১৯ নভেম্বর প্রথিতযশা প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীর ৭১তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে এই ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি ফিচার পুনঃপ্রকাশ করা হলো অন্যদিন-এর পাঠকদের জন্য।
বাংলা সংগীতভুবনে যে ক’জন শিল্পীর নাম সবার আগে উচ্চারণযোগ্য, সুবীর নন্দী তাদের অন্যতম। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে এ দেশের সুরপিয়াসী মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের অনেক গান বাংলার ঘরে ঘরে, প্রতিটি জনপদে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। স্বকীয় গায়কি আর কথা ও সুরের অপূর্ব মেলবন্ধনে গাওয়া তাঁর বহু গান তৈরি করেছে জনপ্রিয়তার আলাদা বলয়। আধুনিক গানের শীর্ষে অধিষ্ঠানকারী এই গুণী শিল্পীর শুরুটা হয়েছিল নজরুলসংগীতের মাধ্যমে। পাশাপাশি ভজন, কীর্তন ও পল্লীগীতিতেও সমান পারঙ্গম। গুণী এই শিল্পীর জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
ছেলেবেলার দিনগুলি
হবিগঞ্জ জেলার একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ি চা-বাগানের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা পাহাড়ি রাস্তা। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এমনই এক সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে এক সম্ভ্রান্ত সংগীত পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুবীর নন্দীর। তাঁর পিতা ছিলেন তেলিয়াপাড়া চা এস্টেটের চিকিৎসক। ৯ ভাইবোনের সঙ্গে সেখানেই তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে। ছেলেবেলায় চা-বাগানের অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গ তাঁকে আকর্ষণ করত ভীষণ। সারাদিন ঘুরেফিরে, অন্যের গাছের ফল পেড়ে উদ্দামতায় কাটিয়ে দিতেন সারাবেলা। বিশেষ করে বর্ষাকালটা ছিল তাঁর ভীষণ ভালোলাগার এক ঋতু। বর্ষায় পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা ঝরনার জলে সব বন্ধু মিলে হুটোপুটি করে কাটিয়ে দিতেন সারা দিন। প্রকৃতির এই সান্নিধ্য ভূমিকা রেখেছে তাঁর মানস গঠনেও। তবে এত দুরন্তপনার মধ্যেও পড়ালেখায় ছিলেন ভীষণ মনোযোগী।
সংগীতের সঙ্গে যুক্ততা
পারিবারিক গণ্ডিতেই তিনি পেয়েছিলেন সংগীতচর্চার এক চমৎকার আবহ। তাঁর মা-ও চমৎকার গান করতেন। তবে সেটা পারিবারিক গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিদিন সান্ধ্য প্রার্থনায় গান গাওয়ার নিয়ম ছিল বাড়িতে। সেখানে মায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সব ভাইবোন গান গাইতেন। সবশেষে প্রতিদিনই গাইতেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথা নত করে দাও’ গানটি। সে সময়ের সব গানই যে খুব বুঝেশুনে গাইতেন তেমনটা নয় কিন্তু সংগীতের প্রতি ভালোবাসাটা তৈরি হয় তখন থেকেই। এভাবে মায়ের কাছেই মূলত হয় তাঁর সংগীতে হাতেখড়ি। পাশাপাশি তাঁর বাবাও ছিলেন ভীষণ সংগীত অনুরাগী। তাঁর সংগ্রহে বহু রেকর্ড ছিল। সে সুবাদেই সেই ছেলেবেলাতেই অভিজ্ঞতা হয় কানন দেবী, আঙ্গুরবালা, কে এল সায়গলসহ সেই সময়ের সব বিখ্যাত শিল্পীদের গান শোনার। এর পাশাপাশি গানের তালিম নেন ওস্তাদ বাবর আলী খাঁর কাছে।
প্রথম রেকর্ডিং
১৯৬৭ সালের দিকে রেডিও পাকিস্তান সাব ডিভিশনের সিলেটের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ড. আকবর আলী খাঁ। তিনি খুবই সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারলেন সিলেট বেতারে শিল্পী নির্বাচনের জন্য অডিশন নেয়া হবে। তিনিও নাম জমা দিলেন। সিলেকশনের তিনটি ধাপ অতিক্রম করে সুবীর এবং তাঁর বড়ভাইসহ মোট তিনজন নির্বাচিত হলেন। তখন সবেমাত্র তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৬৭ সালের ১৪ অক্টোবর নজরুলসংগীত ‘বউ কথা কও’ রেকর্ডের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রেডিওতে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে সময় ঢাকা বেতারে নিয়মিত প্রচার হতো গান শেখানোর অনুষ্ঠান। গান শেখাতেন আবদুল আহাদ। ওই অনুষ্ঠানের সুবাদেই তাঁর আয়ত্ত হয়েছিল বহু নজরুলসংগীত। সে সময় প্রথম গান গেয়ে প্রথম সম্মানী পেয়েছিলেন ৪২২ টাকা। সবমিলিয়েই এটা তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় মুহুর্ত। আর এর আগেই ১৯৬৪ সালে জগদীশপুর হাইস্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে অর্জন করেন মঞ্চে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা।
জীবনের এক অন্য অধ্যায়
যুবক বয়সে বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চলে গেলেন তিনি না-ফেরার দেশে। পুরো পরিবারেই নেমে এল এক বিরাট বিপর্যয়। একদিকে বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে শুরু হলো সত্যিকারের জীবনযুদ্ধ। এরই মধ্যে বেরিয়েছে তাঁর ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট। খুব ভালো ফল করেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জলাঞ্জলি দিলেন ঢাকায় পড়ার ইচ্ছাটাকে। গ্রামেই ভর্তি হলেন বি এ তে। পাশাপাশি করতে লাগলেন চাকরির দরখাস্ত। পেয়েও গেলেন তাঁর স্বপ্নের পেশা ব্যাংকিং। তবে এতকিছুর পরও তাঁর সংগীতসাধনায় ভাটা পড়ে নি এতটুকু। ব্যাংকে চাকরি শুরুর কিছুদিন পরে নতুন ম্যানেজার আসেন। তিনি সুবীরের কাজের প্রতি নিবিষ্টতা আর গানের জন্য তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি সুবীর নন্দীকে ডেকে বললেন, ‘আপনি তো অনেক ভালো গান করেন। কিন্তু সিলেট বেতারে গান গাইলে সিলেটের বাইরের কেউ তো আপনাকে চিনবে না। আপনি ঢাকায় চেষ্টা করছেন না কেন?’ সে সময় চাকরি ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর বদলিটাও সহজতর ছিল না মোটেও। বাস্তবতা তুলে ধরতেই ম্যানেজার বললেন, ‘আমি যদি তোমার বদলির ব্যবস্থা করি, তুমি যাবে ঢাকায়?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই।’
ঢাকায় শুরু হলো তাঁর অন্যরকম এক যুদ্ধ। এমন অনেক সময় গেছে শুধু একটা বিস্কিট খেয়েই সকালটা পার করে দিয়েছেন, একজনের খাবার দুজনে ভাগ করে খেয়েছেন। পয়সার অভাবে অনেকদিন অফিসে হেঁটেই যাতায়াত করেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাঁর সংগীতচর্চা চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবেই।
যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়...
তিনি যখন সিলেট থাকতেন তখন থেকেই নিয়মিতই আসা-যাওয়া ছিল ঢাকা বেতারে। প্রায়ই সেখানে তাঁর এলাকার পরিচিত বড়ভাই মুজাক্কের আহমেদের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন যদি কোনোদিন সুযোগ মিলে যায় ঢাকা বেতারে গাওয়ার। এমনি করে বসে থাকতে থাকতেই সৌভাগ্যক্রমে তিনি নজরে পড়ে যান ওস্তাদ মীর কাসেমের। তিনি মোজাক্কের আহমেদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে ছেলেটাকে প্রায়ই দেখি এখানে এসে বসে থাকে। চাকরি-বাকরির দরকার নাকি?’ তিনি তখন বললেন, ‘ও আমার এলাকার ছেলে। ওরা দুই ভাই খুব ভালো গান গায়।’
এ কথা শুনে মীর কাসেম তাঁকে বললেন, ‘আমি একটা গান করব। কোনো গান আছে?’ মুজাক্কের সাহেব তখন বললেন, ‘আমার কাছে একটা গান আছে।’ তখন সুবীর নন্দীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি যদি সুর করি তুমি সেটা তুলে গাইতে পারবে?’ তিনি তখন খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘পারব।’ এর আগেই তিনি মানবেন্দ্র, সতীনাথের গাওয়া সিরিয়াস টাইপের সব গান গেয়ে অভ্যস্ত। এসব গান তোলাটা তাঁর জন্য খুব কঠিন কিছুই ছিল না। সেই মুহূর্তে চলছিল আঞ্জুমান আরার রেকর্ডিং।তিনি গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্পেশাল গ্রুপটা আছে নাকি?’ একটা রেকর্ডিং শেষ না হতেই আর একটা গানের রেকর্ডিং তাও আবার স্পেশাল গ্রুপের তলব। সবাই তো ধরেই নিয়েছে নিশ্চয়ই কোনো বড় শিল্পীর রেকর্ডিং। কিন্তু তাঁকে দেখে তো সবাই অবাক। কিছুটা তাচ্ছিল্যভরেই, কিছুটা করুণার দৃষ্টিতে তাকাল তাঁর দিকে সবাই। কিন্তু রেকর্ডিং হওয়ার পর সবাই অবাক। এত অল্প সময়ের মধ্যেই গানটা তুলে ফেললেন তিনি! ঢাকা বেতারে সেই তাঁর প্রথম গাওয়া। গানটি ছিল ‘যদি কেউ ধুপ জ্বেলে দেয়/অন্ধ মনের জীর্ণ কোঠায়।’
এরপর সুবীর নন্দীকে ফিরে তাকাতে হয় নি। তাঁর চলার পথ আরও মসৃণ হয়েছিল ট্রান্সমিশন সার্ভিসের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলামের নেয়া একটা উদ্যোগে। তিনি নতুন দেশে একঝাঁক নতুন শিল্পী তৈরির একটা উদ্যোগ নিলেন। অনেকটা অঘোষিত নিয়ম চালু করলেন আঞ্চলিক রেডিওর ভালো ভালো শিল্পীদের সুযোগ দেয়ার। ব্যবস্থা করলেন পুরনো-নতুন শিল্পীদের এক মেলবন্ধনের। এরই মাধ্যমে অনেকের সুযোগ ঘটে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর। এরই সুবাদে এ দেশের সংগীতাঙ্গনে আবির্ভাব ঘটে এন্ড্রু কিশোর, প্রবাল চৌধুরী, নার্গিস পারভীন, ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পীদের। সে যাই হোক, এই উদ্যোগের ফলে তাঁর সংগীতযাত্রার পথটা যেন অনেক বেশি মসৃণ হয়ে গেল। ১৯৭৫ সালে সত্য সাহার সুরে ও রফিকউজ্জামানের কথায় গাওয়া ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ গানটি দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন এক অন্য উচ্চতায়। এরপর একে একে গাইলেন ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘দিন যায়’সহ অজস্র কালজয়ী সব গান।
আধুনিক গানের এই কালজয়ী শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানেও। প্লেব্যাকের শুরু ১৯৭৪ সালে রাজা হোসেন খান ও সুজেয় শ্যামের সংগীত পরিচালনায় আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবির মাধ্যমে। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলমগীর কবির পরিচালিত ‘মহানায়ক’ ছবির সূত্রে। এরপর ‘শুভদা, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ‘মেঘের পর মেঘ’ ছবিতে গান গাওয়ার জন্য একই সম্মাননা অর্জন করেন। সেইসঙ্গে একাধিকবার পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কারও। অন্যদিকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে ১৯৮১ সালে বের হয় তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’।
সুবীর নন্দী কিডনি ও হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৯ সালের ৭ মে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন তিনি।
Leave a Reply
Your identity will not be published.