারে তো ওরা দোষী হইবে। অপূর্বরে নির্যাতনের অপরাধে কঠিন শাস্তি হইবে ওদের। ওরাও তো ক্ষেইপে যাবে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড কইরে ছাইড়বে ওরা। বলল গৌরী।

মহেন্দ্র গৌরীর শেষের কথার আগে উত্তর দিল। বলল, ওদের বুঝাইয়া বইলব আমি। ওরা বুইঝবে আমার কথা। চেয়ারম্যান সাব বুদ্ধিমান মানুষ। শিউলির কথা শুইনে সবকিছু বুইঝে ফেইলবেন তিনি। আমাদের শাস্তিটা টাকার ওপর দিয়া যাইবে। চেয়ারম্যান জরিমানা কইরবেন আমাদের। মহেন্দ্রের বুক বিদীর্ণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তারপর বলল, মেইয়েরে বুঝাইয়া কও কী কী বইলতে হইবে আর কীভাবে বইলতে হইবে। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে দিল মহেন্দ্র। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দ্রুত দরজা খুলে উঠানে বেরিয়ে এল সে।

পরদিন নকুল সর্দারের কাছে শিউলি যা যা বলল, তার সবটাই সাজানো, সবটাই পূর্বপরিকল্পিত।

বিচারের ফলাফল যা আন্দাজ করেছিল মহেন্দ্র, ঠিক সেরকমই হলো। চেয়ারম্যান সবকিছু বুঝতে পেরেও জেলেসমাজনীতির কথা চিন্তা করে, হালকাচালে বিচারটা করে সালিস থেকে উঠে গেলেন।

বিচারকাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, মানে বিচারদিন সন্ধ্যায় বা রাতে বা তার পরের দিন এমনকি সপ্তাহ-মাস পরেও মহেন্দ্রের বাড়ির ভেতর থেকে কোনো টো-ফো শোনা গেল না। অন্তত শিউলি বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক হলো না মহেন্দ্রের পরিবার-পরিজনদের মধ্যে। অন্য দশটা দিনের মতোই চলতে লাগল মহেন্দ্রদের সংসার।

তবে পরিবর্তন যে কিছু হয় নি, এমন নয়। তা সূক্ষ্মচোখে তাকালেই বোঝা যায়। সাদাচোখের মানুষদের পরিবর্তনটা বোঝার ক্ষমতা নেই। নিতাই আর চণ্ডীর মারমুখী স্বভাবটা কেমন মিইয়ে গেছে। আগে পাড়ার মধ্যে ওরা যে উদ্ধতভঙ্গিতে চলাফেরা করত, তা তাদের আচরণ থেকে কোথায় উবে গেছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে রূঢ়ভাবে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে তারা। কী রকম আপনমনে ওরা পথ হাঁটছে।

জেলেপাড়ার সহজ-সরল লোকেরা বলল— ঘটনা কী? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। যে নিতাই কথায় কথায় শালা-বানচোত করে, সে নিতাই যে আজকাল বোবা বনে গেছে!

অন্যদল বলল, বোবা বইনে যাবে না তো কী বইনে যাবে, হ্যাঁ? মুখে যে কলঙ্কের কালি লেইগেছে।

মাছভর্তি নৌকা কূলে ভিড়লে জেলেপাড়ার গরিবগুর্বারা নৌকার কাঁড়া ধরে বলে, অ কাকা, আমারে দুইডা মাছ দাও না। হরিধন বলে, অ নিতাইদা, জামাই আইছে ঘরে, চালটা জোগাড় হইছে, তুমি অল্প মাছ দিলে তরকারির সুরাহা হয়। দিবানি এক মুঠ মাছ? তাইলে মেইয়ের সোয়ামির সামনে মুখ রক্ষা হয়।

অন্য সময় হলে নিতাই ঝাঁজিয়ে উঠত, যা যা, দূরে যা। মাছ কি দইজ্যায় ভাসি যায় যে তোমার ভাইড়ে মুঠা মুঠা তুইলে দি। তারপর হরিধনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলত, তা হরিধন, তোমার ঘরে জামাই আইছে আমার কী? তোমার জামাইরে মাছ খাওয়ানোর দায় নিছি নি আমি? মেয়ে বিয়া দওনের সময় মনে থাকে নাই নি— জামাই বেড়াতে আইলে ভালোমন্দ খাওয়াতে হইবে?

তারপর চোখে আর একটু আগুন ঢেলে বলত, এখন মক্ত-আল্লা মাছ দিতে পারুম না। এক টাকার মাছও বেচলাম না এখনো। ডুলা একটা লইয়া ঘ্যানর ঘ্যানর কইরতেছ—দিবানি এক মুঠ মাছ?

এরপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত নিতাই। আপনমনে বলত, যত্তসব মাগইন্যার জাত!

এখন সেই নিতাইয়ের কী হলো কে জানে! চাইবার আগে হরিধনের ডুলায়, রাধামাধবের খাড়াঙে, ফুলির মায়ের ভাইড়ে মুঠো মুঠো মাছ তুলে দেয়। গালিগালাজের চেহারা তো দূরের কথা, কী রকম প্রসন্ন প্রসন্ন মুখ নিতাইয়ের।

কিন্তু সেই প্রসন্নতার অন্তরালে কী যে এক গভীর বিষাদের আবরণ নিতাইয়ের গোটা চেহারাকে ঘিরে আছে, তা এই হতদরিদ্র জেলেদের বোঝার ক্ষমতা নেই।

যে চণ্ডী দিনে দু-একজনের গালে চড়-থাপ্পড় না মারলে সুখ পেত না, রোহিতপুরি লুঙ্গি পরে, গলায় বাহারি রুমাল জড়িয়ে কানে আতরমাখা তুলা গুঁজে, শিস কেটে কেটে পাড়ায় ঘুরত যে চণ্ডী, সে এখন কী রকম চুপসে গেছে। পাড়ায় ঘোরা তো দূরের কথা, সহজে ঘর থেকেই বের হয় না চণ্ডী। বের হলেও মাথা নিচু করে পথ ফুরায়।

এসবের পেছনের হেতু সাধারণ জেলেরা না বুঝলেও বুদ্ধিমান জেলেরা বুঝে গেছে—শিউলি প্রবল একটা ঝটকা দিয়েছে মহেন্দ্রের বাড়ির গরিমাতে। তারা বুঝেছে—শিউলির সেদিনের সত্য-অস্বীকারের মূল কারণ কী? এর পেছনে যে অতিঠান্ডা একটা মাথা কাজ করেছে—তা সর্দার-মুখ্য-সুধাংশু-শিবশঙ্করদের বুঝতে বেগ পেতে হয় নি।

সালিস থেকে জোগেন্দ্র-নিতাই-চণ্ডী মাথা গরম করে উঠে গিয়েছিল। মহেন্দ্র অতি শান্তভাবে সমস্ত কিছু মোকাবিলা করে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। চোখে-মুখে জগভর্তি শীতল জলের ঝাপটা দিয়েছিল। গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটুক্ষণ। বলেছিল, ‘আমি ওদের সঙ্গে কথা কইতে যাইতেছি। দরজা না খুলি পর্যন্ত ওদিকে যাইবা না।’

জোগেন্দ্র, নিতাই আর চণ্ডী— তিনজনে একটা ঘরে বসে ছিল। সবাই ক্রোধে উন্মত্ত। সবারই রাগ মহেন্দ্রের ওপর। কেন এরকম করল দাদা? কেন এরকম করল বাবা? শিউলির অস্বীকারের পেছনে যে মহেন্দ্রের হাত আছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি ওদের।

মহেন্দ্র ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠল নিতাই। রাগে চক্ষুগোলক বেরিয়ে আসতে চাইল জোগেন্দ্রের। অভিমানে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল চণ্ডী।

মহেন্দ্র মুখবুজে সবকিছু সহ্য করে গেল। ওদের গরজানো আর হম্বিতম্বি কমে এলে উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল মহেন্দ্র।

তারপর নিতাইয়ের গা ঘেঁষে বসে মৃদু গলায় বলল, জানি, আমার ওপর তোমাদের বিষম রাগ। কিন্তু আমি নিরুপায়। এরকম করা ছাড়া আমার আর কুনু পথ ছিল না।

নিতাই চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠল, কিসের নিরুপায়। তুমি এমন কী পথটা হারাইয়া বইসা আছ যে কলঙ্ক মাথার উপর টাইনা নিলা!

কলঙ্ক মাথার ওপর টাইনা লই নাই। কলঙ্ক হইতে মুক্তি পাইতে চাইছি। শিউলির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কইরা এইরকম করছি ভাই। বলে গেল মহেন্দ্র।

বাবা, কী কও তুমি বুইঝবার পাইরেতছি না কিছু। অভিমানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল চণ্ডী।

বাপ চণ্ডী, তোর বয়স কম। তুই আমার সব কথা বুঝবার পারবি না। বুঝাইলেও মাইন্যা নিবি না তুই।

আমাগোরে বুঝাও। চণ্ডী না বুইঝলেও আমরা বুঝুম। ওর চেয়েও আমাগোর বয়স বেশি। জোগেন্দ্রের শেষ কথাতে ব্যঙ্গের আভাস।

দেখো ভাইয়েরা, শিউলি মাইয়ামানুষ। ওই কথাটা সে যদি স্বীকার কইরে নিত, কুনুদিন বিয়া হইত না তার। সারা জীবন কলঙ্কের বোঝা বইয়া বেড়াইতে হইত তারে। শিউলি স্বীকার করে নাই মাইনে সে সতী। তার কুনু কলঙ্ক নাই।

মাইনে! কী বইলতে চাও তুমি? সইত্যরে মিথ্য দিয়া ঢাইকতে চাও? নিতাই গরম গলায় বলে।

মহেন্দ্র ঠান্ডা গলায় বলে, এ ছাড়া আমাগোর আর কুনু পথ নাইরে ভাই। যারা দেইখছে, তারা জাইনছে। যারা দেখে নাই, তারা বইলবে—ঘটনাটা মিথ্যা। পূর্বশত্রুতার জের ধইরে শিউলিরে টোপে ফেইলা আমরা বামুনদের মারধর করছি। শিউলির শ্বশুরপক্ষের মানুষজনদেরও আমরা এই কথা বইলতে পারব।

শিউলির শ্বশুরপক্ষ মাইনে? তিনজনে একইসঙ্গে বলে উঠল।

হ। শ্বশুরপক্ষ। এখন থেইকে আমরা শিউলিরে বিয়া দওনর লাইগা জোর তদবির শুরু করুম। গেরামে গেরামে খোঁজখবর লমু। দুই-চাইরজন ঘটকের লগে যোগাযোগ করুম। কোথাও-না-কোথাও শিউলির বর জুইটে যাবে।

নিতাই কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

মহেন্দ্র আবার বলল, টাকা আছে আমাগোর। টাকা দিয়া বররে কিন্যা লমু।

সত্যি তা-ই। এই রকমই হলো শেষ পর্যন্ত। মহেন্দ্র শিউলির বরকে কিনে নিতে পেরেছিল।

খুঁজতে খুঁজতে টেকনাফে মধুসূদনের সন্ধান পেয়েছিল মহেন্দ্ররা। টেকনাফের একটেরে পলাশপুর গাঁ। ও গাঁয়ের সমুদ্রঘেঁষে ক’খানা জেলেবাড়ি। মানুষরা বলে ডোমপাড়া। ওই ডোমপাড়ার চনারামের বড় ছেলে মধুসূদন। বাপে-বেটায় মিলে সমুদ্রে মাছ ধরে সংসার চালায়। মধুসূদনের বয়স কম হলো না। এক কুড়ি দশ বছর তো পেরিয়ে গেছে সেই ফাল্গুনে। টাকার অভাবে ছেলেকে বিয়ে করাতে পারছে না চনারাম।

মহেন্দ্রদের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব চনারামের কাছে পৌঁছালে প্রস্তাবটা লুফে নিল চনারাম। বলল, ছেইলেরে বিয়া করানোর ক্ষেমতা নাই। বিয়া করানোর মতো টাকাপয়সা জমাইতে পারি নাই কুনুদিন। এখনো হাতখালি। মেইয়ের বাপ যদি বিয়ার দায়িত্ব লয়, আমাগোর কুনু আপত্তি নাই। ছেইলে আমার ঢেউ ধইরে রাখার শক্তি রাখে শরীলে। শ্বশুরবাড়িতে মেইয়ে অসুখে থাইকবে না।

ঘটক বীরেশ্বর শর্মা চনারামের কথাগুলো মহেন্দ্রের কাছে পৌঁছালে খুশির সীমা থাকল না মহেন্দ্র-পরিবারের।

এক অপরাহ্ণে উত্তর-পতেংগা জেলেপাড়ার মানুষেরা দেখল—একদল বাজনাদার ঢোল-দগড়-সানাই-কাঁসর বাজাতে বাজাতে মহেন্দ্রদের বাড়িতে ঢুকছে। তাদের পেছনে জনাপাঁচেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়ের মানুষ। তাদের হাতে গোটা তিনেক মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির মুখ কাগজ দিয়ে ঢাকা। হাঁড়িতে জিলাপি-কচড়ি।

পরদিন ভোরে ভোরে শিউলিকে নিয়ে মহেন্দ্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল বরযাত্রীরা। উত্তর পতেংগা থেকে টেকনাফ অনেক দূর। বিয়েটা নামন্ত বিয়ে। দিনশেষে রাতে চনারামের উঠানে বিয়েটা হবে। তার আগেই সপরিবারে মহেন্দ্র চনারামের বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

মহেন্দ্র বিয়ের সকল খরচপাতি মিটাল। উপরন্তু বেয়াইয়ের হাতে দশ হাজার টাকার একটা বান্ডেল গুঁজে দিল। উত্তর পতেংগার গোটা জেলেপাড়া তাজ্জব বনে গেল। মানুষেরা ভাবতে বসল— এও কী সম্ভব!

যাওয়ার আগমুহূর্তে গৌরী শিউলির কানের কাছে মুখ নিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলেছিল, মনে রাখিস।

কান্না থামিয়ে চট করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল শিউলি। গৌরী বলেছিল—

পুরুষ তমালতরু প্রেম অধিকারী, নারী যে মাধবীলতা আশ্রিতা তাহারি।

দুই

শিবশঙ্কর বোনাই জগবন্ধুর বাড়িতে থাকবার জন্য আর ফিরে যায় নি। এর মধ্যে থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেরিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করে, দিন কয়েক ক্লাসও করে ফেলেছে। যাতায়াতে ভীষণ দুর্ভোগ। ভোরে উঠে আট মাইল ঠেঙিয়ে বটতলি রেলস্টেশন। সেখান থেকে ভার্সিটির ট্রেনে করে যাওয়া। রেলস্টেশন ক্যাম্পাসের বাইরে। মাইল দেড়েক হেঁটে তারপর বাংলা বিভাগ। ক্লাস শেষে সব সময় ট্রেন ধরতে পারে না শিবশঙ্কর। ক্যাম্পাস থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত অন্যেরা রিকশায় এলেও হেঁটে আসে শিবশঙ্কর। তার পকেটে রিকশাভাড়া গোনার মতো বাড়তি টাকা থাকে না। যেদিন ট্রেন মিস করে বাসেই ফিরে সে। চট্টগ্রাম শহর, শহর থেকে উত্তর পতেংগায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।

তারপরও শিবশঙ্কর ঠিক করে, মাইজপাড়ায় সে আর ফিরে যাবে না। বাপকে নিয়ে একবার গিয়েছিল বোনাইয়ের বাড়িতে। ঘণ্টা কয়েকের জন্য। যাওয়ার আগে বাপ সুধাংশুকে শিবশঙ্কর বলেছিল, আমি যে আর থাকতে আসব না, তা বোনাইকে বুঝিয়ে বলো। রাগী মানুষ। রাগী মানুষেরা আবেগী হয় বাবা। তোমার কথায় বোনাই যাতে কোনোক্রমেই ব্যথা না পায়।

তুমি মাইজপাড়ায় গিয়া থাইকতেছ না ক্যান? এক বছর বইলতে বইলতে চইলে যেত। তোমার কষ্টও কম হইত। আমি বলি কী আর একটা বছর না হয় থাইকে আসো। বলেছিল সুধাংশু।

শিবশঙ্কর বলেছিল, বাবা, বোনাইয়ের বয়স হয়ে গেছে। শরীরে আগের মতো জোর নেই। আগের মতো সকাল-সন্ধ্যায় মাছ ধরতে যায় না বোনাই। মনের বলটাও যেন একটু নড়বড়ে হয়ে গেছে। শেষের দিকে তার কথায় টের পেতাম।

তারপর আপনমনে কী যেন একটু ভাবল শিবশঙ্কর। বলল, আগের মতো আয় নেই বোনাইয়ের। বড়মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে বোনাই। ব্যাপারটি কাউকে বুঝতে দেয় না। কিন্তু বাবা, আমি তো বুঝি— সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বোনাই। আমি ওই সংসারে বাড়তি বোঝা। আমার জন্যও তো বোনাইকে খরচ করতে হয়।

সুধাংশু বলল, তোমার জন্য খরচ বাবদ মামাকে কিছু টাকা দিলে হয় না?

বাবা, তুমি কি ভুলে গেলে বোনাইয়ের সেই রাগী চেহারার কথা? সেবার আমার জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলে, কী চণ্ড মূর্তিটাই না ধারণ করেছিল বোনাই!

তা-ও ত ঠিক। তাইলে উপায়?

উপায় একটাই, বোনাইয়ের বাড়িতে আর থাকতে না যাওয়া। বোনাইয়ের টাকা বেঁচে যাবে। বলল শিবশঙ্কর। তা ছাড়া আমার এমএ-এর ক্লাস খুব বেশি দিনের না। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যাবে।

ঠিক আছে। তুমি যা ভালা বুঝ। সুধাংশু বলেছিল।

কিন্তু বাবা, কথা ওইটাই কোনোক্রমেই বোনাইকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। বিজয়াদিদিমণি খুবই ভালোবাসে আমাকে। একটু আউলাঝাউলা ধরনের। কিন্তু ওই অগোছালো দিদিমণির ভেতর একটা অতৃপ্ত মন আছে। সেই অতৃপ্তি পুত্রের জন্য। আমাকে দিয়ে দিদিমণি সেই হাহাকারের জায়গাটি পূরণ করত। আমি আর ফিরে যাব না শুনলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে বিজয়াদিদিমণি। তাকে বাবা কষ্ট দেওয়া চলবে না।

শুধাংশ বলল, ব্যাপারখান বাপ ভালা কইরে আমার মাথায় ঢুইকতেছে না। তোমার কথারে জটিল জটিল মনে হইতেছে। তুমিও তো লগে থাইকবে। যেইখানে আমি বুঝাইতে পারুম না, তুমি বুঝাইবে। তারপর শিবশঙ্করের দিকে কোমল চোখে তাকাল সুধাংশু। বলল, আমি বলি কী আর একটা বছর বোনাইবাড়িতে থেইকে গেলে হয় না? তাইলে সব ঝুটঝামেলা মিটে যায়।

না বাবা, হয় না।

কেন হয় না বুইঝতে পারছি না বাপ।

বাপের এ কথার কোনো উত্তর দেয় না শিবশঙ্কর। মাথা নিচু করে থাকে। বাপকে সে কী করে বোঝায় যে, মাইজপাড়ায় থাকতে গেলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। যে লোভ তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে, সেই লোভই তাকে ধ্বংসের শেষ ধাপে নিয়ে যাবে। মানুষের যত শত্রু আছে, তাদের মধ্যে সবচাইতে অধিক শক্তিশালী কাম। কাম মানে দেহকামনা। মঙ্গল তার মধ্যে দেহকামনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। কামের কাছে সে পরাস্থ হয়েছে। নইলে কেন সে মঙ্গলের সঙ্গে সেই সন্ধ্যায় সাহেবপাড়ায় যায়? কেন সে লাভলিকে দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে! সেদিন তো সে মঙ্গলের প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিতে পারত। সে বলতে পারত—মঙ্গল, ওসব দেখার আমার কোনো আগ্রহ নেই। দেখার সঙ্গে যে ভোগের নিবিড় সম্পর্ক, তা সেই সন্ধ্যায় সাহেবপাড়ায় গিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল। নিষিদ্ধপল্লিতে সে গিয়েছিল শুধু দেখার ঔৎসুক্য নিয়ে। কিন্তু শিবশঙ্কর তুমি কি আজ হলফ করে বলতে পারবে—দেখাতেই তুমি সন্তুষ্ট ছিলে? তোমার ভাবনাটা সেদিন কি এলোমেলো হয়ে যায় নি? তুমি একবারের জন্যও কি দেহক্ষুধা মিটাবার কথা ভাবো নি? তোমার মন কি একবারও বলে নি— চল শিবু, ওই দাঁড়িয়ে থাকা নারীগুলোর যে-কোনো একজনের দেহনদীতে নৌকা ভাসাই! তোমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে কি এক অভাবনীয় শিহরণ জাগে নি? তোমার সকল শিক্ষা, আদর্শ সেই ক্ষণটিতে লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

আজ শিবশঙ্কর মাথা নিচু করে ভাবছে— সেই সন্ধ্যায় কেষ্ট এসে উপস্থিত না হলে কী হতো? হয়তো সে মঙ্গল হয়ে যেত, হয়তো গর্ব করার কিছুই অবশেষ থাকত না তার। যে কেষ্ট-তুফান, এমনকি যে মঙ্গলও তাকে সমীহ করে, সেই সমীহ বা সম্মান কোথায় উবে যেত! যে গলায় আর যে ভাষায় মঙ্গল কেষ্টর সঙ্গে ঠাট্টা-পরিহাস করে, সেই ভঙ্গিতেই মঙ্গল তার সঙ্গে কথা বলত। বলত— শিবুবাবু, তুমি যতই শিক্ষিত হও না ক্যান, কামকাজের বেলায় আমাগোরই সমান তুমি। শিক্ষিত আর মুক্খু সমান হইয়ে গেছো গো। তারপর দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে মঙ্গল হয়তো আরও বলত—তা কেমন লাইগছে হেইদিনের খেলাটা? খেলনাপাতি লইয়া নাড়াচাড়া কইরতে চোখ খোলা রাখছিলা তো?

ছিঃ ছিঃ! একী ভাবছে সে! সামনে তার বাপ বসা! লজ্জান্বিত শিবু মাথা তুলল। দেখল—সামনে তার বাবা নেই। বাপ তার কখন সামনে থেকে উঠে চলে গেছে, টের পায় নি শিবশঙ্কর।

সে আবার ভাবতে বসল। যদি শিবশঙ্কর আবার মাইজপাড়ায় থাকতে যায়, সম্ভবত ভুল করবে। মঙ্গল এসে সামনে দাঁড়াবে। সে তাকে আবার লোভ দেখানো শুরু করবে। 

নানা অছিলায় সে আবার তাকে বেশ্যাপল্লিতে নিয়ে যেতে চাইবে। মঙ্গলকে এড়িয়ে চলাও সম্ভব নয়। সে মাইজপাড়ায় যাওয়ামাত্র কেষ্ট-তুফানরা তাকে জড়িয়ে ধরবে। তাকে নিয়ে আগের মতো আড্ডা দিতে চাইবে। এই আড্ডাকে, কেষ্ট-তুফানের সঙ্গকে সে এড়িয়ে চলতে পারবে না। আর কেষ্ট-তুফানের সঙ্গে তো মঙ্গল থাকবেই। কোনো না কোনো সময়, কেষ্ট-তুফানের চোখ এড়িয়ে, মঙ্গল তাকে আবার প্রলুব্ধ করতে শুরু করবে। এই প্রলোভনের সামনে একদিন-না-একদিন সে হাঁটু গেঁড়ে বসবেই। কারণ সেও তো মানুষ, রক্ত এবং মাংসের একজন তরুণ সে। তখন তার আদর্শ, তার উজ্জ্বল মুখ, তার বাবা-মায়ের অকৃপণ ভালোবাসার মর্যাদা—সকল কিছুর জলাঞ্জলি হয়ে যাবে তার ওই বেশ্যা গমনের মধ্য দিয়ে।

এসব চিন্তা করে শিবশঙ্কর ঠিক করে, সে আর মাইজপাড়ায় থাকতে যাবে না। উত্তর পতেংগা থেকেই এমএ-র পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবে সে।

এই যে ভেতরের কথা, তার উচ্ছন্নে যাওয়ার সম্ভাবনার কাহিনি তো আর বাপকে বলা যাবে না। তাই শিবশঙ্কর কৌশলের আশ্রয় নেয়। বোনাইয়ের আর্থিক অনটনের কথা বলে বাপকে স্বপক্ষে টানে।

এক বিকেলে বাপকে নিয়ে বোনাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিল শিবশঙ্কর। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বোনাইকে রাজিও করিয়েছিল। কিন্তু উতলা হয়ে উঠেছিল চির-নির্বিকার বিজয়াদিদিমণিটি। সেদিন কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না বিজয়াদিদিকে। তার একটাই জিজ্ঞাসা—কেন চইলে যাবে শিবু? কী আমার অপরাধ? তারে তো আমি পাখির ছানার মতো বুকের তলায় রাখছি। তাইলে হে কেন চইলে যাবে আমাগো ছেইড়ে?

জগবন্ধু বারবার স্ত্রীকে বোঝাতে চেয়েছে— শিবুর পড়াশোনার ব্যাঘাত হচ্ছে। পরের পড়াটা অল্পসময়ের। উত্তর পতেংগায় থেকেই সে পরের পড়ালেখাটা চালিয়ে নিতে পারবে। বিজয়াদি বলেছে, যে পড়াটা গেরামে থেইকে চালিয়ে যেতে পাইরবে, সেইটা এই শহরে থেইকে পাইরবে না ক্যান? রেলস্টেশন ত কাছেই। এইখান থেইকে যাতায়াত করা ত আরও সুবিধার।

বিজয়াদির যুক্তির সামনে দাঁড়াতে পারে না বোনাই। আমতা আমতা করে বলে, ছাওয়াল বড় হইছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাপেরে সাহাইয্য করার সময় হইছে এখন শিবুর। গেরামে থাইকলে আয়-ইনকামে বাপকে সাহাইয্য কইরতে পাইরবে শিবু।

চুপচাপ ধরনের বিজয়াদি সেদিন কেন জানি চুপ থাকল না। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সইত্য বইলছো না। মিথ্যা দিয়ে আমারে বুঝ দিতে চাইতেছো। তারপর চট করে সুধাংশুর দিকে চোখ ঘুরিয়েছিল বিজয়াদি। বলেছিল, ভাগ্নে, তোমার মামা কি হাঁচা কইতেছে? সত্যই কি তুমি এখন পোলার কামাই খাইবে?

মাথা নিচু করেছিল সুধাংশু। শিবশঙ্কর আগে থেকেই মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছিল।

জগবন্ধু হঠাৎ রেগে উঠছিল। চিৎকার করে বলেছিল, শিবু কি তোমার ছাওয়াল, এইরকম কইরতেছো? যাদের ছাওয়াল, তাদের কাছে ফির‌্যা যাইতে চাইতেছে শিবু। তুমি বাধা দেওনর কে? কী অধিকার আছে তোমার, শিবুরে ধইরে রাখার?

স্বামীর কথা শুনে একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বিজয়াদিদিমণি। শিবু-সুধাংশুকে চা-নাস্তা দিয়েছে, শিবুর কাপড়চোপড়, বইখাতা গোছগাছ করে দিয়েছে। কিন্তু একটি শব্দও মুখ দিয়ে বের করে নি।

প্রণাম করে রওনা দেওয়ার সময় বিজয়াদি কণ্ঠ ভিজিয়ে বলে উঠেছিল, দুগ্গা, দুগ্গা।

একটু এগিয়ে পেছন ফিরেছিল শিবশঙ্কর। দেখেছিল— বোনাইয়ের দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। তার দুপাশে করুণমুখে আরতি আর উজালা দাঁড়িয়ে।

বহুদিন পর চৈতন্য খুড়ার সঙ্গে দেখা হলো শিবশঙ্করের। সমুদ্রপাড়ে। এবার আসার পর নানা ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে তার। শিউলি-অপূর্বের ঘটনা, মাইজপাড়া থেকে আবাসস্থল গুটিয়ে নেওয়া, বিজয়াদিদিমণির চাপা আর্তনাদ—এসব কিছু শিবশঙ্করকে বেশকিছু দিন বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। শুধু চৈতন্য খুড়া কেন, সুনীলেরও কোনো খোঁজখবর নিতে পারে নি শিবু। এমনকি নিজের ভাইবোনদের প্রতিও ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি সে।

সত্যব্রত তো আগেই পড়াশোনা ছেড়েছিল। সূর্যমোহনও কি ছেড়ে দিল? ছেড়েই দিয়েছে বোধহয়, নইলে বাপের সঙ্গে সমুদ্রে যাবে কেন? প্রথম দিন যখন উঠানে পা দিয়েছিল, মা হড়বড় করে সেই কথাই তো বলেছিল— সূর্যমোহনও বাপের সঙ্গে জালে গেছে। তাকে না জানিয়ে পড়াটা ছেড়ে দিল সূর্য! সীতারামের ওপর শিবশঙ্করের কোনো ভরসা নেই। তার জানা আছে—এবছর সীতানাথ এসএসসি পরীক্ষা দেবে। লেখাপড়ায় তেমন উজ্জ্বল নয় সীতানাথ। তারপরও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে এসএসসি-র দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু সীতানাথের মানসিক গড়ন তেমন সুবিধার নয়। কী রকম একটা ঔদ্ধত্যভাব তার চোখেমুখে। ভাইদের সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে উগ্র ব্যবহার করে, বহুদিন আগেই লক্ষ করেছে শিবশঙ্কর।

ব্রজেন্দ্র স্কুলে যাওয়া-আসা করে বটে, তার পরীক্ষার ফল হতাশাজনক। এবার এইটে দ্বিতীয়বারের মতো থেকে যেতে হয়েছে তাকে। বাবা ব্রজেন্দ্রকে নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করে না। মা-ই ব্রজেন্দ্র সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে। তবে ব্রজেন্দ্র বেশ শান্ত। তার বড়সড় শরীরের মধ্যে একটা বিবেচক মন আছে, বোঝা যায়। তবে সে প্রতিবাদী। কারও অন্যায় দেখলে ব্রজেন্দ্র প্রতিবাদ না করে ছাড়ে না।

অনুরাধা বড় হয়ে উঠছে। নয়-এ পা দিল বোধহয় অনুরাধা। ফাল্গুনী বড় হয়ে গেছে। গেলবার বাপ বলেছিল—শিবুবাবা, ফাল্গুনী বড় হইয়ে গেছে। ষোলো পার কইরেছে সে। এবার তার বিয়া দেওনর বয়স হইল।

সেদিন বিকেলে সমুদ্রপাড়ের দিকে যেতে যেতে এসব কথাই ভাবছিল শিবশঙ্কর। বেড়িবাঁধে উঠে চৈতন্য খুড়াকে দেখতে পেয়েছিল সে। দূর থেকে চৈতন্য খুড়াকে চিনতে তার ভুল হয় নি। দ্রুত খুড়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল শিবশঙ্কর।

খুড়া বাঁধের ওপর বিহিন্দিজাল ছড়িয়ে ছেঁড়া-ফাঁড়া অংশগুলো তুনছিল। একজন যুবকও খুড়ার ডানপাশ ঘেঁষে পা ছড়িয়ে বসে একই

কাজ করছিল। শিবু সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পরও টের পায় নি খুড়া। আপনমনে জাল তুনে যাচ্ছিল।

শিবু বলেছিল, খুড়া মুখ তোলো। দেখো তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে! আচমকা শব্দ শুনে একটু যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুড়া। তাড়াতাড়ি মুখ তুলেছিল। আরে শিবু! তুমি! বলে দ্রুত বসা থেকে উঠতে গিয়ে একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল খুড়া।

শিবু বলে উঠেছিল, খুড়া, বসো বসো। উঠতে যাচ্ছ কেন? আমি তোমার সামনে বসছি। এই বলে খুড়ার সামনে জালের ওপর বসে পড়েছিল শিবশঙ্কর।

তুমি এইসেছো জানি। পাড়ার সকল ঘটনাও শুইনেছি। খুড়া নিচুস্বরে বলল।

ওইদিন তোমাকে দেখি নাই খুড়া। না-ঘটনার স্থলে, না-সালিসের দিন। শিবু বলল।

কী কইরে থাকি ভাইপো! কলঙ্ক যে আমারও মুখে-মাথায়।

খুড়ার কথা শুনে শিবশঙ্কর ভড়কে গেল। হঠাৎ যুবকটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ও বুঝি ভগীরথ, তোমার ছেলে?

হ হ। আমার ছাওয়াল ভগীরথ। তারপর গলা উঁচু করে বলল, হেই ভগীরথ, এইদিকে আয়। দাদারে প্রণাম কইরে যা।

ভগীরথ এগিয়ে এসে শিবশঙ্করকে প্রণাম করল।

শিবশঙ্কর বলল, বাহ খুড়া, তোমার ছাওয়ালডা তো বেশ ডাঙ্গর হইয়ে গেছে। হা হা হা।

হ শিবু, ভগীরথ ডাঙ্গর হইয়ে গেছে এই কয় বছরে। তারে বিয়াও করাই দিছি।

শিবু অবাক কণ্ঠে বলল, বিয়ে করিয়ে দিয়েছো? আমাকে নিমন্ত্রণ করলে না যে! আমি কি তোমার ভাইপো নই? তুমি আমাকে ভালোবাসো না? ভালো রকমের খাওয়াদাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করলে কেন খুড়া? আমাকে ভুলে গেলে তুমি!

চৈতন্য খুড়া বলল, তোমারে ভুলি নাই শিবু। বিয়ার আগে আগে তোমার বাপের কাছে গেছিলাম। তোমার বাপ সুধাংশুদা কইল— এই সময় শিবুর পরীক্ষা চইলতেছে ভগীরথের বাপ। তোমার পোলার বিয়াতে এইসময় ত শিবু আইতে পারব না। তাই তোমারে ভগীরথের বিয়ার কথা জানাই নাই।

ঠিক আছে, ঠিক আছে খুড়া। এ নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছুই নেই। এমনি এমনি বলেছি।

শিবু, তোমারে কিন্তুক একদিন আমার বাড়িতে যাইতে হইবে। বউয়ের হাতে চা-নাস্তা খেইয়ে আইসতে হইবে। বড় ভালা মেইয়ে ভগীরথের বউটি।

শিবশঙ্কর দেখল—পুত্রবধূর কথা বলতে বলতে চৈতন্য খুড়ার চেহারাটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। গভীর একটা তৃপ্তির আভা খুড়ার সারা চোখেমুখে জ্বলজ্বল করতে থাকল।

শিবু বলল, যাব। একদিন অবশ্যই যাব। কিন্তু খুড়া, শুধু চা-নাস্তা খাইয়ে বিদায় করবে? একবেলা ভাত খাওয়াবে না?

শিবুর কথা শুনে চৈতন্য খুড়া লজ্জায় মিইয়ে গেল। গাঢ় কণ্ঠে বলল, শিবু, আমার ভুল হইয়ে গেছে। অবশ্যই তুমি আমাদের বাড়িতে ভাত খাইবে। বড় ভালা রাইনতে জানে ভগীরথের বউটি।

এবার ভগীরথ গলাখাঁকারি দিয়ে নরম গলায় বলল, দাদা, আপনি অবশ্যই আমাগোর বাড়িতে একবেলা খাইবেন। বড় আনন্দ লাইগবে আমাগোর।

তারপর কণ্ঠকে আরও নরম করে ভগীরথ বলল, বাবা আপনারে খুব ভালোবাসে।

দুই বাপ-ছেলের কথা শুনে শিবশঙ্কর চুপ করে থাকল। বুকের ভেতর সে এক অপার আনন্দ অনুভব করতে লাগল। চৈতন্য খুড়া নামের এই যে মানুষটি, যে এখন প্রীতিস্নিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার হৃদয়জুড়ে তার জন্য যে গহিন-গভীর বাৎসল্যের সরোবর টইটম্বুর, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না শিবশঙ্করকে।

চৈতন্য খুড়া বলল, ভগীরথ, আইজ তোমার আর জাল তুনার দরকার নাই। ঘরে ফির‌্যা যাও তুমি। শিবুরে বহুদিন পর পাইছি। হের লগে সুখ-দুঃখের দুই-চাইরখান কথা কই।

আইচ্ছা বাবা।

তুমি সুতা, তইলা-পাই, ছুরি—এইসব লইয়া যাও। জালখান বিছানো থাউক। অহনো ভালা কইরে শুকায় নাই। এই বিহিন্দিজাল ত এখন আর সমুদ্রে যাইব না। আষাঢ় মাস আইসা পড়ছে। অহন ত ইলিশজাল বসাইতে হইবে। এই জালরে গোল্লা কইরে গাবঘরে রাইখে দিতে হইবে।

ভগীরথ বলল, হ বাবা।

তইলে আরও এক-দুই দিন শুকাক। ফাডাছেঁড়া তুনাও ত শেষ অয় নাই অহনো।

ভগীরথ বলল, হ বাবা। বলে বাড়ির দিকে রওনা দিল গভীরথ। গভীর চোখে তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল চৈতন্য খুড়া। আর চৈতন্য খুড়ার দিকে তাকিয়ে থাকল শিবশঙ্কর।

ভগীরথ তোমাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে বলে মনে হচ্ছে খুড়া। একপর্যায়ে শিবশঙ্কর বলল।

সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে চৈতন্য খুড়া বলল, হে আমারে খুব ভালোবাসে। বলে হঠাৎ থেমে গেল খুড়া। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে শুরু করল।

শিবু বলল, কী খুড়া, হঠাৎ থেমে গেলে যে! ভগীরথ সম্বন্ধে আরও যেন কী বলতে চাইছিলে তুমি!

চৈতন্য খুড়া যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছে, এমন করে বলল, ভগীরথ আগে বড় বেয়াড়া আছিল। কথা শুইনত না। সারা পাড়া টো টো কইরে বেড়াইত। তার মা কাণ্ডটা ঘটানোর পর কী রকম যেন হইয়ে গেল ভগীরথ। কত দিন ত ঘর থেইকেও বাইর হইল না। একদিন আমারে জড়াইয়া ধইরা হু হু কইরে কেঁইদে দিল। অনেকক্ষণ কেঁইদে তারপর থামল।

তারপর?

তারপর একেবারে পাল্টে গেল ভগীরথ। আমারে কইল—বাপ, নাও-জাল ঠিক কইরে লও। দইজ্যায় নৌকা ভাসামু। তুমি, আমার লগে লগে থাইকে আমারে শিখাইয়া-পড়াইয়া দেও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চৈতন্য খুড়া।

বলল, সমুদ্রে আবার নাও ভাসাইলাম। চার-পাঁচখান জাল বসাইলাম। সমুদ্রের ঢেউ, ঝড়ের ঝাপটা, নৌকাভর্তি মাছ—এইসব কিছু অতীতের সকল ব্যথা ভুলাইয়া দিল।

তার মায়ের কথা বলে না ভগীরথ?

না না। কক্ষনো না। একদিন এই দইজ্যার বুকে আমারে কইল—তুমি আমার বাপ, তুমিই আমার মা। আমারে ভালোবাইসে যাইও বাপ। বইলে এমন কাঁদা কাঁইত্তে লাইগল ভগীরথ, নিজেরেও দমন কইরে রাইখতে পারি নাই হেই সমত।

তুমি ভাবো না খুড়া, খুড়ির কথা?

শিবু ভেবেছিল খুড়ির কথা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে চৈতন্য খুড়া। কিন্তু খুড়া রাগল না। কী রকম যেন নিস্তেজ হয়ে বসে থাকল।

আমি তার সম্বন্ধে না ভাইবলেও হে কিন্তুক ভাবে।

কী রকম! কী রকম খুড়া?

একদিন সে এইসেছিল আমার কাছে।

শিবশঙ্কর চোখ কপালে তুলে বলে, কী বলো!

চৈতন্য খুড়া বলে, হ, একদিন আইছিল সে, আমার কাছে, এই দইজ্যার পাড়ে।

এইখানে! এই বেড়িবাঁধে!

ঠিক ধইরেছ তুমি শিবু। সেদিনও জাল তুনতেছিলাম আমি। এইরকম বিকালবেলার দিকে। ভগীরথ ছিল না সেইবেলা, জালে গেইছিল। তয়, মাইয়াডা লগে আছিল সেদিন।

মাইয়াডা মানে?

আমার মাইয়ার কথা বলতেছি। সাত-আট বছরের লখনাবালা। ভগীরথরে বিয়া করাই নাই তহনো। ঘরে একা একা লখনা থাইকতে চায় না। তাই হেরে লইয়া আইছিলাম দইজ্যার পাড়ে।

শিবশঙ্কর বলে, খুড়ির কথা বলতে চেয়েছিলে খুড়া।

ওর কথা বইলতে গিয়া মাইয়ার কথা উঠল। আমি মাথা নিচু কইরে একধ্যানে জাল তুনতেছিলাম। লখনা ও-ই ওইখানে আপনমনে এক্কাদোক্কা খেলতেছিল। হঠাৎ মেইয়েডা দৌড়াইয়া আইল আমার কাছে। বুকে মুখ গুঁইজা থরথর কইরে কাঁপতে লাইগল। আমি কইলাম, কীরে লখনা, ভয় পাইছস? কারে তুই ভয় পাইলি? কেডা আমার মাইয়ারে ডর লাগাইল?

বলল কিছু লখনা?

না। কিছু কইল না। শুধু তার মুখখান আমার বুকে আরও বেশি কইরে লুকাইতে চাইল।

তুমি মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকালে না খুড়া?

তাকাইলাম মাইনে? আমি চট কইরে সামনের দিকে মাথা তুইল্লাম। দেইখলাম...। বলে থেমে গেল খুড়া।

শিবশঙ্কর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী দেখলে খুড়া?

দেইখলাম হে দাঁড়াইয়ে আছে। আমার থেইকে দুই হাত দূরে দাঁড়াইয়ে আছে লখনার মা।

খুড়া, তুমি এমনভাবে বলে যাচ্ছ, যেন সাধারণ একটা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছ। এই ঘটনাটা যে তোমার জীবনের, এই ঘটনার পেছনে যে মস্তবড় একটা হাহাকার-আর্তনাদ জড়িয়ে আছে, তার কোনো প্রতিক্রিয়া তোমার বলার ভঙ্গির মধ্যে পাচ্ছি না খুড়া।

তোমার আগের খুড়া যে মইরে গেছে বাবা। যে-খুড়ার মনের মইধ্যে বউ লইয়া সংসার করার যে এখখান শিহরণ আছিল, সেই শিহরণ যে হিমালয়ের বরফের নিচে চাপা পইড়েছে। মৃত একখান মানুষের কণ্ঠস্বরে, তার চোখেমুখে কিসের আভাস দেইখতে চাওরে শিবু? ধীরে ধীরে বলে গেল চৈতন্য খুড়া।

খুড়ার কথা শুনে শিবশঙ্কর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আজীবন যে খুড়াকে সহজ-সরল সাধারণ একজন মানুষ ভেবে এসেছে, তার মুখে একরকম কথা শুনে একেবারে নির্বাক হয়ে গেল শিবশঙ্কর।

এই ভাবে যে কতক্ষণ কেটে গেছে হিসাব রাখে নি শিবশঙ্কর। চৈতন্য খুড়ার কথায় সে সংবিতে ফিরে এল। খুড়া বলল, দেইখলাম তার সমস্ত শরীর বোরকায় ঢাকা, শুধু মুখখানা খোলা। ভালা করি চাইয়া দেখলাম, দুই চোখ থেইকে জল গড়াইয়া পড়তেছে।

শিবশঙ্কর অতি মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তখন তুমি কী করলে খুড়া?

আমি কিছু কইরলাম না। হে-ই করল।

কী করল খুড়ি?

খুড়ি! কারে খুড়ি কও তুমি! নিজের আবেগকে গুছিয়ে নিল চৈতন্য খুড়া। তারপর বলল, ঝুপ কইরে আমার পায়ের কাছে পড়ল হে। আমার পাও দুইখান জড়াইয়া ধইরা হাউমাউ কইরে উঠল। অনেকক্ষণ ধইরে কাঁদল। আমি তারে কুনু বাধা দিলাম না।

ধমক দিলে না? বা দূর দূর ছেই ছেই করলে না?

কেন জানি এসব কইরতে ইচ্ছা কইরল্য না শিবু। আমি তারে প্রাণ ভইরে কাঁইত্তে দিলাম।

স্মিত একটা হাসির ঝিলিক শিবশঙ্করের মুখম-লে ঝলকে উঠে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। বলল, তারপর কী করল খুড়ি?

আমার সামনে লেপ্টা মাইরে বইসে পড়ল। কইল...।

খুড়ার কথা শেষ হওয়ার আগে শিবশঙ্কর বলল, লখনা কী করছিল তখন?

আমারে আঁকড়ে ধইরে ভয়ের চোখে হের দিকে তাকাইয়া আছিল লখনা।

আচ্ছা। খুড়ি তোমাকে কী বলল?

বলল, আমারে মাফ কইরে দেও তুমি ভগীরথের বাপ। বড় ভুল কইরে ফেলেছি আমি, অনেক পাপ কইরে ফেলাইছি। নরক ছাড়া আমার কুনু গতি নাই। হের কথা শুইন্যা আমি কট কট কইরে হাইসা দিলাম। হাসি থামাইয়া কইলাম—তোমার কাছে স্বর্গ-নরক কী? কূলত্যাগিনীর আবার কিয়ের স্বর্গ-নরক! কথাখান বোধহয় জোরেই কইছিলাম। আমারই কথার প্রতিধ্বনি ভাইসা আইল আমার কানে। ধীরে ধীরে বলে গেল চৈতন্য খুড়া।

শুনে কী বলল খুড়ি?

মাথা নিচু কইরে অনেকক্ষণ বইসে থাকল আমার সামনে জালের ওপর। তারপর মাথাটা তুইলে কইল—মাইয়াটারে আমারে একটু আদর কইরতে দিবা?

গেল লখনা? মায়ের কাছে? শিবশঙ্কর শুধায়।

না, গেল না। লখনারে কইলাম—যা মা। তোর মা। কাছে যা।

গেল?

গেল না ত গেল না, উল্টা থরথর কইরে আমার বুকের মইধ্যে কাঁইপতে লাগল। মাইয়ার মাথায় হাত বুলাইয়া আবার কইলাম—যা মা লখনা। তোর গর্ভধারিণী। তোরে আদর কইরতে চায়, যা তুই, হের কাছে যা। কিন্তুক আচাইয্যের বিষয় কী জানো!

কী খুড়া?

এত করি কওনর পরও লখনা আমার বুক থেইকে মুখ তুইল্য না। ফিরাও তাকাইল না একবার মায়ের দিকে।

ভয় পেয়েছে বোধহয়।

হইতেও পারে। এইরকম বোরকাপরা অবস্থায় তার মারে কুনুদিন দেখে নাই ত। হয়তো কালা বোরকায় সারা গা-গতর ঢাকা হে-রে দেইখা লখনার মনে ডর ঢুইকা গেছিল। অথবা...।

অথবা কী খুড়া? চিনতে পারে নি বোধহয় লখনা তার মাকে। শিবু ঘটনাটার একটা উপসংহার টানতে চাইল।

এবার বিষণ্ণ একটা হাসির রেখা খুড়ার কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িময় মুখে ভেসে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, না শিবু, তোমার ধারণা ঠিক নয়। লখনা ঠিকই চিনতে পারছিল তার মারে, পরে লখনা কইছিল আমারে। চিনতে পারছে বইলে মায়ের কাছে যায় নাই লখনা।

শিবশঙ্কর বলে, তা-ই নাকি!

হ। ছোড হইলেও লখনারও তো একখান জগৎ আছে। হেই জগতে ভালোবাসা যেমন আছে, ঘিনাও আছে। লখনা বুইঝতে শিখে গেছে তখন। বয়স আট হইলে কী হইবে, ভালা মানুষ খারাপ মানুষ চিনার বুদ্ধি জইন্মা গেছে তখন তার অন্তরে। তার মা চইলে যাওয়ার পর আমাগোর কাণ্ডকারখানা দেইখে দেইখে, পাড়াপড়শির কথা শুইনে শুইনে হয়তো তার মনের মইধ্যে তার মায়ের লাইগা ঘিনার একখান বাসা বাঁইধছে। হেই ঘিনা থেইকেই হেই বিকালে মায়ের কাছে যায় নাই লখনা। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল চৈতন্য খুড়া। তার সারা মুখে জবজবে ঘাম।

হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ খুড়া। ছোট বাচ্চার মন, একবার ঘৃণা জন্মে গেলে তা মন থেকে সরানো মুশকিল। বলল শিবশঙ্কর।

দুহাতের তালু দিয়ে চোখমুখ কপাল ঘষে নিজের ভেতর থেকে কী যেন তাড়াতে চাইল শিবশঙ্কর। তারপর ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকাল। তারপর বিবর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, খুড়ি কী করল তখন?

সামনের দিকে বাড়াইয়া দেওয়া হাত দুইখান গুটাইয়া লইল। হয়তো নিজের অজান্তে অথবা জাইনা-বুইঝা হাত দুইটার তালুরে নিজের বুকের মইধ্যে চাইপা ধইরল। চাইপাই রাইখল অনেকক্ষণ।

তারপর?

ঝট কইরে উইঠে দাঁড়াইল মাইয়ার মা। কইল—তোমার মতো তোমার মাইয়াও আমারে ঘিনা করে। তারপর বুক মাথা চাপড়াইতে চাপড়াইতে চিৎকার কইরে বইল্য—ও মারে! অই কথাটাই কইল শুধু। তারপর খোলা চোখে একবার আমার দিকে, আরেকবার মাইয়ার দিকে তাকাইল। বইল্য—মাফ কইরে দিয়ো আমারে, ভগীরথের বাপ, পাইল্লে আমারে মাফ কইরে দিয়ো।

শিবশঙ্করকে ভীষণ অভিভূত দেখায়। বহুক্ষণ মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না তার। বুকের মধ্যে একধরনের তরঙ্গোচ্ছ্বাস অনুভব করতে থাকে সে। এই উচ্ছ্বাস কী জন্য, কার জন্য বুঝতে পারে না শিবশঙ্কর। আর্তনাদের কণ্ঠে বলে, তারপর খুড়া?

বাক্যহারা চৈতন্য খুড়া শিবশঙ্করের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে গহিন-গম্ভীর ঊর্মিমুখর বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকায়। বেশ কিছুক্ষণ খুড়ার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে শিবশঙ্কর। তমোময়ী সন্ধ্যা আসন্ন। পাখিদের নীড়ে ফেরার সময় হয়ে এল। চৈতন্য খুড়ার কাতর ঊর্ধ্বমুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে শিবশঙ্কর। ভাবে—খুড়া বুঝি তার কথা শুনতে পায় নি। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হতে থাকে।

শিবশঙ্কর কিছু-একটা বলতে যাবে, সেই মুহূর্তে চৈতন্য খুড়া বলে ওঠে, তারপর পেছন ফির‌্যা হনহন কইরে হাঁটা দেয় ভগীরথের মা। একবারের লাইগাও পিছন ফির‌্যা তাকায় না।

এর আগে আলাপকালে একবারের জন্যও ভগীরথের মা বা লখনার মা বলে নি চৈতন্য খুড়া। কিন্তু এখন তার মুখ দিয়ে ভগীরথের মা কথাটি বেরিয়ে আসে। কারণ কী?

মানবজীবনের এই রহস্যময়তার ওড় খুঁজে পায় না শিবশঙ্কর। খুড়ার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তার।

তিন

পরের মাসে ফাল্গুনীর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের ব্যাপারে শিবশঙ্করের দ্বিমত ছিল। সুধাংশু শিবশঙ্করের অভিমতকে উপেক্ষা করেই ফাল্গুনীর বিয়েটা দিয়ে দিল। অহল্যা শিবুকে সমর্থন করলেও সত্যব্রত সুধাংশুর সঙ্গে গিয়ে জুটেছিল। বয়সে সত্যব্রত ফাল্গুনীর বড় বটে, কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্ত নির্ধারণে পরামর্শ দেওয়ার মতো সংসারাভিজ্ঞতা তখনো হয় নি সত্যব্রতের। এই ক্ষেত্রে শিবুকে অনেকটা উপেক্ষা করে সত্যব্রতের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছিল সুধাংশু।

শিবশঙ্কর বলেছিল, এত অল্পবয়সে ফাল্গুনীকে বিয়ে দিতে চাইছ কেন বাবা?

বিস্মিত কণ্ঠে সুধাংশু বলেছিল, অল্প বয়স দেইখলে কোথায়! ষোলো ছাড়াইয়া ফাল্গুনী সতেরোতে পা দিছে। তাও তো পেরাই পাঁচ মাস কেইটে গেল। এই বয়সেই তো বিয়া দেওন উচিত।

না বাবা, এই বয়সে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সংসার-স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি—এইসব বিষয়ে ফাল্গুনীর এখনো বোধ জন্মায় নি।

ছেলের কথা শুনে সুধাংশু হা হা করে হেসে উঠল। বলল, কী যে কও না শিবু! তোমার মা আমাগোর বাড়িতে আইছিল ক’বছর বয়সে জিগাও তোমার মায়েরে। তোমার পাশেই ত খাড়াইয়া আছে তোমার মা। জিগাও হেরে, জিগাও।

পাশে দাঁড়ানো অহল্যা বলল, আমাদের জমানা আর এখনকার জমানা আলাদা। মা-বাপরা হেই সময় না বুইঝা কচি মাইয়াগোরে বিয়া দিছে। তারপর কণ্ঠকে একেবারে নিচু করে অনেকটা স্বগত কণ্ঠে অহল্যা বলল, কম বয়সে বিয়ার যে কী কষ্ট সে আমি বুঝি! তারপর একটু গলাখাঁকারি দিল অহল্যা। পরিষ্কার গলায় বলল, আমার পরামর্শ হইল—ফাল্গুনীরে এখন বিয়া না দেওয়া।

সুধাংশু অবাক চোখে অহল্যার দিকে তাকিয়ে বলল, কী যে কও না তুমি শিবুর মা! অহন বিয়া না দিলে দিবা কখন! তা ছাড়া ভালো একটা পাত্র পাওয়া গেছে।

ফাল্গুনীর বয়স কুড়ি হওয়া পর্যন্ত আমাগোর অপেক্ষা করণ উচিত। পাত্রর কথা কইতেছ? আমার মাইয়ার জইন্য পাত্রর অভাব হইব নি? তোমার মাইয়া ফাল্গুনী অসুন্দর নি? আস্তে আস্তে বলল অহল্যা।

ফাল্গুনীর বিয়ের কথা আলোচনা করার জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে বসেছিল সুধাংশু। সেই আসরে সত্যব্রতও ছিল।

সত্যব্রত বলল, তুমি ঠিক কইতেছ না মা। কখন ফাল্গুনীর কুড়ি হইব, তার জইন্য আমরা অপেক্ষা কইরে থাইকব! আর আমাগো সমাজে ডজন ডজন ভালা পাত্র আছে নি যে যখন চাইবে পাবে। বোনাই যেই পোলাডার খবর আইনছে, হে নাকি শিক্ষিত। মেট্রিক পাস নাকি। কোন অফিসে নাকি ভালা বেতনের চাকরি করে।

শিবু বলল, সত্যব্রত, তুমি শুধু ছেলের পক্ষে বিবেচনা করলে, আমাদের বোন ফাল্গুনীর দিক দিয়ে একবার বিবেচনা করো। শ্বশুরবাড়ির ভার সইতে পারার মতো শক্তি-সামর্থ্য কি ফাল্গুনী অর্জন করেছে?

সত্যব্রত কী রকম যেন রুক্ষভঙ্গিতে বলল, অতশত বুঝি না আমি। বাপ যদি আমার বিবেচনা চায়, তাইলে আমি কমু—ফাল্গুনীর বিয়া এই পাত্রর লগে দিয়া দেওন উচিত। বলেই সত্যব্রত পিঁড়ি ছেড়ে উঠে গেল।

সুধাংশুও কাজ আছে বলে সে স্থান ত্যাগ করল। অহল্যা আর শিবশঙ্কর অসহায় ভঙ্গিতে দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল।

পাত্রের সংবাদটা এনেছিল বোনাই জগবন্ধু। বোনাইয়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল বৃন্দাবন ঠাকুর। ভিক্ষার জন্য গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরে বৃন্দাবন ঠাকুর। চোখ খোলা রেখেই ঘোরে। কোন বাড়ির আর্থিক অবস্থা কেমন—এটার যেমন সংবাদ রাখে, আবার কোন বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত কন্যা বা ছেলে আছে, তারও খবর রাখে। উত্তর পতেংগায় যেমন, শিকলভাঙা গ্রামেও তেমনি বৃন্দাবন ঠাকুরের যাতায়াত আছে। ফাল্গুনীর সন্ধান ঠাকুরের অজানা নয়। সেদিন শিকলভাঙা জেলেপাড়ায় একতারা বাজিয়ে বাজিয়ে ঘুরছিল বৃন্দাবন ঠাকুর। ভজহরি চৌকিদারের উঠানে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আছেন নি মায়েরা? আমারে দুই মুষ্টি চাল দিবেন নি গো মা?

ভজহরির বউ বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। পঞ্চাশ-পঞ্চান্নের অচলা বলেছিল, মাফ করেন ঠাকুর। ঘরে চাল বাড়ন্ত।

এইসময় ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এসেছিল, মিথ্যে বলছ কেন মা? এদিকে এসো। এই টাকাগুলো ওনাকে দাও।

অচলা মুখটা কাঁচুমাচু করে ঘরে ঢুকেছিল। বেরিয়ে এসে একটা দশ টাকার নোট বৃন্দাবনের হাতে দিয়েছিল।

নোটটা কোঁচড়ে ঢুকাতে ঢুকাতে বৃন্দাবন ঠাকুর বলেছিল, কে গো মা, সম্মান কইরে আমারে টাকা দিল!

বেজার মুখে অচলা বলল, আমার ছোট পোলা। শহরে চাকরি করে। আইজ রবিবার। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। তাই ঘরে আছে।

ঠাকুর ঠাকুর। ঈশ্বর আপনার পোলারে দীর্ঘজীবী করুন। চাকরিতে উন্নতি হউক তার। নিমীলিত চোখে বলে গেল বৃন্দাবন ঠাকুর। ছেলের প্রতি আশীর্বাদের কথা শুনে বিরক্ত মনটা নরম হয়ে এল অচলার। কোমল গলায় বলল, আপনি আমার ছাওয়ালরে ভালা করি আশীব্বাদ কইরেন ঠাকুর।

অবশ্যই অবশ্যই মা। তা মা, আপনার সন্তানাদি কজন?

স্মিত চোখে অচলা বলল, দুইডা পোলা, তিনখান মাইয়া। বড় ছাওয়ালরে বিয়া করাইছি। মাইয়াও বিয়া দিয়া দিছি দুইটারে। রত্না ছোড। মইরম ইস্কুলে পড়ালেখা করে রত্না।

তা ছোড পোলারে বিয়া করাইবেন না মা?

করাইমু। হের বাপ কইল অরবিন্দরে বিয়া করানর সময় হইছে। তারপর চাপা একটা শ্বাস ত্যাগ করল অচলা। এদিক-ওদিক একবার তাকাল। বলল, মাইয়া খুঁজতেছি। কিন্তুক জুইতমতো মাইয়া পাইতেছি না।

এই সময় ‘এতক্ষণ কী করছ মা’ বলতে বলতে একজন যুবক ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সামনে বৃন্দাবন ঠাকুরকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল সে।

অচলা বলে উঠল, এ-ই আমার ছোড পোলা অরবিন্দ। এর কথাই কইতেছিলাম আপনারে।

‘অ’— বলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল বৃন্দাবন ঠাকুর।

অরবিন্দ এইসময় বলল, প্রণাম ঠাকুর মশায়।

প্রণাম বাবা, প্রণাম। দুই হাত ওপর দিকে তুলে বলল, দীর্ঘজীবী হও, বাবা। সুখে-শান্তিতে থাকো।

অরবিন্দ বলল, আমি যাই মা। ওপাড়ার অর্জুনের সঙ্গে একটু আড্ডা দিয়ে আসি। বলে হাঁটা দিল অরবিন্দ।

অরবিন্দর যাওয়ার পথ থেকে চোখ ফিরিয়ে অচলা বলল, আপনি নানা গেরামে ঘুরেন ঠাকুর। আছে নি আপনার কাছে মাইয়ার সন্ধান?

বৃন্দাবন ঠাকুর আপনমনে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, একটা মেইয়ের সন্ধান আছে আমার কাছে। পাঁচ-ছয় কেলাস লেখাপড়াও কইরেছে।

আমার পোলাও কিন্তু মেট্রিক পাস। বিদেশি কম্পানিতে চাকরি করে। মেলা বেতন। তা মাইয়াডা দেইখতে কেমন?

সোন্দরী। খুউব সোন্দরী। লম্বা। দশ গেরামে খুঁইজাও এই রকম মাইয়া পাইবেন না।

তা ওই মাইয়াডা আমার পোলার জইন্য দেখেন না বাবা।

ভাবছি—মাইয়ার পক্ষ রাজি অইব কি না। মাইয়ার পাঁচ ভাই। বড়টা বহুত লেখাপড়া করতেছে।

না দেইখ্যাই মাইয়াডার প্রতি আমার টান জন্মাইছে। আমার বাড়িঘর, পোলা—এসবকে ত আপনি দেইখা যাইতেছেন। আমাগোর বিবরণ দিলে মাইয়ার মা-বাপ রাজি না হইয়া যাইব কই? অচলার কথার শেষের দিকে অহংকারের ছোঁয়া।

সেই অহংকারের ব্যাপারটি বৃন্দাবন ঠাকুর লক্ষ করেন না। বৈষ্ণব মানুষ। সাধারণ মানুষের অহংকারদীপ্ত কণ্ঠস্বর, রুক্ষ-কঠিন ব্যবহার—ঠাকুরের চোখ এড়িয়ে যায়। একধরনের শুভ্রতা ঠাকুরকে ছুঁয়ে থাকে। চারপাশের কূটচাল, অভব্যতা, নির্মমতা—এসব কিছু থেকে এই শুভবোধ বৃন্দাবন ঠাকুরকে আলাদা করে রাখে।

একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ঠাকুর। অচলার ডাকে বাস্তবে ফিরল। অচলা বলছে, আমি আপনার শুভ সংবাদের জইন্য অপেক্ষায় থাইকব ঠাকুর।

বৃন্দাবন ঠাকুর হাত দুটো ঊর্ধ্বে তুলে বলে উঠল, জয় গৌরহরি।

 

এই বৃন্দাবন ঠাকুরই এক বিকেলে জগবন্ধুর দাওয়ায় হাজির হয়। জগবন্ধু কিছুটা বিচলিত ভঙ্গিতে বলে, কী ব্যাপার কাকা! কোনো দুঃসংবাদ নি?

মৃদু হেসে বৃন্দাবন ঠাকুর বলে, না না। খারাপ খবর না ভাইপো, ভালা খবর লইয়া আইছি তোমার কাছে।

ভালা খবর, মাইনে শুভসংবাদ! তা কাকা, কী শুভসংবাদ লইয়া আইলা আমার কাছে?

বৃন্দাবন ঠাকুর সবকথা খুলে বলেছিল জগবন্ধুর কাছে। সব শেষে বলেছিল, তুমি দাঁড়াইলে এই বিয়াটা হইয়া যাইতে পারে।

দেখো কাকা, ফাল্গুনীর মা-বাপ-বড়ভাই আছে। সিদ্ধান্ত লইব ওরাই। আমি মাঝখানে প্রস্তাবখান ওদের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে পারি শুধু।

তা-ই করো ভাইপো বাপ। তোমার ভাইগনা তোমার কথা ফেইলতে পাইরব না। আস্থার গলায় বলেছিল বৃন্দাবন ঠাকুর।

এরপর প্রস্তাব নিয়ে জগবন্ধু সুধাংশুর বাড়িতে গিয়েছিল। সবাইকে জড়ো করে বলেছিল, আমার কাছে প্রস্তাবটা আইছে বৃন্দাবন ঠাকুরের মাইধ্যমে। ভালামন্দ বিচার করার দায় তোমাদের।

তারপর শিবশঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও তোমাদের। ছেইলের খোঁজখবর লও। ছেইলেরে নিজেদের চক্ষে দেখো। তারপর মতামত দেও।

মামা জগবন্ধু চলে যাওয়ার পর স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে বসেছিল সুধাংশু। স্ত্রী আর বড় ছেলে শিবশঙ্করের অভিমতকে অগ্রাহ্য করে ফাল্গুনীকে শিকলভাঙায় বিয়ে দিতে সুধাংশু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। সত্যব্রতকে সঙ্গে নিয়ে চাকরিস্থলে অরবিন্দকে দূর থেকে দেখেও এসেছিল।

অহল্যা মরমে মরে যেতে যেতে বলেছিল, শিকলভাঙায় গিয়া একবার ছেইলের বাড়িঘর দেইখে আইলে হয় না? ওখানে ত তোমার পিসির বাড়ি। একবার পিসির লগে দেখা করো। পোলা সম্বন্ধে ভালা-খারাপ পিসির কাছ থেইকে জাইনা লও।

অহল্যার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে সুধাংশু বলেছিল, রাখ তোমার পিসিমিসি। আমি বৃন্দাবন ঠাকুরের কাছ থেইকা জাইনা লইছি—স্বভাবে-চরিত্রে পোলা নাকি হিরার টুকরা। আর বাড়িঘর দেইখে কী অইবে, পোলা, পোলার মা-বাপ-ভাই-ভইনরা থাইকতে পাইল্লে হেই ঘরে তোমার মাইয়া থাইকতে পাইরব না ক্যান?

স্বামীর কথা শুনে অহল্যা একেবারে চুপ মেরে গেল। অভিমানে আগেই শিবশঙ্কর নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। যে সুধাংশু পারিবারিক সকল সিদ্ধান্তে শিবশঙ্করের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, ফাল্গুনীর বিয়ের ব্যাপারে সেই সুধাংশু শিবশঙ্করকে উপক্ষো করল। সত্যব্রত সুধাংশুর ডান হাত হয়ে দাঁড়াল।

মাঘের এক শুভদিনে অরবিন্দর সঙ্গে ফাল্গুনীর বিয়েটা হয়ে গেল।

 

চার

সময়ের চাকা গড়িয়ে গেল বহু পথ। সকাল-সন্ধ্যা-রাত, গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্ত, দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর অতিক্রান্ত হতে থাকল। সূর্যমোহন, ব্রজেন্দ্র পড়াশোনা থামিয়ে দিল। সীতানাথ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আইএ পাস করল। সূর্যমোহনও বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত মাছ মারতে যাওয়া শুরু করল। ব্রজেন্দ্র সবার হেলা-অবহেলার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগল। অনুরাধা পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বড়দির মতো এক অজানা ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অহল্যার দু-চারটা চুল পাকতে শুরু করল। সুধাংশুর চোয়াল দুটো ভেসে উঠল। আর শিবশঙ্কর এমএ পাস করে বাড়িতে বাড়িতে টিউশনি করে বেড়াতে লাগল। প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে শিবশঙ্করের কোনো যোগাযোগ থাকল না। শুধু একদিন শুনতে পেল—কদুরখিল না রাঙ্গুনিয়ার দিকের একটা বেসরকারি কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হয়েছে প্রিয়রঞ্জন। অন্যান্য সহপাঠীরা কে কোথায়, কে কী করছে কোনোই খবর রাখল না শিবশঙ্কর। শুধু উত্তর পতেংগা নামের একটা গাঁয়ের পথে পথে গোত্তা খেয়ে ফিরত লাগল। উত্তর পতেংগার বাইরে যে বিরাট একটা পৃথিবী পড়ে আছে, সেখানে যে নানা কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তাদের কোনো সুলুকসন্ধান করল না শিবশঙ্কর। দু-তিনটে টিউশনির আয়ে সে সন্তুষ্ট থাকল। একদিন অবশ্য তার সামনে জীবনের অন্যরকম একটা দরজা খুলে গেল। এই দরজা খুলে যাওয়ার আগে জেলেপাড়ায়, জেলেপাড়ার বাইরে তার জীবন অনেকটাই বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল।

চৈতন্য খুড়া জিজ্ঞেস করে, শিবু, বড় পাস ত দিলা, এইবার কী কইরবে ঠিক করলা?

সুনীল বলে, তোমার জইন্য আমার বুক ফুইলে ফুইলে উঠে। এবার বড় একখান চাকরি লও। মানুষরে বড় গলায় কইতে পারুম, আমাদের শিবু মস্ত বড় চাকরি করে, অনেক টাকা বেতন পায়।

নকুল সর্দার বলে, ভাইপো, এইবার সুধাংশুর কষ্টটা ঘুইচল বলে। দইজ্যার লগে যুদ্ধ কইত্তে কইত্তে গা-গতরের ছর-ছাল উইঠে গেছে সুধাংশুর। এখন বড় একখানা চাকরির সন্ধান কর। সুধাংশুর গায়ে এইবার সুখের একটু হাওয়া লাগুক।

সোহাগীর মা বলল, শিবু, তুমি এই পাড়ার সবচাইতে বড় বিদ্বান। আমাগোর মাস্টর তুমি। এরপর আরও কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল সোহাগীর মা।

শিবশঙ্কর অনুমান করে। সোহাগীর মা কী বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল—বড় বিদ্বানের তো বড় চাকরি। বড় চাকরি মানে বিপুল টাকার বেতন। তুমি ওইরকম একটা চাকরি জুটিয়ে নাও শিবু। তাহলেই তোমার পরিবারের অভাব একেবারে ঘুচে যাবে। আমরাও বিপদে-অভাবে তোমার সাহায্য পাব।

পাড়াপড়শির এই মন্তব্য-আকাক্সক্ষা শিবশঙ্করের মধ্যে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি করে। পাস দিয়েও যে সে বেকার, এই ব্যাপারটারও কি ইঙ্গিত দেয় না ওরা!

মা-বাবা আর ভাইদের মুখের দিকে তাকায় শিবশঙ্কর। বাপের মুখ ভাবলেশহীন। মা সংসারের চাপে ব্যতিব্যস্ত, তার মনোভাব বোঝা দায়।

সত্যব্রত আর সূর্যমোহনের চেহারা গভীরভাবে অবলোকন করে শিবু। তাদের চেহারা কী যেন একটা বলতে চায়। কিন্তু বলার চিত্রটি তাদের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট নয়। শিবশঙ্কর আন্দাজ করে নেয়—ভাইয়েরা বলতে চাইছে, আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি দাদা। যেদিন তুমি চাকরি পাবে, সেদিন থেকে সমুদ্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আমরা কমিয়ে আনব। আমরা আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলব মাছমারার পেশাটা। সমুদ্রের অনিশ্চিত জীবন থেকে একটা স্বস্তিকর জীবন চাই দাদা তোমার কাছে। সেই অভাবহীন স্বস্তিময় জীবনে আমরা সবাই মিলেমিশে জীবনযাপন করে যাব।

কিন্তু শিবশঙ্কর জানে না—কোথায় গেলে চাকরি মিলবে। দু-একটা জায়গায় দরখাস্ত যে সে দেয় নি, এমন নয়। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই তাকে যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে নি। বাংলায় এমএ শুনে নাক সিঁটকেছে।

একদিন বাপকে শিবু বলল, বাবা, ঘরে বসে আছি। তোমাদের সঙ্গে আমাকেও সমুদ্রে নিয়ে চলো।

বাপের মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। চোখ বড় বড় করে শিবুর দিকে তাকিয়ে থাকে সুধাংশু।

শিবু আবার বলে, আমি জালে যাওয়া শুরু করলে তুমি একটু বিশ্রাম পাবে বাবা। আমি সত্যব্রতদের নিয়ে মাছধরার কাজটি ঠিকই চালিয়ে নিতে পারব।

এবার সুধাংশু বোধহয় হুঁশে ফিরল। একটু নড়েচড়ে বসল সুধাংশু।

বলল, কী বললে!

সুধাংশুর কথাটি বিস্ময়ের না প্রশ্নের বুঝতে পারল না শিবশঙ্কর। একটু থতমত খেয়ে গেল সে। সংযত হয়ে বলল, বাবা, আমি বেকার হয়ে ঘরে বসে আছি, চাকরিও পাচ্ছি না কোথাও। আমি বলছিলাম—আমি যদি সত্যব্রতদের সঙ্গে সমুদ্রে যাওয়া শুরু করি, তাহলে তোমার শরীরটাও আরাম পাবে, আর আমারও সময় কাটবে।

সুধাংশুর চোখ-মুখ হঠাৎ ধপ করে জ্বলে উঠল। চট করে চোখ বন্ধ করে ফেলল সুধাংশু। ওইভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকল সে। তারপর চোখ খুলল। সুধাংশুর চোখ দুটো তখন শান্ত-নিরীহ। কণ্ঠে অফুরান ভালোবাসা মিশিয়ে সুধাংশু বলল, তুমি আমার বড় ছাওয়াল শিবু। লেখাপড়া শিখছ তুমি। আমার মতো তোমার ভাইরাও তোমারে লইয়া গর্ব করে। তুই ক্যান যাবি বাপ সমুদ্রে? সমুদ্রে যাওনর পোলার কি অভাব হইছে আমার ঘরে? এই কথা শুইনলে তোর ভাইরা কী রকম দুঃখ পাইবে ভাইবা দেখছস একবার? আবেগে ‘তুমি’ থেকে তুই-তে নেমে এল সুধাংশু।

বাবা, ননীর পুতুলের মতো বসে বসে খাচ্ছি। সংসারের কোনো কাজে লাগাতে পারছি না নিজেকে।

বাপ শিবু, আমার বিশ্বাস একদিন-না-একদিন তুই চাকরি পাবি। তোর এত বড় পাসের মইরযাদা কি মাঠে মারা যাইব? নিশ্চয় না।

তারপর কণ্ঠকে আরও মৃদু করে সুধাংশু বলল, দেখে নিস বাপ, তোর এই অস্থিরতা একদিন কেইটে যাবে।

সেদিন বাপের সঙ্গে আর কোনো তর্ক করে নি শিবশঙ্কর।

তার দিন তিনেক পরে সিরাজ স্যার শিবশঙ্করকে ডেকে পাঠালেন স্কুলে। পতেংগা হাইস্কুল থেকেই এসএসসি পাস করেছিল শিবশঙ্কর। তখন সিরাজ স্যার ছিলেন সহকারী শিক্ষক। ইংরেজি পড়াতেন। কড়া ধাঁচের মানুষ। এর পর দিনের পর দিন গেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন গেছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির দরজায় কড়া নেড়েছে। তারপর শাপলা জাতীয় ফুল, কাঁঠাল জাতীয় ফল হয়েছে। দোয়েলের মর্যাদা বেড়েছে এদেশে। জাতীয়তাবাদী বাঙালির কাছে অম্লান গানের মহিমা পেয়ে গেছে—‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

এরপর পঁচাত্তরের অমানিশা। তমোনাশরা হারিয়ে গেছে মীরজাফরদের ছুরিকাতলে। মীরজাফর সিরাজ-উদ-দৌলা সেজেছে। যুধিষ্ঠিরদের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে দুর্যোধনদের দুঃশাসনের ঝাণ্ডার অতল গভীরে।

সিরাজ স্যার এইসব সুসময়-দুঃসময়ের পথ অতিক্রম করে করে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হয়েছেন, পতেংগা হাইস্কুলের। শিবশঙ্কর সিরাজ স্যারের তেমন খোঁজখবর রাখে নি, কিন্তু সিরাজ স্যার শিবশঙ্করকে ভোলেন নি। ও যে এমএ পাস করেছে, ও যে এখনো বেকার—সে সংবাদ সিরাজ স্যার রাখতেন। তাই তাঁর কাছে প্রস্তাবটা যখন এল, প্রথমেই শিবশঙ্করের কথা মনে পড়ল তার। এক বিকেলে তিনি শিবশঙ্করকে ডেকে পাঠালেন।

শিবুর বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে পতেংগা হাইস্কুলটি। স্কুল তখন ছুটি হয়ে গেছে। শিক্ষকেরাও চলে গেছেন। নিজ কক্ষে একা বসে আছেন সিরাজ স্যার।

সিরাজ স্যার বললেন, বসো শিবশঙ্কর। কেমন আছ?

শিবশঙ্কর বিচলিত। একই গাঁয়ে থাকে, স্কুলের অনেকটা পাশ দিয়েই যাতায়াত করে সে। কোনোদিন সে স্কুলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে নি। কোনোদিন সিরাজ স্যার বা অন্যান্য স্যারদের ভালোমন্দ সম্পর্কে জানতে চায় নি। আজ সেই বিস্মৃতপ্রায়দের একজন তাকে ডেকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করছেন। বিচলিত তো হওয়ারই কথা শিবশঙ্করের। বিচলনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধবোধও তাকে প্রায়-ম্রিয়মান করে তুলছে।

আমি বুঝতে পারছি তুমি বিপন্নবোধ করছ। ও কিছু না শিবু। তোমার মতো আমিও এমএ পাস করে দীর্ঘদিন বেকার থাকলে অস্থিরতা আর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতাম। সিরাজ স্যারের কথা অনেকটা বঙ্কিমঘেঁষা। তৎসম শব্দের প্রতি তাঁর ভীষণ দুর্বলতা।

স্যার, মাফ করবেন। বহুদিন আমি আপনার খোঁজখবর নিতে পারি নি। বড়ই মানসিক কষ্টে দিন যাচ্ছে আমার।

জানি আমি। সাধারণ লেখাপড়া করিয়ে হলে তেমন কষ্ট পেতে না তুমি। এমএ পাসটাই তোমার যন্ত্রণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

শিবশঙ্কর স্যারের কথা শুনে মাথা নিচু করে থাকে।

সিরাজ স্যার বললেন, আমার কাছে একটা চাকরির প্রস্তাব এসেছে, হেডমাস্টারের চাকরি। করবে তুমি?

চমকে সিরাজ স্যারের দিকে তাকায় শিবশঙ্কর। কী বলেন স্যার!

সাধারণ শিক্ষকের পদ নয়, কেরানির চাকরির প্রস্তাব নয়, একেবারে হেডমাস্টারের পদ! শুধু বিস্ময় নয়, হতবাক হওয়ারই তো কথা!

বাকরুদ্ধই হয়ে পড়েছিল শিবশঙ্কর। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে নি সে। সিরাজ স্যারও তাকে সময় দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন—তাঁর প্রস্তাব শুনে শিবু অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আবেগটা কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন সিরাজ স্যার। একটা সময়ে শিবশঙ্কর বলল, হেডমাস্টার!

হ্যাঁ, সেরকমই বললেন স্কুলকমিটির সভাপতি হায়দার সাহেব।

স্যার, আমার তো কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই। দুই-চারটা টিউশনি করার অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো পুঁজি নেই আমার।

সিরাজ স্যার আপনমনে একটু হাসলেন। ভাবলেন—যে ছেলেটা ক্লাসে অনেকটা মাথা নিচু করেই থাকত, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না একটিও, সে আজ কী রকম গুছিয়ে কথা বলছে। সময়ই বোধহয় তাকে স্মার্ট করে তুলেছে। সময়ের চেয়ে যে বড় শিক্ষক আর নেই।

সব কথা খুলে বলেছি তাদের। বলেছি, এমএ পাস। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নেই বটে তবে তার সিনসিয়ারিটি তুলনাহীন। আমার কথা লুফে নিয়েছেন হায়দার সাহেব। বলেছে—ওরকম একজন তরুণকেই চাই আমরা, যে মনপ্রাণ দিয়ে স্কুলটা গড়ে তুলবে।

শিবশঙ্কর ইতস্তত করে বলেছিল, পারব আমি স্যার!

না-পারার তো কোনো কারণ দেখি না শিবু। বাস্তবতার মাটিতে তোমার পা। তুমিই তো পারবে নতুন স্থাপিত ওই স্কুলটাকে গড়ে তুলতে। শিবশঙ্করের ইতস্ততা কাটে না। বলে, এত বড় দায়িত্ব...।

শিবুর কথা শেষ করতে দেন না সিরাজ স্যার, একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও। দেখো, আমাদের পাশের গাঁ সাজনমেঘ। ওখানেই স্কুলটা গড়তে চাইছেন ওঁরা। ওই স্কুলের তুমি হবে প্রথম প্রধান শিক্ষক। কী আনন্দের আর কী গৌরবের না ব্যাপারটি? তবে হ্যাঁ, তোমাকে একটা কথা বলার বাকি আছে শিবু।

কী কথা স্যার?

ওঁরা বেতন বেশি দিতে পারবেন না। দশজনের সহযোগিতায় নাকি স্কুলটা হচ্ছে। একেবারে শূন্য মূলধন নিয়ে শুরু। তবে রহমত আলি হায়দার ভালো লোক। উঁচু পদের সরকারি চাকুরে। বেতন যা-ই পাও, ব্যবহারটা পাবে ভালো। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি—স্কুল পরিচালনা কমিটি কী রকম অভব্য হতে পারে। শেষের বাক্যটি অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বললেন সিরাজ স্যার।

তারপর স্পষ্ট গলায় বললেন, ওঁরা মাসে তোমাকে চার শ’ টাকা বেতন দেবেন। করবে কি তুমি? চাকরিটা? তারপর কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন তিনি। বললেন, আমি বলি কী চাকরিটা নাও। এমএ পাস তুমি। সারা জীবন তো আর সাজনমেঘ হাইস্কুলে পড়ে থাকবে না। নিশ্চয় একদিন অনেক উঁচুতে উঠবে তুমি। এখন বেকার সময় না কাটিয়ে স্কুলে সময়টা দাও তুমি।

ঠিক আছে স্যার। আমি রাজি। শিবশঙ্কর বলল।

সিরাজ স্যার বললেন, আমি ওঁদের বলে দিচ্ছি। ওঁরা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

নভেম্বরের শেষ দিকেই যোগাযোগ করেছিলেন হায়দার সাহেব। লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়েছিলেন। অনেকের মাঝে হায়দার সাহেবকে আলাদা করে চিনতে পেরেছিল শিবশঙ্কর। দোহারা গড়ন। মাঝারি উচ্চতা। ফরসা। তাঁর চোখ দুটো বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি উঁচুপদের চাকুরে। তাঁর পাশে ফজল আহমেদ। দীর্ঘদেহী। লম্বা দাড়ি। কাঁচাপাকা। একসময় গৌরবর্ণী ছিলেন। বার্ধক্য শরীরের সৌরভ শুষতে শুরু করেছে অনেক আগে। মাথায় টুপি। হাঁটু-ছোঁয়া পাঞ্জাবি তাঁর সৌম্যতা বাড়িয়েছে। গহর খালেক, কোষাধ্যক্ষ। তিনি বসেছেন হাজি ফজলে আহমেদের পাশে। ছাদেকুর রহমান, স্কুল-সেক্রেটারি। সভাপতি রহমত আলি হায়দারের ডানহাত। তাঁর ডানপাশেই বসেছেন রহমান সাহেব। সবার চোখ শিবশঙ্করের ওপর।

কিছুক্ষণ আগে উভয়পক্ষে কথাবার্তা হয়েছে। স্পষ্ট ঋজু ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছে শিবশঙ্কর। তার কোনো কোনো উত্তর এত সোজাসাফটা ছিল যে, শিবশঙ্কর উদ্ধত—এটা কেউ ভাবলেও ভাবতে পারতেন। কিন্তু তার স্পষ্ট উচ্চারণ, শিক্ষা-সম্পর্কিত মন্তব্য, আদর্শের প্রতি আনুগত্য—এসব উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করল।

হাজী ফজল আহমেদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। দ্রুত দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে শিবশঙ্করকে বুকের কাছে টেনে নিলেন। বললেন, ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

ছাদেকুর রহমান বললেন, যে-রকম শিক্ষক আমরা চাইছিলাম, ঠিক সেরকমই শিবশঙ্করবাবু। ওঁকে হেডমাস্টার হিসেবে রাখলে সাজনমেঘ হাইস্কুলের উন্নতি হবে বলে আমি মনে করি।

রহমত আলি হায়দার গুরগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, শিবশঙ্করবাবু, তাহলে এই কথা হলো—আগামী জানুয়ারির এক তারিখে আপনি আমাদের স্কুলে হেডমাস্টার হিসেবে যোগদান করছেন। বেতনের কথা তো সিরাজ সাহেব আগেই আপনাকে বলেছেন।

শিবশঙ্কর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওই সময় হায়দার সাহেব আবার বলে উঠলেন, আশা করি আপনার হাত দিয়ে স্কুলটি অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

শিবশঙ্কর বলেছিল, আমি চেষ্টা করব।

চার শ’ টাকা বেতনের শিবশঙ্কর সাজনমেঘ হাউস্কুলটাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। চার বছরের কঠোর পরিশ্রমে স্কুলটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকের গাঁয়ে। দক্ষ শিক্ষকদের আন্তরিকতায় সাজনমেঘ হাইস্কুল চার বছরের মধ্যে যশস্বী স্কুলে পরিণত হয়েছিল। শ্রমে-ঘামে গড়া এই সাজনমেঘ হাইস্কুল থেকে একদিন শিবশঙ্করকে বিদায় নিতে হলো। অপমানিত হয়েই স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল প্রধান শিক্ষক শিবশঙ্করকে। সে কাহিনি পরের। তার আগেও কাহিনি আছে।

 

পাঁচ

শিবশঙ্কর বছর দুয়েক হেডমাস্টারি করার পর সুধাংশু ঠিক করল, শিবশঙ্করকে বিয়ে করাবে। ছেলের কাছে প্রস্তাবটা দেওয়ার আগে অহল্যার সঙ্গে কথা বলল একদিন।

শুনে অহল্যা বলল, অহন শিবুরে বিয়া করানোর বয়স হইছে নি?

পর পর কখান ছাওয়াল ঘরে। এরাও বড় হইয়া উঠতেছে। সত্যব্রত ত বিয়া করানোর মতো সেয়ানা হইয়ে উঠছে। শিবুরে বিয়া না করাইলে সত্যকে বিয়া করামু কেমনে!

অহল্যা আমতা আমতা করে বলে, কম বেতনের চাকরি শিবুর। ওর বেতন আর মাছধরার টাকা মিল্যাও সংসার চালানো দায়। বউ আইয়া টানাটানির সংসার দেইখলে কী ভাইববে? আমি বলি কী আরও কিছুদিন ছবুর কইরলে হয় না?

চাকরি কইরতে কইরতে বেতন বাইড়ব শিবুর। তা ছাড়া একজায়গায় পইড়ে থাইকব নি শিবু? বড় চাকরি নিব না? তারপর হাসিহাসি মুখ করে সুধাংশু বলে, বড় ছেইলের বউয়ের মুখ দেইখতে ইচ্ছা করে না তোমার? উঠান জুইড়া নাতি-নাতনিরা কিলবিল করতেছে—এই দৃশ্য দেখার কথা ভাইবলেও ত আমার মনে পুলক জাইগতেছে।

আমারও কি ইচ্ছা করে না? করে। কিন্তুক কইরলে কী হইবে? পোলা-বউ লই থাকার আলাদা ঘর আছে নি আমাদের?

আরে, তুমি অই লইয়া ভাইব না। সামনের ভিটাটা খালি পইরে আছে না? ওই ভিটায় দুই কামরার ঘর তুলুম। ওইখানেই থাইকব শিবু।

তাইলে শিবুর লগে কথা কইয়া দেখো। অহল্যার কণ্ঠে খুশির ছোঁয়া। আইচ্ছা, আর একখান কাম করা উচিত না? সত্যব্রতের লগে এই ব্যাপারে কথা কইলে ভালা অইত না? অহল্যা বলে।

তোমার ওই ব্যাপারে চিন্তা করনর দরকার নাই। শুধু সইত্য না, সূর্যমেহনরেও একলগে বসাইয়া বিয়ার আলাপ সাইরা ফেলাইছি। ওরা খুশি।

তাই নাকি! শিবুর কাছে কথাটা কীভাবে পাড়বা?

এই নিয়া ভাইবা আকুল হইয়ো না ত শিবুর মা। আমার মামা আছে না, শিবুর বোনাই! মামারে দিয়া কথাটা পাড়ামু। বোনাইরে ফেইলতে পারব না শিবু। বলল সুধাংশু।

বোনাইয়ের প্রস্তাবে শিবশঙ্কর তেমন কোনো আপত্তি তুলল না। শুধু কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে ইতস্তত গলায় বলল, সংসারের যা অবস্থা বোনাই, আরেকটা নতুন মুখ এলে অভাবটা বাড়বে কেবল।

বোনাই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, তুমি অভাবের কথাই ভাইবলে, আনন্দের কথা ভাইবলে না? তারপর কণ্ঠে আরও বেশি উল্লাস ঢেলে জগবন্ধু বোনাই বলল, তোমার মা-বাপের কথা ভাব, ভাইদের খুশির কথা ভাব। একটু শান্ত মনে ভাইবে দেখ ফাল্গুনী আর অনুরাধা কী পরিমাণ আহ্লাদ পাইব।

এরপরও...। শিবশঙ্কর কী-একটা বলতে চাইল। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বোনাই বলল, তুমি কী বইলতে চাইতেছ বুইঝতে পারছি। সংসারের অভাবের কথাই ত আবার তুইলতে চাইতেছ তুমি? একটা মুখের কারণে সংসারে অভাব বাড়ে না, বাড়ে বহু মুখের কারণে। বহু মুখ লইয়া তোমাগোর সংসার যদি চইলতে পারে, একটা মুখ বাড়ার কারণে সুধাংশুর সংসারটা অচল হইয়া পইড়ব না।

এতক্ষণ চুপ থাকা সুধাংশু বলে উঠল, তুমি ঠিকই কইছ মামা। একটা বউয়েরে আমরা সকলে মিল্যা পাইলতে পারুম না!

আড়ালে দাঁড়ানো অহল্যা বলল, বউয়ের ভরণপোষণের ব্যাপার লইয়া তোমার ভাবার দরকার নাই শিবু। ওইটা আমাগোর ওপর ছাইড়া দাও।

তারপরও মা!

কোনো তারপর মারপর নাই। সুধাংশু, তুমি মাইয়া দেখা শুরু কর। আবেগভরা গলায় বলল বোনাই জগবন্ধু।

শিবশঙ্কর মৌন থাকল।

কনের সন্ধান শুরু করবার আগে সুধাংশু বলল, আমার একখান শর্ত আছে মামা। মাইয়ারে হইতে হইব শিক্ষিত। শিক্ষিত মাইয়া ছাড়া আমার এমএ পাস শিবুরে বিয়া করামু না।

অত শিক্ষিত মাইয়া জাইল্যা বংশে পাইবে কই!

বেশি শিক্ষিত না হউক, কম শিক্ষিত ত পামু।

শুন ভাইগনা, আমাগো সমাজে অল্পবয়সে মাইয়াদের বিয়া দিয়া দেওয়া হয়। এই অবস্থায় শিক্ষিত মাইয়া দূরে থাউক, বিয়াযোগ্য কইন্যা পাওয়াও মুশকিল। ইতস্তত গলায় বলল জগবন্ধু।

তুমি যাই বল আর তাই বল মামা, মেট্রিক পাস মাইয়া ছাড়া শিবুরে বিয়া করামু না।

একটা চাপা শ্বাস ফেলে জগবন্ধু বলল, দেখ, খোঁজ কইরে।

তুমিও যাইবে মামা, শিবুর বউয়ের সন্ধানে। সুধাংশু বলল।

তা যামু। কিন্তু কতদিন তোমার লগে গেরামে গেরামে ঘুইরতে পারমু, বইলতে পারছি না। কামাইলেই ত সংসার চলে আমার।

ঠিক আছে মামা। একটা শুভদিন দেইখে যাত্রা করুম আমরা। পরমেশ ঠাকুরের লগে কথা কইয়া দিন-তারিখ ঠিক কইরে তোমারে খবর দিমু মামা। আনন্দের ঝলক সুধাংশুর মুখম-ল জুড়ে।

এক সকালে কনে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল সুধাংশু আর জগবন্ধু। গ্রামের পর গ্রাম খুঁজে ফিরল তারা। সমুদ্রের কূলে কূলেই তো জেলেপল্লিগুলো। সেই পল্লিগুলোতে দিনের পরদিন কনের সন্ধান করে বেড়াল মামা-ভাগ্নে দুজন। কিন্তু শিবশঙ্করের উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে পেল না তারা। কাট্টলি, খেজুরতলি, সলিমপুর, ঘোড়ামারা, বাঁশবাড়িয়া, সীতাকু-, বাড়বকু-, বুরুমছড়া, আনোয়ারা—এসব গ্রামের জেলেপল্লি এদের হতাশ করল।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুধাংশু বলল, মামা, তাইলে শিবুর জইন্য মাইয়া খুঁইজে পামু না?

পাইবে না ক্যান? অবশ্যই পাইবে। তবে এইটা ঠিক যে, আমাগো সমাজে শিক্ষিত মাইয়া নাই। দেইখলে ত তুমি এতসব গেরাম ঘুইরা। 

তারপরও মামা, আমার এককথা, শিক্ষিত মাইয়াই বিয়া করামু শিবুরে।

একটু করুণ চোখে তাকাল জগবন্ধু সুধাংশুর দিকে। বলল, তুমি এক কাজ কর ভাইগনা। গেরাম ত দেইখলে, এবার শহরের জাইল্যাপাড়াগুলোতে খোঁজ নাও। চকবাজার, মনোহরখালি, টেকপাড়া, অভয়মিত্রঘাট, জলিলগঞ্জ, গোর্খাডাক্তার লেন—এইসব জায়গায় ত জাইল্যাপাড়া আছে। ওইখানে খুঁইজলে পাইয়াও যাইতে পার। কী যেন একটু করে ভাবল জগবন্ধু। সুধাংশুর দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, তই ভাগনে, আমি আর তোমারে সময় দিতে পারুম না। এই কয়দিনে সংসারে আমার টান পইড়েছে। এইবার নদী-সমুদ্রে নাইমতে হইবে আমায়।

ঠিক আছে মামা। পাথরঘাটায় আমার এক পিসতুতো দিদি আছে—প্রদীপেশ্বরী। বিধবা। ছেলে দশরথ আর গোপালরে বিয়া করাইছে। মাইয়া আছিল দুইখান। হেগোরেও বিয়া দিয়া ঝাড়া হাত-পা। আমারে সময় দিতে পাইরবে প্রদীপেশ্বরী দিদি। বড় একটা ঢোঁক গিলল সুধাংশু। তারপর বলল, মামা, তুমি আমার ভরসা—এই কথা মনে রাইখো।

ভাগ্নে সুধাংশুর কথা শুনে জগবন্ধুর চোখেমুখে গভীর একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

একরাতে অহল্যা চাপাগলায় জিজ্ঞেস করে, কী হইল? শিবুর জইন্য কইন্যা খুঁইজে পাও না? মামারে লইয়া শুধু যাইতেছ আর আইতেছ দেখতেছি।

সারা মুখে হতাশা ছড়িয়ে সুধাংশু বলল, কী বইলব তোমারে শিবুর মা, গেরামে গেরামে মাইয়া যে নাই, তা নয়। কিন্তুক দিশামতন কইন্যা নাই।

দিশামতন মাইনে?

কোনোটার নাক বোঁচা, কোনোটা টিঙটিঙে হাড়গিলা। আবার কোনোটা বিষম মোটা। বেশির ভাগ এমন কালাকোলা যে দেইখলে ভয় লাগে। আর—। বলে থেমে গেল সুধাংশু।

আর কী! অবাক হয়ে বলে অহল্যা।

শিক্ষিত মাইয়া নাই। একটাও শিক্ষিত কইন্যা পাইলাম না এতগুলা গেরাম ঘুইরাও। এক দুই কেলাস। বেশি অইলে কেলাস ফোর। আইচ্ছা, তুমিই বলো শিবুর মা—এইসব মাইয়াদের শিবুর পাশে মানায়।

তাইলে?

হতাশ হইয়ো না। আমি থাইমা যামু না। কোথাও-না-কোথাও, কোনো-না-কোনো গেরামে আমাগো শিবুর লাইগা একটা কইন্যা ত অবশ্যি অপেক্ষা কইরতেছে। হেরে খুঁইজে আমি বাইর করুমই করুম।

তা-ই কর। বিষণ্ণতা নিজের ভেতর চেপে রেখে বলল অহল্যা।

সেদিন দ্বিপ্রহরে প্রদীপদির বাড়িতে উপস্থিত হলো সুধাংশু। প্রদীপদি, সেরকমই ডাকত সুধাংশু, বুড়িয়ে গেছে অনেকটা। কানেও কম শুনতে শুরু করেছে। দীর্ঘদেহের প্রদীপদি কেমন যেন একটু ঝুঁকে গেছে সামনের দিকে। বয়স তো আর কম হলো না দিদির। সত্তর পেরিয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগে অর্জুনদাদাবাবু মারা গেছেন। সেই থেকে বিধবার বেশ প্রদীপদির। পুত্রদের সংসারে তার যে খুব প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, তা দিদির চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যায়।

প্রদীপদি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে, সুধাংশু! তুমি এই সময়। কোনো দুঃসংবাদ? দিদি কানে কম শোনে বলে উচ্চস্বরে কথা বলে। বয়রারা উঁচুগলাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।

সুধাংশু বলে, কোনো দুঃসংবাদ না দিদি। অইন্যা একটা দরকারে তোমার কাছে আইছি। সুধাংশুর কণ্ঠস্বরও উঁচুতে। নইলে প্রদীপদিদি যে শুনতে পাবে না।

কী দরকার?

দিদি, পরে বইল্লে হয় না? একটু পরে বলি! অনেক দূর থেইকে আইছি। কিছু খেতে দেও আগে।

ভাই সুধাংশুর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল প্রদীপদি। বলল, তাই তো। আমাকেও পাগলে পেয়েছে। বহুদিন পর এলে, কোথায় খাবার-দাবার দেব, তা নয়—শুধু বকবক করে যাচ্ছি তখন থেকে। ছোটবেলা থেকেই প্রদীপদি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলত সবার সঙ্গে।

ভাইকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে পানের বাটা নিয়ে বসল প্রদীপদি। দিদির সকল দাঁত অটুট এখনো। পুরু কাটা সুপারি দিয়ে পান চিবিয়ে খেতে কোনো অসুবিধা হয় না দিদির। সুধাংশুকে এক খিলি সাজিয়ে দিয়ে অন্য একটি নিজের মুখে পুরে প্রদীপদি জিজ্ঞেস করে, তা কী জন্য এসেছো বলো সুধাংশু?

সুধাংশু দিদির কাছে সকল কথা খুলে বলে। শেষে বলে, তোমার কাছে কোনো কইন্যার সন্ধান আছে নি দিদি?

প্রদীপদি আপনমনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর বলে, আমাদের পাড়ায় তো তেমন শিক্ষিত মেয়ে নেই। তবে...।

তবে কী দিদি?

শুনেছি কলাবাগিচায় একটা মেয়ে আছে। মেট্রিক পাস করে কলেজে পড়ে নাকি।

কার মেয়ে দিদি? দিব নি মাইয়াডা আমার পোলার জইন্য?

দেবে কি না তো জানি না। তবে রমাপতিবাবু বড় কড়া ধাঁচের মানুষ বলে শুনেছি।

কী রকম দিদি?

শুনেছি—কট কট করে কথা বলেন। তার কথায় কেউ দুঃখ পেল কি না—ভাবেন না। যা মুখে আসে, বলে ফেলেন।

কী করেন? রাজাগজা নি?

রাজাগজা না হলেও পয়সাওয়ালা। খাতুনগঞ্জের এক মার্চেন্ট অফিসের বড় কেরানি।

দিব নি মাইয়াডা শিবুর জইন্য? কিছুক্ষণ আগে বলা কথাটা পুনরায় বলে সুধাংশু।

কী করে বলব সুধাংশু! লোকটার সঙ্গে কথাটথা তো বলি নাই কোনোদিন!

তা দিদি কইন্যাটা দেইখতে সোন্দর নি?

এবার প্রদীপদি হি হি করে হেসে ওঠে। বলে, ওরে পাগলা, আমি কি কখনো মেয়েটাকে দেখেছি! তবে শুনেছি—মেয়েটি ছোট্টমতন। অসাধারণ সুন্দরী নাকি। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা শুনেছি—মেয়েটার চুল নাকি অসম্ভব লম্বা।

মুগ্ধ চোখে দিদির কথা শুনছিল সুধাংশু। দিদির বলা শেষ হলে আবেগি গলায় সুধাংশু বলে উঠল, দিদি, ওই মাইয়াডারে ঠিক কইরে দেও আমার শিবুর জইন্য।

ভাবছি—রমাপতিবাবু রাজি হবেন কি না। একে তো শহরের মেয়ে। তোমার বাড়ি ঘোর গ্রামে। একমাত্র মেয়ে। আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছে। তোমার বাড়িতে কতটুকু সুখে থাকবে—তা নিয়ে তো একটু মাথা ঘামাবেনই রমাপতিবাবু।

দিদি, আমরা সবাই মিল্যা কইন্যাডারে মাথায় তুইলা রাখমু।

দেখি কী করা যায়। সন্ধ্যার দিকে চল একবার গিয়ে দেখি রামপতিবাবুর বাড়িতে। তুমি তো চেন কলাবাগিচা?

চিন্তিতমুখে সুধাংশু ডানদিকে আস্তে করে মাথাটা কাত করে।

কী চাই? দরজার সামনে দুজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন রমাপতিবাবু।

সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন তিনি। জামাজোড়াও ছাড়েন নি এখনো। ঘরে ঢুকে পেছন ফিরে প্রদীপেশ্বরী আর সুধাংশুকে দেখতে পেয়েছেন তিনি। দুজনের কেউ-ই তাঁর চেনা নয়। নারীটির কাপড়চোপড় ভদ্রগোছের। চেহারাও ব্যক্তিত্বময়। কিন্তু পাশের লোকটির বেশভূষা মলিন। এই শহুরে সমাজে সুধাংশু বেশ বেমানান। কোন ঝুটঝামেলা নিয়ে হাজির হয়েছে এ দুজন কে জানে! অফিসে আজ কাজের চাপ ছিল বেশি। একটা চালানের হিসেবে গরমিল ধরা পড়েছে। ওটা অসমাপ্ত রেখেই বাড়িতে ফিরেছেন রমাপতিবাবু। মনটা অস্থির তাঁর। এই অবস্থায় অপরিচিত দুজনকে দেখে কড়া গলাতেই ‘কী চাই’ জানতে চেয়েছেন রমাপতিবাবু।

প্রদীপদি বলেছেন, যা চাইতে এসেছি তা দাঁড়িয়ে বলা যাবে না।

মানে! কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন রমাপতিবাবু। এই সময় ভেতরঘর থেকে রমাপতিবাবুর স্ত্রী বেরিয়ে আসেন। আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা পিঠের দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলেন, তুমি ভেতরে যাও তো। আমি কথা বলি ওদের সঙ্গে। বলতে বলতে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন গগনবালা। চিকনচোখে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে প্রদীপদিদি না? পাথরঘাটার? আসেন আসেন দিদি। আপনার ছেলে দশরথের বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলাম তো আমরা!

সুধাংশু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। প্রদীপদি স্মিত হাসলেন। দুজনে দাওয়ায় উঠে এলেন।

সোফায় বসার পর দুজনকে উদ্দেশ করে গগনবালা বললেন, আপনারা বসেন। আমি চা করে আনি। বলে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

রমাপতিবাবুর বাড়িটি কলাবাগিচা জেলেপাড়ার একটেরে। বাড়ির পাশে বড় নালা। বাড়িটির চারদিকে পাঁচিল। তিন কামরার টিনের ছাউনি। রান্নাঘরটি আলাদা। একটানা বড় বারান্দা। বারান্দায় বসার নানা আসবাব—চেয়ার, সোফা, মোড়া।

বাড়িটির সামনে উঠান। মাঝারি আকার। উঠানের দক্ষিণ পাশে কাঁঠাল আর আতাগাছ। উঠানের প্রায় মাঝখানটায় বয়োবৃদ্ধ একটা আমগাছ। বাড়িটির মূলগেটে লেখা—নারায়ণ বাড়ি।

তা কী জন্য এসেছেন? ঘণ্টাখানেক পরে এসে সোফায় বসতে বসতে রমাপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর কণ্ঠে আগের মেজাজ নেই। অনেকটা কোমল।

স্ত্রী হয়তো কিছু বলেছেন অথবা স্নান-খাওয়ার পর রমাপতিবাবু স্বাভাবিক হয়েছেন।

চা-নাস্তা পরিবেশন করতে করতে গগনবালা বলেছিলেন, কোনো দরকারে এসেছেন কি দিদি? উনি কে? সুধাংশুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি।

প্রদীপদি গলায় রহস্য ঢেলে বলেছিলেন, ব্যাপারটা কিছুক্ষণ গোপনই থাক দিদি। দাদা এলে রহস্যোন্মোচন করা হবে। কথার শেষের দিকে ঝানু গোয়েন্দার মতোই চোখেমুখে গূঢ় আবরণ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রদীপদি। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসেছিলেন গগনবালা।

মেয়ে দেখেতে এসেছি। প্রদীপদি রমাপতিবাবুকে লক্ষ করে বলেছিলেন।

কী মেয়ে! কার মেয়ে! পলকহীন চোখে জানতে চেয়েছিলেন রমাপতিবাবু।

আপনার মেয়েকে দেখতে এসেছি শিবশঙ্করের জন্য। প্রদীপদি বলেছিলেন।

আরে দিদি, আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না! কে শিবশঙ্কর? আর আমার মেয়েকে বিয়ে দেব, সেটাই বা জানলেন কোত্থেকে? রমাপতিবাবু বলেন।

দাদা, উপযুক্ত মেয়ে হলো আগুনের মতো। দূর থেকে বোঝা যায়। আপনার মেয়ে মেট্রিক পাস করে কলেজে পড়ছে জানি। মেয়েটা সুন্দরী তা-ও জানি। আর মেয়ে বড় হয়ে উঠলে সব মা-বাবাই তো মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে ভাবে।

একটা তৃপ্তির হাসি রমাপতিবাবুর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। তৎক্ষণাৎ গাম্ভীর্যের খোলসে ঢুকে পড়লেন রমাপতিবাবু।

আমার মেয়েকে যে এ মুহূর্তে বিয়ে দেব না, এমন নয়। তবে উপযুক্ত বর বলেও তো একটা কথা আছে! গগনবালা বলে উঠলেন।

শোনো সুলেখার মা, মেয়ে সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে উঠল। এত তাড়াতাড়ি সুলেখার বিয়ের কথা না ভাবলেও চলবে। বললেন রমাপতিবাবু।

সুধাংশু আচমকা বলে উঠল, আমার ছেইলে এমএ পাস।

কী—? তাচ্ছিল্য রমাপতিবাবুর কণ্ঠে।

হ। আমার পোলা শিবশঙ্কর এমএ পাস কইরেছে।

ভুজংভাজং করার আর জায়গা পান নাই? কৈবর্ত বংশে এমএ পাস—আমাকে শোনাতে এসেছেন! আর আপনার চালাকি আমি বুঝতে পারব না ভেবেছেন! রমাপতিবাবু প্রায় গর্জে উঠলেন।

গগনবালা আহতকণ্ঠে বললেন, আহ্ তুমি থামো তো! একজন মানুষের সঙ্গে এভাবে কথা বলছ কেন?

কীভাবে বললাম!

একটু মোলায়েম, একটু শান্ত কণ্ঠে। শেষ উপদেশ দিচ্ছেন এই ভঙ্গিতে বললেন গগনবালা।

আচ্ছা, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো—অজপাড়া গাঁয়ের একজন...। কথা অসমাপ্ত রেখে সুধাংশুর দিকে তাকালেন রমাপতিবাবু। বললেন, গ্রামের নাম কী বললেন?

উত্তর পতেংগা। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল সুধাংশু। সুধাংশু রমাপতিবাবুর এরকম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। দিদির মুখে রমাপতিবাবুর কাঠিন্যের কথা শুনে তখনই ঠিক করে ফেলেছিল—যতই রূঢ় ব্যবহার করুন ভদ্রলোক, সে স্বাভাবিক থাকবে।

রমাপতিবাবু তার অর্ধসমাপ্ত কথা শেষ করলেন, উত্তর পতেংগার মতো একটা জঙ্গুলে গ্রামের জেলেপাড়ায় একটা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, এমএ পাস করেছে—আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ তুমি?

গগনবালা বললেন, করতেও তো পারে!

করলে শুনতাম না?

কতজনের খবর রাখো তুমি? কটি জেলেপাড়ায় গেছ তুমি? তারপর স্বগতকণ্ঠে গগনবালা বলে গেলেন, সারাটা জীবন তো অফিস আর ঘর, ঘর আর অফিস করে কাটালে।

রমাপতিবাবু ইতস্তত কণ্ঠে বললেন, তারপরও আমার বিশ্বাস হয় না।

কী করলে আপনি বিশ্বাস করবেন? এতক্ষণ চুপ থাকা প্রদীপেশ্বরী উঁচু গলায় বললেন।

এমএ পাসের সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। উপহাসের একচিলতে হাসি রমাপতিবাবুর ঠোঁটের কোণে ঝলকে উঠে মিলিয়ে গেল।

যদি এমএ পাসের সার্টিফিকেট দেখাতে পারি, যদি আপনাকে বিশ্বাস করাতে পারি যে, শিবশঙ্কর এমএ পাস করেছে, তাহলে মেয়ে দেবেন তো? প্রদীপদি বললেন।

প্রদীপদির কথা শুনে রমাপতিবাবু একটু যেন ভড়কে গেলেন। বললেন, তখন চিন্তা করব। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটাকেও তো দেখতে হবে আমাদের। ঘরবাড়ির অবস্থা—এসবেরও তো একটা ব্যাপার আছে।

গগনবালা স্বামীর কথা শুনে মৃদু মৃদু মাথা নাড়তে লাগলেন।

কইন্যাটাকে কি একবার দেইখতে পামু? বোজা-কণ্ঠে বলল সুধাংশু।

রমাপতিবাবু আবার রুক্ষতার আড়ালে চলে গেলেন। নি®প্রাণ গলায় বললেন, আগে সার্টিফিকেট দেখান, তারপর মেয়ে দেখানোর বিষয়টি নিয়ে ভাবা যাবে।

অল্পবিদ্যা নিয়েও সুধাংশু বুঝতে পারে—রমাপতিবাবুর এ প্রস্তাব নিতান্ত অপমানের। একজন এমএ বা বিএ পাস কি না—তার প্রমাণ দিতে হয় চাকরিদাতাদের কাছে। ইন্টারভিউ-এর সময় নিয়োগবোর্ড চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে তার চৌকসতা যাচাই করে আর সার্টিফিকেট পরখ করে তার পাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। কনেপ্রার্থী আর চাকরিপ্রার্থী তো এক কথা নয়। কনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কোনো সন্দেহপ্রবণ অভিভাবক বিষয়টি যে যাচাই করেন না, এমন নয়। তাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বা নিকটতম বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে সন্দেহমুক্ত হন। কিন্তু এরকম সরাসরি সার্টিফিকেট দেখানোর প্রস্তাব! এ বড় অসম্মানের। এ বড় লজ্জার।

কী করবে সুধাংশু। তুড়ি মেরে রমাপতিবাবুর প্রস্তাবকে উড়িয়ে দেবে? বলবে—একী বললেন আপনি! মানি আপনি ধনী। তাই বলে গরিবদের আত্মমর্যাদাবোধটাকে এরকম ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাইছেন? গ্রামে থাকি বটে, আপনার মতো শিক্ষিত নই বটে, তাই বলে আমাদের হেলা-অবহেলা দেখিয়ে অপদস্ত করবেন? কী পেয়েছেন? জেলেপাড়াগুলো ঘুরে দেখেছেন কখনো? আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। শিবশঙ্করের মতো এমএ পাস ছেলে কোনো গ্রামেই খুঁজে পাবেন না আপনি। এমএ পাস দূরে থাকুক, আইএ পাস ছেলেও খুঁজে পাবেন না কোথাও।

শিবশঙ্করের চেহারার কথাই-বা আপনি ছেড়ে দেবেন কেন? আপনার মেয়েটাকে আমি দেখি নি। প্রদীপদি বলেছে—আপনার মেয়ে দেখতে নাকি সুন্দরী। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি—আমার ছেলের পাশে দাঁড়ালে আপনার মেয়ের সৌন্দর্য অবশ্যই নি®প্রভ বলে মনে হবে।

কী সুধাংশু, দাদার কথা শুনলে তো! সার্টিফিকেট দেখাবে? প্রদীপদি বললেন।

সুধাংশুর ভেতরে ভীষণ একরোখা একটা জেদ খলবলিয়ে ওঠে। বলতে ইচ্ছে করে—নিকুচি করি রমাপতিবাবুর মেয়ের। ছেলে এমএ পাস করেছে কি না—এটার প্রমাণপত্র দেখিয়ে বিয়ে করাবে শিবশঙ্করকে!

সুধাংশু আবার ভাবে—গ্রাম তো ঘোরা হলো অনেক। কোথাও তো শিব শঙ্কররের উপযুক্ত কনে খুঁজে পাওয়া গেল না। এখানে যদি রাজি না হই, তাহলে আবার খোঁজার-সমুদ্রে পাড়ি দিতে হবে। একধরনের বিপর্যয়-বিষণ্ণতা সুধাংশুকে ঘিরে ধরল। কোন রাজ্যে গিয়ে আবার কনের সন্ধান করবে সুধাংশু?

সুধাংশু, কিছু বলছ না যে? প্রদীপদিদি তাগাদা দেয়।

কথা দিতে পাইরছি না আমি। আজকালকার ছাওয়াল। দাদার প্রস্তাবটারে কীভাবে লয়, তা ত বুইঝতে পাইরছি না। এছাড়া আমার পরিবার-পরিজন ত আছে। এদের মতামতও জানা দরকার। রমাপতিবাবুকে শুনিয়ে শুনিয়ে যেন কথাগুলো বলল সুধাংশু।

দেখেন, ভেবে দেখেন। বলে সোফা থেকে উঠতে উদ্যত হলেন রমাপতিবাবু।

সুলেখাকে একবার এঁদের দেখালে হয় না? সুলেখা তো ঘরেই আছে। গগনবালা বলেন।

মাঝখানে কথা বলতে এসো না তুমি। তারপর মৃদুস্বরে রাগত কণ্ঠে রমাপতিবাবু বলেন, যত্তসব মেয়েলি বুদ্ধি।

কথাটা মৃদুস্বরে বললেও সুধাংশু শুনতে পেল। তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। কিল খেয়ে কিল হজম করল সুধাংশু। তখনই সে ঠিক করল—যে-কোনো মূল্যে এই রমাপতিবাবুর মেয়েকেই তার পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবে।

কথাটা পাড়তেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল শিবশঙ্কর। এই ভয়ই করেছিল সুধাংশু। তাই মামাকে খবর দিয়ে আনিয়েছিল। সত্যব্রতকেও সঙ্গে রেখেছিল। অহল্যাও ছিল দরজার আড়ালে।

এসব কী বলছ তুমি বাবা? বিস্মিত রাগান্বিত শিবশঙ্কর বলে।

সেই রকমই ত পরস্তাব দিলেন রমাপতিবাবু। আমতা আমতা করে বলল সুধাংশু।

কলাবাগিচা থেকে ফিরে এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে নি সে। জানে—এ প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মতো নয়। আগে বললে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। আজ তাই সবাইকে একত্রিত করে ঘটনাটা খুলে বলল।

সব শুনে অহল্যা বলল, একী কথা! মানুষরে এইরকম কইরে অপমান করে!

সত্যব্রত কিছু বলল না। তবে তার চোখমুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না—প্রস্তাবটা তার মনে অপমানের জ্বালা ধরিয়েছে।

ফেটে পড়া গলায় শিবশঙ্কর বলল, ওই পরিবারের ধারেকাছে যাবে না তুমি। আমার বিয়ে করার দরকার নেই। বাজে একটা পরিবার।

সবাই মন্তব্য করলেও বোনাই জগবন্ধু একেবারেই চুপচাপ রইল। মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছিল জগবন্ধু। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে বলল, তাইলে সুধাংশু, এই কইন্যা বাদ। সবাই মাইনতে রাজি নয় রমাপতির পরস্তাব। বলে বোনাই বৈঠক থেকে উঠে দাঁড়াল।

সুধাংশু মুখ কাঁচুমাচু করে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 

বিকেলে চলে যাওয়ার আগে ঘাটার আগায় দাঁড়িয়ে মামা-ভাগ্নে একান্তে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। তারপর মামা বলল, যাইরে ভাগনে!

চলো মামা তোমারে কিছুপথ আগাইয়া দি। উল্লসিত গলায় সুধাংশু বলল।

দুই মামা-ভাগ্নে নির্জনে দাঁড়িয়ে একান্তে কী কথোপকথন করল, তা আর কেউ জানতে পারল না। মামা এমন কী পরামর্শ ভাগ্নেকে দিল যে, সুধাংশু আনন্দিত হয়ে উঠল? সেই পরামর্শের রহস্যাবরণ বহু বছর পরে উন্মোচিত হয়েছিল।

এক বিকেলে রমাপতিবাবু আর গগনবালা সুধাংশুর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন ঘরদোরগুলো সাফসুতরা করে রাখা হয়েছিল। ভালো করে ঝাঁট দিয়ে উঠানে ছড়ানো গাছের পাতাগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শিবশঙ্কর স্কুলে চলে গিয়েছিল। সত্যব্রত আর সূর্যমোহনকে মাছমারায় পাঠিয়ে দিয়ে সুধাংশু ঘরে থেকে গিয়েছিল।

আগের রাতে কানের কাছে মুখ নিয়ে সুধাংশু ফিসফিসিয়ে বলেছিল, শিবুর মা, আগামী কাইল বৈকালে আমাগো বাড়িতে অতিথি আইব, বিশেষ অতিথি।

কে আইব? কোন অতিথি আইব? অহল্যা জিজ্ঞেস করেছিল।

কারা আইব, এই মুহূর্তে তোমারে বইলতে চাই না। আইলে দেইখবে।

তোমার কথার মাহাইত্য ত কিছুই বুইঝবার পারতেছি না! অহল্যার কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।

আহা অহল্যা! কাইল পর্যন্ত একটু চুপ মাইরা থাকো। কাইলকে সকল মাহাইত্য বুইঝতে পাইরবে। তোমার কাছে অনুরোধ—ঘরবাড়ি একটু পরিষ্কার কইরে রাইখো।

সত্যি পরদিন বিকালে অতিথিদের মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছিল অহল্যা। সুধাংশু চাপা কণ্ঠে বলেছিল, রমাপতিবাবু আর তাঁর বউ। শিবুকে দেইখতে আইছে।

স্বামীর কথা শুনে এক ঝলক শিহরণ অহল্যার সমস্ত শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সে বেয়াইন হবে। টুকটুকে সুন্দরী বউটি তার ঘরদুয়ার-উঠানময় হেঁটে বেড়াবে! নাতি-নাতনি... আর ভাবতে পারছে না অহল্যা। আহ! কী আনন্দ! কিন্তু সার্টিফিকেট না দেখালে যাঁরা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ভাববেন না পর্যন্ত, তারা কী করে অহল্যাদের বাড়িতে উপস্থিত হলেন? শিবুর বাপ কি সার্টিফিকেট দেখিয়েছে ওঁদের! ধুত্তুরি, তা কী করে হয়? যদি দেখাত, তাহলে তার সঙ্গে বিবেচনা করেই দেখাত। আজ পর্যন্ত তাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করেছে শিবুর বাপ?

মাথা থেকে এলেবেলে চিন্তা এক ঝটকায় বের করে দিল অহল্যা। অতিথিদের আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রমাপতিবাবুদের তুলনায় সুধাংশুর বাড়িঘরের অবস্থা অত্যন্ত দীন। টিনের ছাওয়া ঘরটি জর জর। বাঁশের বেড়ার ঘর। দরজাগুলো নড়বড়ে। বিয়ের পর মেয়ে আর জামাই কোন ঘরে বাস করবে—বুঝতে পারছেন না রমাপতিবাবু। বাড়ির চারদিক, পুকুরপাড় ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে ভালো যে একটা পায়খানা নাই, তা চোখ এড়িয়ে গেল না রমাপতিবাবুর। মনে মনে ঠিক করলেন—নাহ্, এই ঘরে সুলেখার বিয়ে দেবেন না তিনি। অনেক আদরে বড় করা মেয়েটি তাঁর বড় কষ্টে পড়ে যাবে। জেনে-দেখে তিনি তার মেয়েকে অভাবের আর অগোছালো সংসারে বিসর্জন দেবেন না।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর রমাপতিবাবু তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টালেন।

শিবশঙ্করকে দেখে তাঁর মন জুড়িয়ে গেল। গগনবালা চোখের পলক ফেললেন না। এরকম লম্বা, এরকম দিব্যকান্তি চেহারার যুবক তাঁরা আগে কখনো দেখেন নি।

মাঘের চৌদ্দ তারিখে বিয়ে হয়ে গেল ওদের—শিবশঙ্কর আর সুলেখার।

বিয়ের নানা ডামাডোলের মধ্যে বহু আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে ফাল্গুনীকে একপলক দেখে থমকে গিয়েছিল শিবশঙ্কর। এরকম মলিন মুখ কেন ফাল্গুনীর? কিছু বলতে যাওয়ার আগে কাজের অছিলায় অন্যত্র দ্রুত সরে পড়েছিল ফাল্গুনী। বোনকে নিয়ে কিছু সময় আনমনা থাকলেও বিয়েবাড়ির হট্টগোলে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছিল শিবশঙ্করকে। সেবার বেশকিছু দিন থেকে গিয়েছিল ফাল্গুনী। ফাল্গুনীর কোলে তখন প্রথম সন্তান—রঞ্জিত।

ছয়

বিয়ের আগে পুবদিকের খালি জায়গায় একটা ঘর তুলেছিল সুধাংশু। দুই কামরার। বেড়া আর ছনের। দরজার সামনে পৈঠা। তিন ধাপের। আধা চাঁদের মতো। ধাপগুলো লাল ও কালো রঙের। খোলা দাওয়া। সিমেন্টে বাঁধানো। একটা কামরা শোয়ার, অন্যটা বসার।

শিবশঙ্কর বিয়ের পর ও-ঘরেই উঠেছে। বসার ঘরটা চেয়ার-টেবিলে গুছানো। সামনের টুলে একুশ ইঞ্চির একটা টেলিভিশন। সাদা-কালো। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া। বিকাল পাঁচটায় বিটিভির শুরু। ওই সময় থেকে পরিবার-পরিজনেরা টেলিভিশনের সামনে জড়ো হয়। উত্তর পতেংগার জেলেপাড়ায় এটাই প্রথম টেলিভিশন। সন্ধের দিকে পাড়ার মানুষেরা ভিড় করে শিবশঙ্করের উঠানে। টেলিভিশন দেখবে। বাইরের দাওয়ায় টেলিভিশনটি বের করে দেওয়া হয়। সারা উঠানে যে যেখানে পারে, বসে যায়। রাত গভীর পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে থেকে ভিড় কমে না।

বিয়ের চার দিন পর। অপরাহ্ণ। বসার ঘরে শিবু আর সুলেখা বসে আছে। মুখোমুখি। সুলেখার জড়তা কাটে নি এখনো। মাথার ঘোমটা পড়ে যাচ্ছিল বারবার। আনাড়ি হাতে সুলেখা আঁচলটা মাথায় তুলে দিচ্ছিল।

সুলেখা ছোটখাটো। খুব পুষ্ট শরীর নয় তার। বিপুল কুন্তলরাশির মাঝে ধারালো ফরসা একটা মুখ। সে মুখ নিচের দিকে নামানো। শিবশঙ্কর পলকহীন চোখে সেই অধোবদনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মুচকি হাসে শিবশঙ্কর। মোহিতলাল মজুমদারের একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে যায় তার—তারি মাঝখানে কুন্তল লোল খসি পড়ে পায় কুহেলি-নিচোল।

ঠিক ওই সময় মুখ তোলে সুলেখা। শিবশঙ্করের মুখ থেকে তখনো হাসির রেখা মিলিয়ে যায় নি। অতি মৃদু গলায় সুলেখা জিজ্ঞেস করে, হাসছো কেন?

দুজনের বয়সের মধ্যে আট বছরের ফারাক। বিদ্যাতেও পার্থক্য। শিবশঙ্কর মনে মনে ঠিক করে রেখেছে—দাম্পত্যজীবনে এই পার্থক্যকে কখনো স্পষ্ট হতে দেবে না। সে ভেবে রেখেছে—তার বিবাহিত জীবন খবরদারির হবে না, হবে বন্ধুত্বের। এই জীবনের জলহাওয়া থাকবে সুখকর, স্বস্তিময়।

হাসিটাকে আবার সারা মুখে ছড়িয়ে শিবশঙ্কর বলে, এমনি এমনি।

সুলেখা বলে, মানুষ কি এমনি এমনি হাসে!

হাসে তো। হাসে না?

হাসে, তবে পাগলরা।

কী! তুমি আমায় পাগল বললে? গলায় কৃত্রিম রাগ ঢেলে বলে শিবশঙ্কর।

তাহলে বলো—কেন হাসছিলে?

এবার সুলেখার মায়াময় দুটো চোখে নিজের স্থির চোখ দুটো রেখে বলে, তোমাকে দেখে।

আমাকে দেখে কি হাসি পায়? মানুষের!

আমার পায়। তবে সে হাসি ভালোবাসায় জড়ানো।

এক অপার তৃপ্তির আভা সুলেখার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু-একটা বলতে যাবে, ওই সময় ফাল্গুনীর কণ্ঠ শোনা যায়, আসি বউদি?

দুজনে একসঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে দেখে, ফাল্গুনী দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে একটা প্যাকেট। 

এসো এসো ফাল্গুনী। বলে ওঠে শিবশঙ্কর।

ফাল্গুনী পাশের একটা চেয়ারে বসে। বিষণ্ণ চেহারা। মুখটা হাসিময়। সে হাসিটা যে সুখের নয়, শিবশঙ্কর বুঝতে পারে।

সুলেখার অতটুকু সংসারাভিজ্ঞতা হয় নি, এখনো।

শিবশঙ্কর বলে, বাড়ি আমাদের, বোনটিও আমার। কিন্তু ঘরে ঢোকার অনুমতিটা চাইলে ওই মহিলার কাছে! তাজ্জব বনে গেলাম আমি ফাল্গুনী! শিবশঙ্করের কণ্ঠ প্রশ্রয়ের।

এবার হি হি করে হেসে উঠল ফাল্গুনী। এখন থেকে তুমি এবাড়ির অতিথি দাদা। অতিথির মানে জানো তো? অতিরিক্ত অবস্থান করে যে। এ ঘরের আসল মালিক এখন বউদি। তাই তো ওর কাছে অনুমতি চাওয়া। কী বলো বউদি, ঠিক বলি নি?

ননদিনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটু হাসল সুলেখা। দুই ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্ক কী রকম—বন্ধুত্বের না দূরত্বের, আন্দাজ করবার চেষ্টা করতে লাগল সে। বিয়ের ভিড় ভাড়াক্কার মধ্যে এক-দুবার মুখোমুখি হয়েছে ফাল্গুনীর। টুকটাক দু-একটা বাক্যও যে বিনিময় হয় নি, এমন নয়। কিন্তু কোনো মানুষকে বুঝে ওঠার জন্য যে সময়ের ও সঙ্গের দরকার তা পায় নি সুলেখা। তাই যে স্বাচ্ছন্দ্যে শিবশঙ্করের সঙ্গে কথা বলছিল সুলেখা, ফাল্গুনী আসার পর নিজেকে গুটিয়ে নিল সে।

ফাল্গুনী সুলেখার গুটিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি তার চোখমুখ দেখে কিছুটা অনুমান করে নিল। বউদির আড়ষ্টতা কাটাবার জন্য ফাল্গুনী বলে উঠল, দাদার সঙ্গে সম্পর্ক আমার ভয়ের নয়। কষ্ট ভাগাভাগি করি আমরা। দুজনের কথার মধ্যে ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই।

এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সুলেখা। স্পষ্ট চোখে তাকাল ফাল্গুনীর দিকে। বলল, দিদি, আমার কোনো বড়দি নাই।

ফাল্গুনী বুঝল—বউদি ছোটখাটো হলে কী হবে, বুদ্ধি রাখে।

শিবশঙ্কর বলল, আমাকে কিছু বলতে দেবে? সেই থেকে দুজনে কথা চালিয়ে যাচ্ছো! আমি যে একজন মানুষ এ ঘরে বসে আছি। দুজনের কেউ-ই তো পাত্তা দিচ্ছো না দেখছি।

তিনজনে গলা চড়িয়ে হেসে উঠল।

ওই সময় কোত্থেকে অনুরাধা এসে হাজির হলো। বউদির পাশ ঘেঁষে বসে সেও হাসা শুরু করল।

কী রে অনুরাধা, তুই হাসছিস কেন?

তোমরা হাসছো বলে আমিও হাসছি দিদি।

আমরা হাসছি বলে তুইও হাসবি? আমরা হাসছি একটা কারণে, তুই তো সেই কারণটা শুনিস নি। না শুনেই...।

দিদির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বড়দের মতো গম্ভীর কণ্ঠে অনুরাধা বলে উঠল, হাসি সংক্রামক। বলেই হি হি হাসিতে ফেটে পড়ল অনুরাধা। সেই হাসি আর থামল না অনেকক্ষণ।

ফাল্গুনী বলল, এই মেয়েটির নাম মা-বাবা কেন যে অনুরাধা রেখেছে বুঝলাম না। এর নাম হওয়া উচিত ছিল—লাস্যময়ী অথবা হাসিরাশি।

কৃত্রিম অভিমানে অনুরাধা বলে উঠল, দিদি...। ভালো হবে না কিন্তু।

ফাল্গুনী কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। তারপর মুগ্ধ চোখে অনুরাধার দিকে তাকিয়ে শিবশঙ্করকে লক্ষ্য করে বলল, দেখেছ দাদা, অনুধারা ক-ত বড় হয়ে উঠেছে! সারা উঠানময় হামাগুড়ি দেওয়া আমাদের অনুরাধা, দি-দি, দা-দা বলে বলে কোমল পায়ে আমাদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ানো বোনটি কী রকম চোখে লাগার মতো হয়ে উঠেছে খেয়াল করেছ?

দিদি, এসব কী বলছ তুমি! অনুরাধা বলে ওঠে।

সত্যি তাই তো! এতদিন তেমন চোখে অনুরাধার দিকে তাকায় নি তো শিবশঙ্কর! কাজের ব্যস্ততার মধ্যে, অভাব-দারিদ্র্যের ভেতর দিন যাপনের কারণে ছোট বোনটির দিকে লক্ষ রাখে নি সে। আজ ফাল্গুনী বলার পর খোলা চোখে অনুরাধার দিকে তাকিয়ে দেখল শিবু। আহা, তার বোনটি এত বড় হয়ে গেছে! সে এরকম সুন্দরী হয়ে উঠেছে। যৌবনের আভা অনুরাধার শরীরকে যে স্পষ্টতর করে তুলেছে, তা এতদিন শিবশঙ্করের চোখ এড়িয়ে গেছে।

শিবশঙ্কর ফাল্গুনীর কথার উত্তরে কী বলবে—ঠিক করতে পারল না।

ওকে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করো দাদা। বলে ফাল্গুনী।

ধুত্তুরি রঞ্জিতের মা। আমি আর এখানে থাকব না।

কী বললি! রঞ্জিতের মা! দিদি নয়! এই এই তুই রঞ্জিতের মা বললি কাকে? হ্যাঁ! ফাল্গুনী বলে উঠল।

দিদিকে ক্ষেপানোর একটা মন্ত্র পেয়ে গেল অনুরাধা। বলতে থাকল—রঞ্জিতের মা, রঞ্জিতের মা।

তবে রে...। বলে অনুরাধাকে তাড়া দিল ফাল্গুনী। অনুরাধা দাদার চেয়ারের ফাঁক দিয়ে, বউদির গা ঘেঁষে রঞ্জিতের মা, রঞ্জিতের মা বলে বলে দৌড়াতে লাগল।

বোনের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ হাউমাউ করে উঠল ফাল্গুনী। চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। একটুক্ষণ পরে নিজেকে সংযত করে সবার উদ্দেশে বলল, তোমরা কিছু মনে করো না। হঠাৎ চোখের জল এসে গেল।

সুলেখা-অনুরাধা হতভম্ব হয়ে ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে থাকল। কী করবে বা কী বলবে—ঠিক করতে পারছিল না শিবশঙ্কর। তার চোখমুখ তখন বিস্ময়-অস্বস্তি-করুণায় একাকার। ধীরে ধীরে পাশে রাখা প্যাকেটটা হাতে তুলে নিল ফাল্গুনী। অন্যমনস্কভাবে একটু নাড়াচাড়া করল। তারপর সুলেখার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, এটা রাখো বউদি। এরচেয়ে বেশি কিছু তোমাকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। বলে চুপ মেরে গেল ফাল্গুনী।

শিবশঙ্কর উচ্ছ্বাসময় গলায় বলল, কী ওটা? শাড়ি! শুধু বউদির জন্য আনলে! আমি তোমার আপন ভাই। আমাকে কোনো উপহার দিলে না, বিয়ে উপলক্ষে?

ফাল্গুনী ম্লান একটু হাসল। এরকম হাসি যারা হাসতে জানে, ভেতরের অতলান্ত বেদনার কথা তাদের আর মুখ ফুটে বলতে হয় না। ফাল্গুনী মাথা নিচু করে বসে থাকল।

সুলেখা কিছু-একটা অনুমান করল। সে কি আন্দাজ করতে পারল—ননদিনীর অসহায়তার কথা? সুলেখার চোখমুখ দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। অত্যন্ত মৃদু গলায় কোমলস্বরে স্বামীকে উদ্দেশ করে বলল, দিদি জানে কাকে উপহারটা দিলে গোটা বাড়ি হাসবে। তাই তো আমাকে শাড়ির প্যাকেটটি দেওয়া। তোমার এত পাই পাই ভাব কেন? আমার প্রাপ্তিতে ভাগ বসাতে চাইছ? দেখো দিদি, অভিযোগটা কিন্তু আমি তোমাকে দিয়ে রাখলাম। আবহাওয়াটাকে হালকা করার জন্য সুলেখার এরকম কথাগুলো বলা। কিন্তু ইপ্সিত বাতাবরণ আর ফিরল না শিবশঙ্করের বৈঠকঘরে। কষ্টের একটা হাওয়া সারা ঘরময় ভেসে বেড়াতে লাগল।

এই সময় অনুরাধা বলে উঠল, চলো বউদি, আমরা ও-ঘরে যাই। আমার আর তর সইছে না। দিদি তোমাকে কী শাড়ি দিল তা দেখতে বড় ইচ্ছে করছে আমার।

অতি চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুলেখা বলল, চলো চলো রাধা।

শুধু খুলে দেখালে চলবে না, পরতেও হবে। দিদিকে পরে দেখাতে হবে না?

সুলেখা আর অনুরাধা ভেতরের ঘরে চলে গেল।

শিবশঙ্কর স্তব্ধ হয়ে ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে থাকল। ফাল্গুনীর চোখ তখন বাইরে। চোখ দুটো অশ্রুময় কি না দেখার উপায় নেই শিবশঙ্করের।

কী হয়েছে ফাল্গুনী! কী হয়েছে তোমার। ফাল্গুনীর কানে বহু দূর থেকে দাদার কণ্ঠস্বর এসে পৌঁছাল।

দাদার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না সে। শুধু একটু নড়েচড়ে বসল।

শিবশঙ্কর চূর্ণবিচূর্ণ গলায় আবার বলল, আমাকে খুলে বলো ফাল্গুনী। তুমি এরকম করে কেঁদে উঠলে কেন?

কিছু না দাদা। মেয়েদের কতরকম দুঃখ থাকে।

কী দুঃখ তোমার ফাল্গুনী! কী বেদনা তুমি নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছ?

বললাম তো দাদা, আমার কিছু হয় নি। বলে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল ফাল্গুনী। ফুলে ফুলে কাঁদল বহুক্ষণ। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফাল্গুনী মরাগলায় বলল, সবকিছুর খোঁজখবর না নিয়ে কেন দাদা আমাকে ও-ঘরে বিয়ে দিয়েছিলে?

শিবশঙ্করের রা বন্ধ হয়ে গেল। এসব কী বলছে ফাল্গুনী! ফাল্গুনীর বিয়ে হওয়ার পর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। নানা সময়ে নাইয়র এসেছে বাপের বাড়িতে। কই কোনোদিন তো তার অসুখী চেহারা দেখি নি। হয়তো ফাল্গুনী বেদনায় চুরচুর চেহারা নিয়ে এসেছে। ভালো করে চোখ মেলে দেখে নি বলে বোনটির ক্লান্ত, কষ্টলগ্ন মুখটি তার চোখ এড়িয়ে গেছে! কী কষ্ট ফাল্গুনীর? তাকে কষ্ট দেওয়ার লোক কে—শ্বশুর, না শাশুড়ি? না ফাল্গুনীর স্বামী অরবিন্দ? আরে অরবন্দিকে তো শিবশঙ্কর গোটা বিয়েজুড়ে চোখে দেখে নি!

যেদিন ফাল্গুনী এসেছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, অরবিন্দ এল না? ফাল্গুনী নিম্নকণ্ঠে কী উত্তর দিয়েছিল, খেয়াল করে নি শিবশঙ্কর। ধরে নিয়েছিল—পরে হয়তো অরবিন্দ আসবে। বিয়ের তো এখনো দুদিন বাকি। বিয়ের আগের দিন বা বিয়ের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হয়তো আসবে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন বা বিয়ের দিন অথবা বিয়ের পরেও তো অরবিন্দকে চোখে দেখে নি শিবশঙ্কর। ঘরভর্তি নানা আত্মীয়স্বজন। ছোটবড় খামতি-উল্লাসের মধ্যে এই কয়েকটা দিন কেটে গেল। কিন্তু একবারের জন্যও কেন অরবিন্দের কথা মনে পড়ল না শিবশঙ্করের? বড় লজ্জা অনুভব করতে লাগল শিবশঙ্কর! তার একমাত্র বোনের স্বামী এল না তার বিয়েতে। কিন্তু মা-বাবাও তো একবারের জন্য তাকে বলল না—অরবিন্দ এল না কেন? কোনো ভজকট? মা-বাবার সঙ্গে? তাহলে ফাল্গুনী সেদিকে ইশারা করল না কেন? সে তো স্পষ্ট গলায় বলল—সবকিছুর খোঁজখবর না নিয়ে কেন দাদা আমাকে ও-ঘরে বিয়ে দিয়েছিলে?

একথা সত্যি যে, ফাল্গুনীর এ বিয়েতে শিবশঙ্করের মত ছিল না, মা-ও ছেলের তথ্য সন্ধান না করে মেয়ের বিয়ে দেওয়াকে মেনে নিতে পারে নি। বাবা আর সত্যব্রত অনেকটা গায়ের জোরেই শিকলভাঙায় ফাল্গুনীকে বিয়ে দিয়েছিল। বহুদিন অভিমানে অভিমানে ফুলে ছিল শিবশঙ্কর। পরে মেনে নিয়েছিল সবকিছু। অরবিন্দও যে শ্বশুরবাড়িতে আসে নি, এমন নয়। যতবার এসেছে হাসিখুশিই দেখেছে তাকে। গ-গুলে বলে মনে হয় নি কখনো। তাহলে, তাহলে ফাল্গুনীর আজ একথা কেন!

ফাল্গুনীরে! আমাকে খুলে বলো সব। কী হয়েছে বোন তোমার? আর্তনাদের গলায় বলে উঠল শিবশঙ্কর।

হঠাৎ ফাল্গুনী নিজেকে গুটিয়ে ফেলল। সংযত গলায় বলল, দাদা, রঞ্জিতকে মায়ের কাছে রেখে এসেছি অনেকক্ষণ। যাই দাদা। বলে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ফাল্গুনী।

নিমীলিত চোখে চেয়ারে নিথর দেহটি এলিয়ে দিয়ে বসে থাকল শিবশঙ্কর। তার মুখের মধ্যে তখন অসহনীয় তেতো।

পাঁচটা দিন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে কাটল শিবশঙ্করের। ছুটি ফুরালে স্কুলে যাতায়াত শুরু করল, দুবেলা ভাত খেল, মা-বাপ-ভাইদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাও সারল। কিন্তু যথা-অভ্যাসের চোখে না তাকিয়ে অভিনিবেশি চোখে তাকালে বোঝা যেত—শিবশঙ্করের মধ্যে শিবশঙ্কর নেই। তার ভেতর ভয়ংকর এক আর্তনাদ চ-মূর্তি ধারণ করে ভৈরব-নৃত্য করে যাচ্ছে। একটা কলের পুতুলের মতো নিজ জীবনের চৌহদ্দির মধ্যে সে শুধু ঘুরছে-ফিরছে। নিত্যদিনের অভাবের পাথরে ঠক্কর খেতে খেতে পিঠাপিঠি দুই ভাই-বোন ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে। দুজনের মধ্যে খুনসুটি যে হয় নি, জোর গলায় বলা যাবে না। হয়েছে। তবে তার স্থায়িত্বকাল অতি সামান্য। অচিরেই কলহের কথা ভুলে শিবশঙ্কর বলেছে—কী রে ফাল্গুনী, স্কুলে গেলে না আজ? অথবা ফাল্গুনী দাদার দিকে একটি কাঁচা আম এগিয়ে ধরে বলেছে—দাদা, আমটা তুমি ছিলে ফেল, আমি লবণ আর মরিচের গুঁড়া নিয়ে আসি। ফাল্গুনী নামের বোনটি তার চোখের সামনে হামাগুড়ি অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল, ছোট্টটি থেকে বালিকা, বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুণীতে রূপান্তরিত হলো। প্রতি পলে পলে এই বোনটির প্রতি তার টানটি দিনকে দিন প্রবলতর হয়েছে। মা-বাবা কোনোদিন ফাল্গুনীর গায়ে হাত তোলে নি। হাততোলা তো দূরের কথা, কোনোদিন বকেছে তারা—এই দৃশ্যটি কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না শিবশঙ্কর। তার সঙ্গে শিবুর স্মৃতি শুধু ভালোবাসার। তার এই বোনটি কাঁদল। দুচোখ ভাসিয়ে কেঁদে গেল ফাল্গুনী! আহ! কী মর্মবেদনার দৃশ্য।

ওই ঘটনার পাঁচ দিনের পর সুলেখা বাপের বাড়িতে নাইয়রে চলে গেল। এটাই নিয়ম—বিয়ের দশ দিনের মাথায় নববধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে যাবে। সুলেখার কাকাতো ভাই হিমাদ্রি নিতে এসেছিল তাকে।

মাঝখানে একদিন ফাল্গুনী শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। ফাল্গুনীকে নিতে আসে না কেউ। বিয়ের মাস দুয়েক পরেই ফাল্গুনীর শাশুড়ি জানিয়ে দিয়েছিল, বেয়াই আপনের মাইয়ারে আইনতে যাইতে পাইরবে না কেউ। নাইয়র লইয়া যাইবেন, আবার নির্দিষ্ট দিনে দিয়া যাইবেন।

সুধাংশু বলতে চাইছিল কিছু। তাকে থামিয়ে দিয়ে বেয়াইন আবার বলে উঠেছিল, আমার এককথা। কথা বাড়াইবেন না। বাড়াইলেই দুঃখ।

এটা ধমক না উপদেশ সেদিন বুঝে উঠতে পারে নি সুধাংশু। বেজার মন নিয়ে নিজবাড়িতে ফিরে এসেছিল সে।

ফাল্গুনী আগামী কাইল চইলে যেতে চায়। সইত্যব্রত দিয়া আইব তারে। মা অহল্যা শিবশঙ্করকে বললে শিবশঙ্কর শুধু বলেছিল, মা, ওকে আর কটা দিন থেকে যেতে বলো।

কেন আর কয়েকটি দিন বাপের বাড়িতে থেকে যেতে বলল—তার কোনো কারণ দেখাল না শিবশঙ্কর।

যেদিন সুলেখা বাপের বাড়িতে চলে গেল, সেদিন সন্ধ্যাবেলা ফাল্গুনীর মুখোমুখি বসল শিবশঙ্কর। মা-বাবা আর ভাইদেরও ডেকে বসাল। বয়সে ছোট বলে ব্রজেন্দ্র আর অনুরাধাকে ডাকা হলো না এ আসরে। সবাই শিবশঙ্করের বৈঠকঘরে গোল হয়ে বসেছে।

স্পষ্ট গলায় শিবশঙ্কর বলল, ফাল্গুনী, খুলে বলো সব। কণ্ঠ শুনে সবাই চমকে তার দিকে তাকাল। শিবশঙ্করের এরকম কষ্টদীর্ণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠ তো এরা আগে কখনো শোনে নি!

ফাল্গুনী বলল, কী বলব দাদা!

সব, সবকিছু খুলে বলো ফাল্গুনী। তার কণ্ঠ শেষের দিকে হঠাৎ বুজে এল।

যা হয়ে গেছে, গেছে। আমার ভাগ্যকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না।

অহল্যা বলে উঠল, কী কইতেছে দুই ভাইবোনে বুইঝতে পারছি না তো! ও শিবু ও বাছা, খোলসা কইরে কও না ক্যান?

আমি কী খোলসা করব মা? খোলসা করবে তো ওই সত্যব্রত আর আমার বাপ।

সত্যব্রত চোখ বড় বড় করে বলে, তুমি কী বিষয়ে কথা বইলতেছ দাদা, বুইঝতে পারছি না আমি।

কী বাপ, কী হইয়েছে? ফাল্গুনী, অ-মা ফাল্গুনী, তোর কি কিছু হইয়েছে মা? বলতে বলতে ফাল্গুনীর বাহু ধরে ঝাঁকাতে লাগল অহল্যা।

আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠল সুধাংশু। তার কান্নায় সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। ফাল্গুনী-শিবশঙ্করের রহস্যময় কথোপকথন, সুধাংশুর বুকভাঙা কান্না—এসবের কোনো মমার্থই সত্যব্রত-সীতানাথ-অহল্যা বুঝতে পারল না। সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে যেতে লাগল।

আমি বইলতেছি। আমি বইলতেছি বাপ। ফাল্গুনী যা বইলবে, তা আমি বইলতেছি তোমাগো সকলেরে। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলে গেল সুধাংশু।

এই সময় ফাল্গুনী প্রায় চিৎকার করে উঠল, দোহাই বাবা, তুমি কিছু বলো না বাবা। শুনলে ওদের বুক চুরমার হয়ে যাবে বাবা। বলতে বলতে আঁচলে মুখ ঢাকল ফাল্গুনী।

আর বাধা দিস না মা। বহুদিন ধইরে আমার বুকের মইধ্যে রাবণের চিতা জ্বইলছে। আমি পুইড়ে পুইড়ে খাঁক হইয়ে যাচ্ছি। আমারে একটু হালকা হইতে দে মা। তারপর শিবশঙ্করের দিকে তাকিয়ে সুধাংশু বলল, আমি অপরাধী শিবু। আমিই ফাল্গুনীরে ঠেইলে যন্ত্রণার চিতায় তুইলে দিছি।

এরপর গোটা ঘরজুড়ে ঘোর নিস্তব্ধতা। সবাই চুপচাপ। শুধু বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে ‘চিতায় তুইলে দিছি’—এই কথাটি ভেসে বেড়াতে লাগল।

শোক দমন করে সুধাংশু বলতে শুরু করল, মামা যখন পরস্তাবটা আইনল, খুশিতে মনটা আমার দোল খেইয়ে উঠল। শিক্ষিত পোলা, ভালা বেতন পায়। মাইয়াডা আমার পরম সুখে থাইকবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সুধাংশু। কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখটা ঘষে ঘষে মুছে নিল। বলল, ভাইবলাম—এই পাড়ার ক-ত মাইয়ার ত বিয়া হয়। জামাইদের কেউ মাছ ধরে, কেউ মাছ বেচে। কামলাগিরিও করে কেউ কেউ বহদ্দারদের নৌকায়। এই সমাজে শিক্ষিত জামাই পাওয়া মাইনে হাতে চাঁদ ধইরতে পারা। তই অরবিন্দের কথা শুনে মনডা আমার নেইচে উঠল। মন বইল্ল—এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না সুধাংশু। তোমাদের ডাইকলাম। তোমরা ব্যাপারটারে আবেগ দিয়া নিলা না। বইল্লে—ছেইলের খোঁজখবর ভালা কইরে নেও। শিবু ত বিয়া দিতেই রাজি হইল না। সইত্যব্রত আমারে সমর্থন কইল্ল। শিবুর মা, তোমারে উপেক্ষা কইল্লাম আমি। শিবুর কথা শুইনলাম না। আমি আর সইত্য গিয়া দূর থেইকে হারামজাদারে দেইখে আসলাম। ভগমানরে...।’ আবার কান্না শুরু করল সুধাংশু।

ফাল্গুনী এগিয়ে গিয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরল। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফাল্গুনীর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সুধাংশু বলল, আমারে মাফ কইরে দেরে মা। মাফ কইরে দে।

বিয়ের বছরখানেক পরের ঘটনা। ফাল্গুনীকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইয়র আনতে গেছে সুধাংশু। বেয়াইবাড়ি উত্তরপাড়ায়। মাঝখানে পুবে-পশ্চিমে খাল। খালের দক্ষিণ পাড়ে পিসির বাড়ি। সুশীলা সুধাংশুর পাড়াতো পিসি। বলরাম জেঠার ছোট মেয়ে। সুধাংশুর চেয়ে বছর সাতেকের বড়। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় সুশীলা পিসির কোনো পরামর্শ নেয় নি সুধাংশু। শিকলভাঙা গাঁয়ের জেলেপাড়ায় মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে সুধাংশু। বহু বছর আগে এপাড়াতেই তো বিয়ে হয়েছে পিসির। এ পাড়ার নাড়িনক্ষত্র তার জানা। ভজহরির ছেলে অরবিন্দ। স্ত্রী অচলা। সবাকার স্বভাব-চরিত্তি পিসির অনুপুঙ্খভাবে জানা। ঠেঁটা ধরনের মহিলা অচলা। তারই আঁচলে বাঁধা ভজহরি। অরবিন্দ সম্পর্কেও আকথা-কুকথা শোনা আছে সুশীলা পিসির। পিসি আশা করেছিল— ফাইনাল কথা দেওয়ার আগে সুধাংশু অন্তত একবার তার কাছে আসবে।

কিন্তু সুধাংশু যায় নি তার কাছে। বউ অহল্যার প্রস্তাবকেও অনেকটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে সুধাংশু। অরবিন্দের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকটা এককভাবে নিয়ে ফেলেছে সে। এজন্য সুশীলা পিসির মনে প্রচণ্ডক্ষোভ জমা ছিল।

সেবার পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে সুশীলা পিসির উঠান দিয়ে যাচ্ছিল সুধাংশু। দাওয়া থেকে দেখতে পেয়ে ডাক দিয়েছিল পিসি, সুধাংশু, অ সুধাংশু, কই যাও?

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ছিল সুধাংশু। মনে মনে লজ্জিতও হয়েছিল একটু। একই পাড়ার বাসিন্দা হয়েও ফাল্গুনীর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে নি পিসিকে। ঠিক করল, পিসির ডাকে সাড়া না দিয়ে এগিয়ে যাবে। ডান পা সামনে বাড়াবে—ওই সময় পিসির কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল, সুধাংশু, যাইয়ো না। আমার বাড়িতে আসো। এক খিলি পান খাইয়া যাও।

সুধাংশু মর্মাহত চোখ দুটো পিসির দিকে তুলল। সুধাংশুর ইতস্ততার ব্যাপারটি পিসির বুঝতে অসুবিধা হলো না।

সহজ গলায় বলল, আরে, আসো আসো সুধাংশু। এক কাপ চা আর দুইখান বিস্কুট ত খাইয়া যাইবা পিসির বাড়ি থেইকে।

পিসির কথা শুনে সুধাংশুর আড়ষ্টতা কেটে গেল। এগিয়ে গিয়ে পিসির দাওয়ায় পিঁড়িতে বসল।

সুশীলা পিসি ভেতরঘরের দিকে গলা উঁচিয়ে বলল, বউমা, অ বউমা। পতেংগা থেইকে আমার ভাইপো আইছে। পানের বাটাটা দিয়া যাও। আর একটু চা-নাস্তার বেবস্থা করো।

পিসি আড়চোখে সুধাংশুকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করল। চোখেমুখে হাসি ছড়িয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তা মেইয়ে কেমন আছে সুধাংশু, শ্বশুরবাড়িতে?

শ্বশুরবাড়ি শব্দটি সুশীলা পিসি একটু চিবিয়ে বলল বলে মনে হলো সুধাংশুর। নিজের কানকে বিশ্বাস না করে সুধাংশু মনে মনে বলল—দূর, শুধু শুধু চিবিয়ে বলতে যাবে কেন পিসি? নিশ্চয় সে কানে ভুল শুনেছে।

সুধাংশু বলল, ফাল্গুনীর কথা বইলছ পিসি? হ্যাঁ, ফাল্গুনী ত সুখেই আছে শ্বশুরবাড়িতে।

তুমি ঠিকঠাকমতো জানো নি? মেইয়েরে শুধাইছনি কুনুদিন?

তোমার কথা ভালা করি বুইঝতে পারছি না পিসি। ফাল্গুনী অসুখে থাইকবে ক্যান? তৃপ্তির আভা সারা মুখে ছড়িয়ে সুধাংশু বলল, হাজার হইলেও পড়ালেখা জানা ছেইলে। বড় চাকরি করে।

হেই জইন্যই ত তোমারে জিগাইলাম সুধাংশু— মাইয়া সুখে আছে নি?

তোমার কথা কিছুই আন্দাজ কইরতে পারছি না পিসি! বিস্মিত কণ্ঠস্বর সুধাংশুর।

ওই সময় পিসির পুত্রবধূ দুকাপ চা, পিরিচে কিছু বিস্কুট আর পানের বাটাটি দুজনের সামনে রাখল। উপুড় হয়ে বউটি সুধাংশু আর পিসিকে প্রণাম করল।

পিসি বলল, যাও বউ। এরপর সুধাংশুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, সুধাংশু, চা-নাস্তা খাও। মুখে একটা পান দাও।

পিসি, তোমার কথা শুইনে পরানডা আমার ধড়ফড় কইরতেছে। কীসের যেন আলামত পাচ্ছি তোমার কথায়। খুইলে বইলবে নি পিসি?

সে হবেক্ষণ। অহন তুমি খাইয়া লও।

সুধাংশু একটা বিস্কুট চা-তে চুবিয়ে মুখে দিল। একচুমুকে চা শেষ করল। পানটা আর মুখে দিল না।

পিসিকে জিজ্ঞেস করল, বল পিসি, কী বইলতে চাইছ তুমি?

মেইয়েডা বিয়া দওনর আগে আমারে কিছু জিগাইলা না সুধাংশু। উপেক্ষা কইল্লা আমারে। পোলাডার কুনু সন্ধান নিলা না। শাশুড়ি অচলারও খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ কইল্লা না তুমি! অভিমান-মেশানো গলায় বলে গেল সুশীলা পিসি।

ওদের সম্পর্কে কী জিগামু? ওরা ত ভালা। বেয়াই ত মাডির মানুষ।

হ। তোমার বেয়াই মাডির মানুষ। বউয়ের আঁচল ধরা। ও ছাড়া উপায়ও নাই ভজহরির। অই রকম বউয়ের হাতে পইড়লে বোবা হইয়া থাকন ছাড়া উপায় নাই।

মাইনে! অবাক কণ্ঠে সুধাংশু সুধায়।

শুন সুধাংশু, সোজাসরল মানুষ তুমি। নিজের মইধ্যে ঘোরপ্যাঁচ নাই বইলে অইন্যেরটাও বুইঝতে পার না। তুমি একটু ভাইবে দেখ ত—হেই বেডি তোমার লগে দুঃখ দেওয়া কুনু কথা কইছে কি না?

অ্যাঁ হ্যাঁ। একবার তাঁর কথায় দুঃখ পাইছিলাম—বিয়ার দুই মাসের মইধ্যে কইলেন—ফাল্গুনীরে নাইয়র আইনতে যাইতে পারুম না। নিয়া যাইবেন আর আইন্যা দিবেন। বেয়াইনের হেই কথায় দুঃখ ত পাইছিলামই। তই হেই কথার লগে ফাল্গুনীর সুখ-দুঃখের কথা আইতেছে ক্যান পিসি?

যে বেডি বিয়ার দুই মাসের মইধ্যে বেয়াইয়ের লগে এমুন ভাষায় কথা কইতে পারে, হে পুতের বউয়ের লগে কী বেবহার কইরব বুইঝে লও। ওই দজ্জাল বেডির যন্ত্রণায় টিকতে না পাইরা বড় পোলা বউ লইয়া গেরাম ছাড়ছে।

গেরাম ছাড়ছে! তিনি ত কইলেন—চাকরির অসুবিধা হইতেছে বইলে বউ নিয়া শহরে থাকে বড় পোলা।

তাইলে তোমার জামাই অরবিন্দ বউ লইয়া শহরে থাকে না ক্যান? বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসি বলল, সব মিথ্যা। ডাঁহা মিথ্যা দিয়া তোমারে বুঝ দিছে। অরবিন্দ ত...। বলে আচমকা থেমে গেল সুশীলা পিসি।

অরবিন্দ ত কী পিসি! বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করে সুধাংশু।

মাইয়ার কাছে যাও। হেরে জিগাও। ব্যথাতুর কণ্ঠে সুশীলা পিসি বলে।

পিসি, আমার হাত-পা ঠান্ডা হইয়া আইসতেছে। হাঁডি যাওনর শক্তি নাই বইল্লা মনে হইতেছে। তুমি কও পিসি। তুমি কইয়া আমার দড়ফড়ানিটা থামাও পিসি।

উতলা হইয়ো না সুধাংশু। যা হওনর হইয়া গেছে। এরপর করুণ গলায় সুশীলা পিসি বলে, শিকলভাঙার জেলেপাড়াটা উত্তর দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ হইলে কী হইবে, পাড়াটা তেমন বড় না। এখানকার সকলে সকলের কথা জানে সুধাংশু।

অরবিন্দর কী কথা পিসি! বড় একটা ঢোঁক গিলে সুধাংশু বলে।

সুধাংশু, সোজাসাফটাই কই তোমারে। আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কইরে লাভ নাই। আমি তোমার বাপের দিকের আত্মীয়। তোমার স্বার্থ আমার কাছে বড়। তোমার জামাই অরবিন্দ স্বভাব-চরিত্রে ভালা না সুধাংশু।

ভালা না মাইনে! অরবিন্দ ত সোনার টুকরা। আমার মাইয়া ফাল্গুনীরে কত আদর-যত্ন করে!

এবার কট কট করে হেসে দিল পিসি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ভালা—না? ভালা পোলারা জুয়া খেলে? মদ গিলে? বউয়ের গায়ে হাত তোলে?

হঠাৎ কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল সুধাংশু। সুশীলা পিসি তাড়াতাড়ি উঠে ধরে না ফেললে দাওয়া থেকে গড়িয়ে উঠানে পড়ে যেত সুধাংশু।

ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো। আমার কথা বিশ্বাসে লইও না সুধাংশু। মেয়ের বাড়িতে যাও। হেরে সুধাও। তখন গোমর ফাঁক হইয়ে যাবে তোমার কাছে। বলতে বলতে দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসাল সুধাংশুকে। নিজে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এল। সুধাংশুর সামনে এগিয়ে ধরে বলল, ধর সুধাংশু, জলটা খেইয়ে লও। মাথা ঠান্ডা করো।

সুধাংশুর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সুশীলা পিসির দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

তুমি আবার মনে কইরো না যে, আমি তোমার জামাইর বদনামি করতেছি। ওরা আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু তোমরা আমার মিত্র। তোমার মাইয়াডারে আমি অতি অল্পবয়স থেইকে দেইখে আসছি। শুনছি ফাল্গুনী বড় সুশীলা মাইয়া। এইরকম একটা ভালা মাইয়ারে একখান বদমাশের হাতে গছাইয়া দিলা! শেষের দিকে বেদনায় সুশীলা পিসির কণ্ঠস্বর বুজে এল। নিজেকে সংযত করে আবার বলল, মেইয়ে নাইয়র নিতে আইছো বুঝি? এইখানে মাথা গরম কইরো না। মাথা গরম কইরে কুনু ফায়দা পাবে না। শুধু দুঃখ বাইড়বে। ফাল্গুনীরে লইয়া যাও উত্তর পতেংগায়। বুকের কাছে গুঁইজা রাখ কিছুদিন।

এবার মুমূর্ষু গলায় সুধাংশু বলল, সকল কথা আমারে খুইলা বলো পিসি। আমার মইরে যেতে ইচ্ছা কইরতেছে। আমার কইলজার টুকরা ফাল্গুনী। এই ফাল্গুনীরে আমি কর্ণফুলীর জলে চুবাইয়া মারলাম! বলতে বলতে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল সুধাংশু।

সুশীলা পিসি দ্রুত সুধাংশুর পাশে এল। ডানহাত দিয়ে সুধাংশুর মুখটা চেপে ধরল। তারপর তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, কপালের লিখন সুধাংশু। তোমার মেইয়ের কপালে দুঃখ ত লেইখে দিয়েছিল বিধাতা। বিধাতার লিখন কি খ-ানো যায় ভাইপো?

এরপর ধীরে ধীরে আরও কিছু কথা বলে গেল সুশীলা পিসি।

এই পাড়ায় জুয়াড়িদের একটা দল আছে। চাকরি থেকে ফিরেই অরবিন্দ জুয়ার আড্ডায় বসে যায়। ছুটিছাটার দিনে রাতে-দিনে বিরামহীন জুয়া খেলে যায় অরবিন্দ। বাপ-মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই অরবিন্দের ওপর। মাঝে মাঝে মদ গিলে বাড়ি ফিরে সে। ফাল্গুনীর সঙ্গে ঝগড়া করে। তার গায়ে হাত তোলে। ফাল্গুনীর কান্নার আওয়াজ এই পাড়ার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ওই সময় ভজহরির বউটি ছেলের পক্ষ নেয়। ফাল্গুনীকে তুই-তোকারি করতে দ্বিধা করে না।

কই কুনুদিন ত ফাল্গুনী আমারে কিছু কয় নাই! মরাগলায় সুধাংশু বলে।

সুশীলা পিসি বলে, হয়তো তোমার উপর বা তোমার সমস্ত পরিবারের উপর হের বড় অভিমান আছে। হয়তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হেরে তোমরা এই ঘরে বিয়া দিছ। হয়তো সে প্রতিশোধ লইতেছে তোমার উপর। নিজে তিল তিল কইরে মইরে যাবে, তবুও নিজের বেদনার কথা কইবে না তোমারে—এইটাই বোধহয় পণ কইরেছে ফাল্গুনী।

তুমি ঠিকই কইছরে পিসি। বিয়া সে তখন কইরতে চায় নাই। আমার পোলা শিবু, শিবুর মা অহল্যাও এই বিয়াতে মত দেয় নাই। আমিই পিসি, আমিই অনেকটা জোর কইরে ফাল্গুনীরে বিয়া দিছি। ও ভগমান রে, এখন আমি কী করমুরে ভগমান?

সেই বিকেলে মৃতপ্রায় শরীরটা নিয়ে সুশীলা পিসির দাওয়া থেকে বেয়াইবাড়িতে ফিরে এসেছিল সুধাংশু। চোখ খুলে কারও দিকে তাকাতে পারছিল না সে। কোনোমতে রাতটা কাবার করে দিয়ে ভোর সকালে কন্যা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল।

কর্ণফুলীর পশ্চিমপারে সুধাংশুর বাড়ি। নদী পার হয়ে বাস, বাস থেকে নেমে রিকশা। তারপর উত্তর পতেংগার জেলেপাড়াটি। মেয়েকে দিতে বা নিতে আসার সময় আস্ত একটা সাম্পানই ভাড়া করে সুধাংশু। সেখানে অন্য কোনো যাত্রী থাকে না। সেই সকালেও ওরা দুজন ছাড়া সাম্পানে আর কোনো যাত্রী ছিল না। মাঝি আপনমনে দাঁড় বেয়ে যাচ্ছে—ক্যাঁ ফোরৎ, ক্যাঁ ফোরৎ।

সুধাংশু হঠাৎ ফাল্গুনীর হাত দুটো নিজের দিকে টেনে নিয়ে উজাড় গলায় কেঁদে উঠল। মাঝি একপলক সুধাংশু আর ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে সাম্পান বেয়ে যেতে লাগল। তখন আকুলিত গলায় সুধাংশু বলে যাচ্ছিল—আমারে মাফ কইরে দেরে ফাল্গুনী। আমারে মাফ কইরে দে।

ফাল্গুনী তার শান্ত ডাগর চোখ দুটো দিয়ে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। গতরাতেই সে টের পেয়েছিল—বাপের কিছু-একটা হয়েছে। পাড়াবেড়ানো থেকে সুধাংশু ফিরল যখন, ফাল্গুনী রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। বেয়াইনের পাশেই একটা জলচৌকিতে বসে ছিল সুধাংশু। ভজহরি বাজারের দিকে গিয়েছিল। অরবিন্দ চাকরি থেকে ফিরে জুয়ার আড্ডায় চলে গিয়েছে। এতদিন জানত—চাকরি থেকে ফিরে জামাই নদীপারে একটু গা জুড়াতে যায়। সেখানে দু-চারজন বন্ধুবান্ধব এসে জুটে। গালগল্প শেষে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এটা তো স্বাভাবিক। সারা দিন কাজের চাপে মনটা বেচাইন হয়ে যায়। মনের চাপ দূর করার জন্য বন্ধুসঙ্গ তো দরকার আছে। এতে অরবিন্দের কোনো দোষ নেই। এতদিন এটাই ভেবে এসেছে সুধাংশু। কিন্তু আজ পিসির কথা শোনার পর তার সকল বিশ্বাস টলে গেছে।

বাপ আর শাশুড়িকে জলখাবার দিতে এসে চমকে উঠেছিল ফাল্গুনী। একী! বাপের এরকম চেহারা কেন! যেন একজন মৃতমানুষ জলচৌকির ওপর বসে আছে! বাবার চোখ দুটো এরকম করে বসে গেছে কেন! বাবা, চা খাও। বলার পরও কন্যার দিকে চোখ তুলল না সুধাংশু। আগের মতো মিষ্টি একটু হেসে বলল না—খাইতেছি মা। মেয়ের কথা শুনেও যেমনভাবে বসে ছিল, তেমন করে বসে থাকল সুধাংশু। ফাল্গুনী বুদ্ধিমতী। শাশুড়ির সামনে কথা বাড়াল না আর। সে অনুমান করল—বিকালে বেড়াতে বের হয়ে নিশ্চয় কারও কাছে কিছু শুনেছে। সুশীলা দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয় নি তো বাপের! এই পরিবারের সবকিছু তো দিদিমণির জানা। এতদিন বাপের কাছ থেকে যে ব্যথাতুর ঘটনাগুলো লুকিয়ে রেখেছিল সে, তা দিদিমণি বাপকে বলে দেয় নি তো! গভীর একটা শঙ্কা ফাল্গুনীকে গ্রাস করল।

রাতে সুধাংশু কোনোরকমে দু-চার গরাস মুখে দিল। বেয়াই ভজহরির সাধাসাধির জবাবে সুধাংশু বলল, শরীরটা হঠাৎ কইরে কাহিল লাইগছে দাদা। খেইতে ইচ্ছা করছে না। তারপর বেয়াইনের দিকে তাকিয়ে বলল, কাইল ভোরে ভোরেই রওনা দিতে চাই দিদি।

কাইল দুপুরে দুটো খেইয়ে রওনা দিলে হইত না? অচলা বলেছিল।

না দিদি। সকাল সকাল যাইতে চাই। আইজ দুই দিন হইল সইত্যর হাতে সঁপে দিয়া আইছি নাও-জাল। কী কইরতেছে বুইঝতে পাইরতেছি না।

ঠিক আছে, যা ভালা বুঝেন। কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল অচলা।

জোয়ারের মুখে মুখে বা ভাটা শুরু হওয়ার আগে আগে কর্ণফুলীর জল থমথমে হয়ে যায়। কোনোরূপ স্রোত থাকে না নদীতে। এক জায়গায় নদীজল স্থির হয়ে থাকে। বহুদূর হাঁটতে হাঁটতে পথিক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পথিপার্শ্বে ছায়াময় বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে শ্রান্ত পথিক তখন একটু জিরিয়ে নেয়। নদীজলও বহু পথ, বহু গঞ্জ-হাট, বহু আঁক-বাঁক পেরিয়ে পেরিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়ে। তখন শ্রান্তি দূর করার জন্য তার একটু বিশ্রামের দরকার। ওই জোয়ার বা ভাটা শুরুর সময়টাতে শ্রমক্লান্ত নদীজল যেন একটু জিরিয়ে নেয়।

ওই সময়টাতে মাঝিদের খুব পরিশ্রম করতে হয় না। দাঁড়ের দু-একটা টানে সাম্পান বেশ কিছুদূর এগিয়ে যায়। বর্তমান সময়টা নদীজলের জিরানোর সময়। তাই সুধাংশুদের মাঝিটি অলসভাবে দাঁড় ফেলে যাচ্ছে। সাম্পানটিও এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। সুধাংশুর কান্নার শব্দ শুনে মাঝিটি ভাববার একটু অবকাশ পেল। সে ভাবতে শুরু করল—আহা, মেয়েটি অভাগা নয় তো? তার মেয়ে মরিয়মের মতো স্বামী-নির্যাতিতা নয়তো? বোঝা যাচ্ছে, কেঁদে যাচ্ছে যে লোকটি, সে মেয়েটির বাপ। বাপটি মেয়ের কাছে মাফ চাইছে কেন? মস্তবড় কোনো অপরাধ করে নি তো বাপটি? মেয়েটি এরকম নির্বাক হয়ে বাপের দিকে তাকিয়ে আছে কেন? পৃথিবীতে কত রহস্য। কত সমাধানহীন সমস্যা! সবকিছুর তো আর উত্তর জানা যায় না। এইসব ভাবতে ভাবতে মাঝিটি মাঝনদী বরাবর দাঁড় বেয়ে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল ফাল্গুনী, বাবা, আমি বুঝতে পেরেছি—তুমি এমন কিছু শুনেছ, যা তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হয়তো সুশীলা দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার, কাল বিকালে।

হ মা, হ। কাল বৈকালে সুশীলা পিসির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইছে মা। আমিই তোরে অগ্নিকুণ্ডে ছুইড়া মারছিরে মা।

যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে আর তো কোনো লাভ নেই বাবা।

আমি ভুল কইরে ফেলছি রে মা।

এই জীবন থেকে ফেরার কোনো পথ নেই বাবা। অনেক বুঝিয়েছি তারে। কেঁদে-কেটে, অভিমান করে। অনাহারে থেকে তাকে ফিরবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও ফেরার নয়। জুয়া আর মদের নেশা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে বাবা। মা-বাবার কোনো খবরদারি নেই, বরং মায়ের প্রশ্রয়ে ও আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিষণ্ণ গলায় বলে গেল ফাল্গুনী।

তোর আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই রে মা।

কী বলছ তুমি বাবা! আমার ভাইদের সম্মান, সমাজে তোমার মানমর্যাদা সব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, যদি আমি শ্বশুরবাড়িতে না ফিরি। সমাজের মানুষ টিটকারি মারবে। আমার দাদা, আমার দাদা মরে যাবে যে বাবা আমার একথা শুনলে। বলতে বলতে খপ করে বাপের হাত দুটো চেপে ধরল ফাল্গুনী। মিনতির স্বরে বলল, তুমি আমাকে কথা দাও বাবা, এই কথা তুমি আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, কোনোভাবেই মা-ভাইদের কানে যাবে না। আমার দুঃখের কথা শুনলে মা আত্মঘাতী হবে রে বাবা।

মেয়ের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল সুধাংশু। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, তাই হবে মা, তাই হবে। তারপর নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে সুধাংশু বলে যেতে লাগল, আমারে মাফ কইরে দেরে মা, মাফ কইরে দে।

আমাকে তোমরা যা শাস্তি দিতে চাও দেও, আমি মাথা পাইতে নেব। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সুধাংশু।

কিছুক্ষণ পর মৃদুকণ্ঠে সুধাংশু আবার বলল, সেই সকালে নদীর মাঝখানে ফাল্গুনী আমারে পণ করাই নিছিল—আমি যাতে নির্যাতনের কথাগুলো তোমাগোরে না কই। মাসের পর মাস গেছে বছরের পর বছর গেছে। শ্বশুরবাড়িতে আমাগোর ফাল্গুনী তিলে তিলে মইরেছে। যখনই নাইয়র আইনতে গেছি তার মরা চেহারা দেখে আমি শরমে মইরে গেছি। শরমে মইরে গেছিরে ভগমান!

হঠাৎ অহল্যা বিলাপ ধরে কেঁদে উঠল—ঈশ্বররে, আমার ফাল্গুনীর একী হইল রে ঈশ্বর!

সূর্যমোহন আর সত্যব্রতের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল।

চোখ বুজে আছে শিবশঙ্কর। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা নামছে।

ফাল্গুনী স্থির। উন্মীলিত চোখ তার। দূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

অকস্মাৎ সীতানাথ গর্জে ওঠে, খানকির পোলারে খুন করুম আমি। সীতানাথের বাহ্যজ্ঞান অনেকটা লুপ্ত হয়ে গেছে। সামনে যে দাদারা বসে আছে, মা-বাবা আছে, ভুলে গেছে সে। এরপর কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু ছোট-বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যেতে লাগল সেই ঘরটির মধ্যে। এ যেন অমাবস্যার রাতের কোনো এক শ্মশানভূমি।

দুদিন পর ফাল্গুনী ফিরে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে। তার যে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই, তার যে স্বামীঘর ছাড়া বসবাসের কোনো স্থান নেই—এরকমই বলেছিল অহল্যা। বলেছিল, বিবাহিত মাইয়াদের শ্বশুরবাড়ি ছাড়া স্থান নেই। মা-বাপ মইরে যাবে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। আশ্রিতা বোনের দায় নেবে না কুনু ভাই। ফাল্গুনীর ভাইগ্যে এই ছিল যদি, সব মাইন্যা লইয়া ওর শ্বশুরবাড়িতে ফির‌্যা যাওন উচিত।

সবাই মিলে আগপর ভেবেছিল অনেক। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল—ফাল্গুনী এবার ফিরে যাবে। ভবিষ্যতে চিন্তাভাবনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

অলংকরণ : উত্তম সেন
‘বেলাশেষের অবশেষ’ উপন্যাসের অংশবিশেষ। অন্যদিন ঈদসংখ্যা ২০১৮-এ প্রকাশিত।

Leave a Reply

Your identity will not be published.