সুরের ওপারে চলে গেলেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর না-ফেরার দেশে চলে গেলেন উপমহাদেশের এই প্রবীণ কণ্ঠশিল্পী। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ১২ মিনিটে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
জানুয়ারির শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন লতা। তখন থেকেই ভর্তি ছিলেন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের আইসিইউতে। ৮ জানুয়ারি থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি।
প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন লতা। একসময় কোভিড নেগেটিভ হলেও পরে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো দেখে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ৫ ফেব্রুয়ারি লতা মঙ্গেশকরের অবস্থার আবার অবনতি হয়। এই সংবাদ শুনে সন্ধ্যাবেলা দিদি লতাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান আশা ভোসলে। তখন থেকে লতাকে নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্য, দেশ-বিদেশের অনুরাগী-ভক্ত সবাই তাঁর জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। চিকিৎসকেরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন লতাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
১৯২৯ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের ইন্দোরে জন্মেছিলেন লতা মঙ্গেশকার। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকার ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ও নাট্যদলের প্রধান, পরে ‘আন্ধেরি দুনিয়া’র নির্মাতা।
পিতার মৃত্যুর মাত্র আট দিন পর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লতা, ১৯৪২ সালে মারাঠি গান গেয়ে। তখন তাঁর বয়স তের বছর। তখন তিনি ‘পহেলি মঙ্গোলা গৌর’ নামে একটি ছবিতে কণ্ঠ দেন ও অভিনয় করেন। দ্বিতীয় ছবি ‘কিত্তি হাসাল’ থেকে তাঁর গাওয়া গানটি কেটে বাদ দেওয়া হয়। অথচ পরবর্তীকালে লতা মঙ্গেশকরই হয়ে ওঠেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী।
১৯৪৬ সালে লতা প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দার তাঁকে প্রথম বড় সুযোগ দেন।
‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিন মেরা তোরা’ গানটি হিট হলে লতার ভাগ্য খুলে যায়। সেই থেকে অসংখ্য ছবিতে তিনি গান করেন। সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ডের ইতিহাস আশা ভোসলের। তিনি গেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার গান। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে এ রেকর্ডটি ছোট বোন আশার হওয়ার আগে ছিল লতা মঙ্গেশকরের। লতা গেয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার গান। লতা মঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। এর মধ্যে আছে বাংলাও।
গত শতকের ষাট দশকের মাঝামাঝি লতা প্রথম বাংলা গান করেন। বাংলাতে লতার গান প্রথম শোনা গিয়েছিল ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ ছবিতে। অবশ্য এর আগে শান্তারামের হিন্দি ছবি ‘অমর ভূপালী’র বাংলা সংস্করণে লতা প্রথম গান গেয়েছিলেন। লতার গাওয়া মন মাতানো বাংলা গানের মধ্যে রয়েছে ‘একবার বিদায় দে মা’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘চঞ্চল ময়ূরী এ রাত’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ওই গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘হায় রে পোড়া বাঁশি’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আমি যে কে তোমার’, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বেলে’, ‘যদিও রজনী পোহালো’, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি’, ‘হায় হায় প্রাণ যায়’, ‘চলে যেতে যেতে’, ‘ওরে মন পাখি’, ‘হতাম যদি তোতা পাখি’, ‘আর যেন নেই কোনো ভাবনা’, ‘ও প্রজাপতি, প্রজাপতি’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নেপথ্যেও লতা গেয়েছেন। ‘রক্তাক্ত বাংলা’সহ কয়েকটি ছবিতে রয়েছে তাঁর গান। সংগীতে তাৎপর্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে লতা অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০০১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরত্ন অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে লাভ করেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও।
Leave a Reply
Your identity will not be published.