[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধÑসব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]
২১) কামিনী রায় (১৮৬৪-১০৩৩) : মানবতার কবি কামিনী রায়। তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা; ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক অনার্স। তিনি লিখেছেন :
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী দু’পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”
কীর্তনখোলা নদীর তীরে বাসন্ডা গ্রাম, চন্দ্রদ্বীপ, বরিশালে জন্ম তাঁর। ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবরে। তাঁর পিতার নাম চণ্ডীচরণ সেন এবং মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী; কামিনীর বোনের নাম যামিনী এবং ভারত উপমহাদেশে প্রথম নারী চিকিৎসকদের মধ্যে যামিনী অন্যতম। কামিনীর পিতা বৈচারিক পেশায় নিয়োজিত (মুন্সেফ) থাকলেও ব্রাহ্ম মতের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। তিনি খুব আধুনিকমনস্ক ছিলেন। সেই যুগে প্রকাশ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পত্র বিনিময়ের রীতি চালু ছিল না। কথিত আছে, কামিনীর পিতা একবার সরাসরি ডাকযোগে তার স্ত্রীর নামে খামে একখানা চিঠি পোস্ট করলে সে চিঠি পোস্টঅফিস, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সবার কাছে একটি বিব্রতকর ও লজ্জাকর আলোচনার বিষয় হয়ে পড়ে। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কামিনী রায়ের সঙ্গে কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়। কেদারনাথ কামিনী রায়ের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে নিজেই বিবাহের প্রস্তাব দেন। তাঁদের ৩টি সন্তান জন্মায়। প্রথম সন্তানটি জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই (১৯০০ সালের দিকে) মারা যায়, তার নাম জানা যায় নি; অপর দুই সন্তানের নাম ছিল লীলা রায় ও অশোকরঞ্জন রায়। ১৯০৩ সালে কামিনী রায়ের বোন কুসুম, ১৯০৬ সালে প্রথমে ভাই ও পরে বাবা মারা যায়। ১৯০৮ সালে তার স্বামী কেদারনাথ রায় ঘোড়ার গাড়ি উল্টে গিয়ে আঘাত পেয়ে মারা যান এবং এর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্তান লীলা ও অশোককেও হারান। এভাবে মাত্র ৭ বছরের মধ্যে প্রায় সকল আপনজনকে হারিয়ে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে ভেঙে পড়েন। এর এই শোকসন্তপ্ত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি আমরা তাঁর রচনায় খুঁজে পাই। কামিনী রায় ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেথুন ফিমেল স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিকের সমমান) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বেথুন কলেজ থেকে তিনি ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বেথুন কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। কামিনী রায় খুব অল্প বয়স থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন; মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লিখেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আলো ও ছায়া’ কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ; যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাঠক-সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে ‘নির্মাল্য’। এছাড়া শিশুসাহিত্য, সনেট, গান ও অনুবাদের বই প্রকাশিত হয়। স্বামী-সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের অকাল মৃত্যুর ফলে তাঁর সাহিত্যের মধ্যে একধরনের ব্যথাতুর ও নৈসর্গপ্রিয়তার ভাব লক্ষণীয়। তাঁর গভীর মানবতাবোধ, সঙ্গে রবীন্দ্র-প্রেম ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা তাঁর কবিতাকে শাণিত করেছে। যখন মেয়েদের শিক্ষা বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন সকল অসংগতির বিরুদ্ধে ও নারী জাগরণের পক্ষে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে; বিশেষত নারী কল্যাণে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তিনি জগদীশ চন্দ্রের স্ত্রী অবলা বসুর সঙ্গে নারী কল্যাণে অনেক কাজ করেন। কামিনী রায় ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট এবং তিনি সব সময়ই ছাত্রদের ভালোবাসতেন; উৎসাহ দিতেন। সহযোগিতা করতেন অন্য নারী সাহিত্যিকদের। তিনি ১৯২৩ এক সম্মেলনে বরিশাল এলে কবি বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁকে লেখালেখির বিষয়ে প্রবল উৎসাহ দেন এবং মনোনিবেশ করতে বলেন। তিনি ১৯২২-২৩ সালে নারী শ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নারী জাগরণে অসামান্য অবদান এবং তৎকালীন পশ্চাদপদ সমাজের মধ্যে থেকেও প্রথম স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়ের স্মরণে ১৯২৯ সাল থেকে ‘জগত্তারিনী পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। তিনি ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি ও ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শেষজীবনে কবি কামিনী রায় ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের হাজারীবাগে বসবাস করতেন এবং ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এখানেই তার জীবনাবসান ঘটে।
কামিনী রায়ের বিখ্যাত কবিতা :
পাছে লোকে কিছু বলে
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে-
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
২২) কুসুমকুমারী (১৮৭৬-১৯৪৮) : বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রথম নৃত্য পরিচালিকা। প্রথম নারী নৃত্য শিক্ষিকাও তিনিই। নৃত্য পরিচালিকা ও শিক্ষিকা ছাড়াও তিনি একজন নৃত্য-গীত পটিয়সী অভিনেত্রীও বটে। মিনার্ভা থিয়েটারে নাচ-গানে ভরপুর ‘আলিবাবা’ নামক নাটকে মর্জিনা চরিত্রে সার্থক অভিনয় ও নৃত্য-গীত পরিবেশন করে ইনি সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গিরিশচন্দ্র রচিত ‘অভিশাপ’ নাটকে ইতি নৃত্যও পরিচালনা করেন। গ্র্যান্ড, স্টার, কোহিনূর ইত্যাদি থিয়েটারেও তিনি অভিনয় ও নৃত্য পরিবেশন করেন।
২৩) কুসুমকুমারী দাশ (১৮৭৫-১৯৪৮) : বিশিষ্ট কবি ও গদ্য লেখক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের মা। কুসুমকুমারী বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রনাথ দাশ, মাতার নাম ধনমনি দাশ। চন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করায় গ্রামবাসীদের বিরোধিতা ও অসহযোগিতায় তাঁর পৈতৃক গ্রাম গৈলা ছেড়ে তিনি সপরিবারে বরিশাল শহরে চলে আসতে বাধ্য হন। কুসুমকুমারী বরিশালে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুলে যেতে শুরু করেন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ছাত্রীর অভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার পিতা প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে মেয়েকে পাঠিয়ে দেন লেখাপড়া করবার জন্যে। কুসুমকুমারী রামানন্দের গৃহে থেকে এক বছর বেথুন স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি ব্রাহ্ম বালিকা বোর্ডিং-এ লাবণ্যপভা বসুর তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। লাবণ্যপ্রভা বসু বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর কনিষ্ঠা সহোদরা। তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রবেশিকা শ্রেণিতে পড়াকালেই কুসুমকুমারীর বিয়ে হয়ে যায়। পাত্র সত্যানন্দ দাশ, ব্রজমোহন ইন্সটিটিউটের প্রধান শিক্ষক। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেন। কুসুমকুমারী ও সত্যানন্দের তিন সন্তান : দুই পুত্র এক কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ পুত্র বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ। আরেক পুত্র অশোকানন্দ দাশ এবং কন্যা সুচরিতা দাশ।
কুসুমকুমারী বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজের বিভিন্ন সভা, সমিতি, উৎসব, অনুষ্ঠানে খুবই সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। প্রতিবছর এক সপ্তাহ জুড়ে বরিশাল ছাত্রসংঘের যে মাঘোৎসব উদ্যাপিত হতো, তিনি সেখানে প্রায় দুই দশক ধরে মেয়েদের উপাসনার দিন আচার্যের ভূমিকা পালন করতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে শুধু নারীদের নয় সাধারণ সভাতেও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি বরিশালের মহিলা সভার সম্পাদক ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন কুসুমকুমারী। বিখ্যাত সম্পাদক ও প্রকাশক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য যে ছবি দিয়ে সাজানো বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যের অংশবিশেষ যোগ করেছিলেন। কুসুমকুমারী সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর অল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাসী’ ও ‘মুকুল’ পত্রিকায়। খোকার বিড়াল ছানা, দাদার চিঠি, বসন্তে, মায়ের প্রতি, বন্দনা, উদ্বোধন, সাধনপথে, অরূপের রূপ, মনুষ্যত্ব, আদর্শ ছেলে তার উল্লেখযোগ্য কবিতা। তিনি নিয়মিত দিনলিপিও লিখতেন। ‘আদর্শ ছেলে’ কোনো কোনো স্কুলের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্তির জন্যে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা। তাঁর অধিকাংশ লেখারই হদিশ মেলে নি। হয় হারিয়ে গেছে, নয়তো তিনি নিজেই সেসব নষ্ট করে ফেলেছেন। ঈশ্বরবন্দনা, নীতিবোধ ও দেশাত্মবোধ তাঁর কবিতার প্রধান উপাদান। কাব্য মুকুল (১৮৯৬) তাঁর কাব্যগ্রন্থ। গদ্যগ্রন্থ ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ও তিনি রচনা করেন। ‘নারীত্বের আদর্শ’-এর ওপরে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় কুসুমকুমারী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতা
আদর্শ ছেলে
মুকুল, পৌষ, ১৩০২
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন
“মানুষ হইতে হবে”—এই তার পণ,
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান,
নাই কি শরীরে তব রক্ত মাংস প্রাণ ?
হাত, পা সবারই আছে মিছে কেন ভয়,
চেতনা রয়েছে যার সে কি পড়ে রয় ?
সে ছেলে কে চায় বলো কথায়-কথায়,
আসে যার চোখে জল মাথা ঘুরে যায় ।
সাদা প্রাণে হাসি মুখে করো এই পণ—
“মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন”।
কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার
সবারি রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার,
হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি করো দান
তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ ।
২৪) কৈলাসবাসিনী দেবী (গুপ্ত) (১৯ শতক) : সুলেখিকা ও চিন্তাবিদ। মাত্র বারো বছর বয়সে প্রগতিশীল শিক্ষিত যুবক দুর্গাচরণ গুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তিনি যে শুধু লিখতে-পড়তে জানতেন না তা-ই নয়, মেয়েদের পড়াশোনা করাটাও ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু ব্রাহ্ম স্বামীর সংস্পর্শে এসে দ্রুত পড়াশোনা শিখে তৎকালীন মেয়েদের মধ্যে নজির স্থাপন করেন। নারী কল্যাণের জন্যে তাঁর প্রাজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গি তিনি বিভিন্ন লেখায় ব্যক্ত করেছেন। ১৮৬৩ সালে তাঁর ‘হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা’ এবং ১৮৬৫ সালে ‘হিন্দু মহিলাকুলের বিদ্যাভাস ও তাহার সমুন্নতি’ ও ‘গদ্যে গদ্যে রচিত বিশ্বশোভা’ উল্লেখযোগ্য। ‘হিন্দু মহিলার হীনাবস্থা’ বইতে তিনি কুলীন প্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, সংসার ও দাম্পত্য জীবনে নারীর শোচনীয় স্থান নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। এ ছাড়া বিধবাদের অমানবিক দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বিধবা-বিবাহের পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও তার যুক্তি ও বক্তব্য ছিল কঠোর। সমাজে নারীর দুরবস্থা, স্বামী-স্ত্রীর সংঘাত, অল্প বয়সে বৈধব্য, রুগ্ন সন্তানের জন্মদান, নারীদের সুস্বাস্থ্যের অভাব ইত্যাদি বহু জটিলতা ও সমস্যার জন্যে তিনি বাল্যবিবাহকে দায়ী করেছেন।
২৫) কৈলাসবাসিনী মিত্র (১৮২৯-১৮৯৫) : তাঁর রচিত আত্মকথাটি বাংলা সাহিত্যে এক বিরল সংযোজন। ‘গত যুগের জনৈকা গৃহববূর ডায়েরি’ শিরোনামে সেটি ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিকভাবে ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কৈলাসবাসিনী মিত্র রাজপুরের গোরাচাঁদ ঘোষের কন্যা ও বিখ্যাত দেশনায়ক, বাগ্মী, লেখক ও সমাজসংস্কারক কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী। কিশোরীচাঁদের বড়ভাই সুবিখ্যাত লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। কৈলাসবাসিনী প্রগতিশীল স্বামী ও উদারমনা স্বামীর পরিবারে এসে পড়ালেখা শেখার সুযোগ পান। তাঁর আত্মকথাটি অমূল্য ধনের মতো বাংলা সাহিত্য উজ্জ্বল করে বসে আছে।
২৬) কৃষ্ণকামিনী দাসী (১৯ শতক) : বঙ্গ নারী লিখিত সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্ত বিলাসিনী’ গ্রন্থটি ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়। বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কাব্যগ্রন্থটির প্রশংসাসহ বিশদ আলোচনা করেন। গদ্যে-পদ্যে লেখা এই বইতে কৌলিণ্য প্রথায় কুলীন মেয়েদের দুঃখ, সধবার প্রেম, বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের আনন্দ ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা তৎকালীন যুগের জন্য অত্যন্ত সাহসিকতা ও প্রগতিশীলতার পরিচায়ক। বিধবা বিবাহ আইন পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রচিত এই বই পড়ে লেখিকার জীবন সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও তাঁর সমাজ সচেতনতা ও নারী মুক্তির প্রতি সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সধবা, বিধবা, না কুমারী ছিলেন বলা মুশকিল। যে সময় এই বই লেখা হয় সে সময় প্রেম বা প্রণয়ের কথা নিয়ে কবিতা লেখা দূরে থাক তা প্রকাশ করাটাও নির্লজ্জ আচরণ বলে গণ্য হতো। শোকগাথা, ধর্মগাথা, ভক্তির কাহিনিই যখন কবিতার বিষয়বস্তু ছিল তখনো প্রেম বা বিরহ ব্যাকুলতা নিয়ে কোনো সংকোচ কৃষ্ণকামিনী দাসীর লেখার মধ্যে দেখা যায় না। তিনি অনায়াসে অতি খোলামেলাভাবে নিদ্রোত্থিত বিরহিনীর বিলাপ, আমার প্রতি প্রাণেশ্বরের উক্তি, নববিবাহিতা কামিনী ইত্যাদি নিয়ে কবিতা লিখতে পারেন। এদিক দিয়ে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের যোগ্য শিষ্যা। শ্রী সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন, ‘সামাজিক রীতি অথবা সাময়িক ঘটনা বিষয়ক ছড়ায় ও কবিতায় তাঁর (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত) অনুসারীদের অন্যতম হলেন কৃষ্ণকামিনী দাসী। কৃষ্ণকামিনীর ‘নববিবাহিতা কামিনী’ কবিতায় স্বামীর সঙ্গে প্রথম রাত্রিবাসের পর যৌন মিলনের বিবিধ চিহ্ন শরীরের নানান স্থানে ধারণ করে সখিদের সম্মুখীন হওয়ার লজ্জা যেভাবে খোলামেলাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, তা তৎকালীন একজন মহিলার জন্য নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কৃষ্ণকামিনীর রসবোধ ও ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি পরিহাসও অসাধারণ। ভারতের রেলপথ প্রবর্তনে তাঁর প্রতিক্রিয়ার পরিচয় মেলে ‘যমের ক্রন্দন’ কবিতায়। এদেশের রেলগাড়ি প্রবর্তিত হওয়ায় যমরাজ খুব চিন্তিত। কেননা যত পাপী-তাপী সারাজীবন দুষ্কর্ম করেছে মরার আগে ট্রেনে চেপে হুস করে তারা কাশীধামে চলে যাবে। আর সেখানে মৃত্যু হলে স্বর্গচ্যুত করার ক্ষমতা যমরাজের নেই। তাঁর সাহসী লেখা নারী জাগরণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
২৭) কৃষ্ণভাবিনী দাস (১৮৬৪-১৯১৯) : বাংলার নারী-মুক্তি আন্দোলনে এক দুঃসাহসী নারী। প্রতিবাদী এই নারী মেয়েদের সমঅধিকার অর্জনের দাবি নিয়ে প্রচলিত সমাজভাবনার প্রতিবাদ করেছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর উন্মুক্ত বিতর্ক স্মরণীয়। তাঁর আরও একটি প্রসিদ্ধ প্রতিবাদী প্রবন্ধ ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষ’। স্বামী দেবেন্দ্রনাথ দাস বিলাত যাওয়ার অপরাধে ত্যাজ্যপুত্র হলে দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় কৃষ্ণভামিনী নিজেই স্বামীর সঙ্গ নেন। কন্যাকে দেশে রেখে যান তিনি। ইংল্যান্ডে ‘বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে গ্রন্থ রচনা করেন। স্ত্রী-স্বাধীনতার স্বপক্ষে বক্তব্য রাখার কারণে বইটি নিষিদ্ধ হয়। ১৪ বছর পর দেশে ফিরে কন্যার অপাত্রে বিয়ে হওয়ায় মা হয়েও তাকে স্বামী পরিত্যাগের উপদেশ দেন। সরলা দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত স্ত্রী মণ্ডল’-এর বঙ্গীয় শাখার সম্পাদিকা ছিলেন। নারী আন্দোলনের নেত্রী, শিক্ষাব্রতী ও সমাজসেবী। তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি তিন হাজার গৃহবধূদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত কৃষ্ণভামিনীর দুটি লেখা ‘শিক্ষিতা নারী’ (আশ্বিন ১২৯৮) এবং ‘অশিক্ষিতা ও দরিদ্রা নারী’ সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধনা’র সাময়িক সাহিত্য সমালোচনায় কৃষ্ণভাবিনীর প্রবন্ধকে আক্রমণ করেন। ‘শিক্ষিতা নারী’র সমালোচনার প্রতিবাদ করেন কৃষ্ণভাবিনী। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘নারীর আদর কালক্রমে আপনি বাড়িবে, সেজন্য নারীদিগকে কোমর বাঁধিতে হইবে না, বরঞ্চ আরো অধিক সুন্দর হইতে হইবে।’
২৮) খায়রুন্নেসা খাতুন (১৮৭৪-১৯১০) : খায়রুন্নেসা খাতুনের একমাত্র বই ‘সতীর পতিভক্তি’ সম্পর্কে দেবীপ্রসন্ন রায় চৌধুরী সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘নব্যভারত’-এ মন্তব্য করা হয়, ‘মুসলিম সমাজের মহিলা এমন সুন্দর প্রবন্ধ লিখতে পারেন এমন ধারণা ছিল না পূর্বে’। ২০০৮ সালে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ বের হয়। তাঁর স্বামীই প্রকাশক। এর পর আরও তিন-তিনটি সংস্করণ হয় এই গ্রন্থের। খায়রুন্নেসা খাতুন ১৮৯৫ সালে হোসেনপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এর প্রধান শিক্ষিকা নির্বাচিত হন। তাঁর স্বামীর ছিল বদলির চাকরি। কিন্তু খায়রুনন্নেসা খাতুন বিদ্যালয়ের জন্য বেশির ভাগ সময় সিরাজগঞ্জেই থাকতেন। অজপাড়াগাঁয়ে কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে একটা বিদ্যালয় টিকিয়ে রাখতে তাঁকে সেসময় অবর্ণনীয় শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এমনও শোনা গেছে, স্কুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টিচাল জোগাড় করতেন খায়রুন্নেসা। তাঁর স্বামীর বেতনের একটা মোটা অংশ চলে যেত স্কুলের খরচ জোগাতে। হয়তো স্কুলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে গিয়ে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। যে কারণে খুব অল্প বয়সেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাঁকে। স্বনামে বেনামে ‘নবনূর’ পত্রিকায় বেশকিছু লেখা প্রকাশ হয় তার।
২৯) গওহরজান (১৮৭০-১৯৩০) : গওহরজান একজন বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। মা বিখাত বাইজি মালকাজান। সত্যেন সেনের লেখায় মালকাজান সম্বন্ধে জানা যায়। গওহরজানের মা মালকাজান মুজরো করতে ঢাকা আসতেন। সে সময় তিনজন মালকাজান ছিলেন। আগ্রাওয়ালী মালকাজান, বেনারসের চুলবুলিয়া মালকাজান ও ভাগলপুরী মালকাজান। উপমহাদেশের বিখ্যাত বাইজি গওহরজান ছিলেন বেনারসের চুলবুলিয়া বা বড় মালকাজানের কন্যা। গওহরজানের পিতা রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড ছিলেন ইহুদি। মা রুক্মিণী ছিলেন ভারতীয়। বিবাহের পর রুক্মিণীর নাম হয়েছিল ভিক্টোরিয়া। এঁদের একমাত্র কন্যার নাম রাখা হয়েছিল অ্যাঞ্জেলিনা। অসামান্য রূপসী ভিক্টোরিয়া ও রবার্টের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। উভয়ের ভেতর ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর, ভিক্টোরিয়া খুরশিদ নামক একজন মুসলমান যুবকের সঙ্গে বারানসি শহরে আসেন। এখানেই মা ও মেয়ে উভয়েই ধর্মান্তরিত হন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ভিক্টোরিয়ার নাম হয় মালকাজান এবং অ্যাঞ্জেলিনার নাম হয় গওহরজান। এরপর মালকাজান বাইজি বৃত্তি গ্রহণ করে। আধুনিক নায়িকাদের মতো সেকালে মালকাজানের ছবি অধিকাংশ ঘরেই টানানো থাকত, এত ছিল তার রূপ। মালকাজানের কিছু রেকর্ড বের হয়ে ছিল। ওদিকে গওহরজান বড় হলে ভারতের বাইজি মহলে তিনি সম্রাজ্ঞীর আসনে আরোহণ করেছিলেন। একে ছিলেন অসামান্য সুন্দরী তায় গুণী শিল্পী। ১৯০২ সালে গ্রামোফোন রেকর্ডিং শুরু হলে প্রথমেই গওহরজানের বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া গানের রেকর্ড বের হয়। গওহরজান ছিলেন ভীষণ শৌখিন আর ফ্যাশন সচেতন। নিজেকে সবসময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। এ দেশে শিল্পীদের ফ্যাশন সচেতনতা গওহরজানের হাত ধরেই আসে। তার গানের রেকর্ড ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। তিনি কিছু গানও রচনা করেছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের গুরু ওস্তাদ জমিরউদ্দিন গওহরজানের শিষ্য ছিলেন। গওহরজানের মা মালকাজানের সৎবোন ছিল জদ্দন বাই। জদ্দনের মা ইসলাম গ্রহণ করে আর জীবিকার কারণে মেয়েকে বাই হিসেবে তৈরি করে। জদ্দন বাই বেশ কয়েকবার বিয়ে করেন। জদ্দনের শেষ স্বামী উত্তমচাঁদ মোহন জদ্দনের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে মুসলমান হন আর তাকে বিয়ে করেন। মোহন নিজের নাম রাখেন আবদুর রশীদ। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ বিয়েতে সাক্ষী হন। মোহনের সঙ্গে বিয়ের পরে জদ্দন বাইজি পেশা ছেড়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। রশীদ আর জদ্দানের ঘরে জন্ম নেন ভারতের চিত্রজগতের কিংবদন্তিতুল্য অভিনেত্রী নার্গিস। তার মানে নার্গিস ও গওহরজান খালাতো বোন। গওহরজান অত্যন্ত বিত্তবান নারী ছিলেন। শোনা যায়, তিনি ২০টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির অন্যতম প্রথম শিল্পী গওহরজান ৬০০ মতো গানের রেকর্ড করেন। কেবল সংগীত, ফ্যাশন আর নানা ভাষায় পারদর্শিতাই নয়, তাঁর স্বদেশানুরাগও ছিল প্রখর। মহাত্মা গান্ধী যখন একবার জনহিতকর কাজের জন্যে তাঁর কাছে অর্থ চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ১২ হাজার টাকা দিয়ে দেন। ওই টাকায় তখন ১২০ তোলা সোনা কেনা যেত। তিনি তাঁর জীবনভর অর্জিত প্রায় সকল অর্থই দান করে গেছেন।
সারা জীবন একটি প্রাণের মানুষের খোঁজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তা তিনি পান নি। পরের দিকের ভালোবাসার মানুষটিকেও চিনলেন নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তার তথাকথিত প্রেমিক আব্বাস তাঁর ধনসম্পত্তি সব কেড়ে নেয় শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে। এজন্যে কলকাতা কোর্টে চলেছে একাধিক মামলা-মোকদ্দমাও।
‘ফার্স্ট ড্যান্সিং গার্ল’ নামে পরিচিত গওহরজান শুধু গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন স্বয়ং কবি ও গান লিখিয়েও। অনেকেই জানে না, বিখ্যাত ‘রসকে ভরে তোরে নয়ন’ ঠুমরিটি গওহরজানের লেখা। কোনো সভায় গেলে বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর শ্রোতাদের জন্য তাদের ভাষাতেই গান শোনাতেন গওহরজান। যেমন জলসায় বাঙালি শ্রোতা পেলে বাংলা ভাষাতেই গান শোনাতেন। মা মালকাজানও ছিলেন বড় কবি। তাঁর রচিত বাংলা গানও শোনাতেন গওহরজান জলসাতে। এক-দু’বার শ্রোতাদের শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানও। তা ছাড়া নিজের লেখা গানও আছে। সেরকমই একটি নিজের লেখা গান এল রেকর্ডে। লেবেলে আশ্চর্যভাবে লেখা হলো গানের প্রথম লাইনের বদলে গানের বিষয়। যা বলতে গেলে রেকর্ডের ইতিহাসে বিরল। গানের বিষয়টি হলো ‘পরকে দিয়া প্রাণ’। তার পর গান শুরু রেকর্ডে। ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল আর এল না’। নিজের ভালোবাসার ব্যর্থতাই যেন গভীরভাবে রূপক হিসেবে উপস্থাপিত হলো। নিজের আত্মজীবনকে গানে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া একজন সার্থক ও প্রাজ্ঞ কবির পক্ষেই সম্ভব। গানের শেষে প্রথাগতভাবে নিজের নাম বললেন। বললেন গানটি বাংলা ভাষায় এবং স্বরচিত বলে নিজের গভীর বেদনাবোধ মিশিয়ে দিতে পেরেছেন এখানে। বললেন, ‘ইট ইজ মাই সঙ’।
শেষ বয়সে আব্বাসের নিষ্ঠুর প্রতারণায় কষ্টার্জিত প্রচুর ধনসম্পদের সব হারিয়ে মাসিক মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে মহীশূরের রাজদরবারে গান গাওয়ার একটি চাকরি নিয়ে সে চলে যান এবং সেখানে কোনোমতে জীবনধারণ করতে থাকেন। ১৯৩০ সালে মহীশূরে তিনি মারা যান।
৩০) গোলাপসুন্দরী (১৯শ শতক) : আরেক নাম সুকুমারী দত্ত। মঞ্চাভিনেত্রী। বিশিষ্ট বেঙ্গল থিয়েটার ও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় করে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে সুকুমারীর চরিত্রে হৃদয়-ছোঁয়া ও অনবদ্য অভিনয় করার জন্যে জনসাধারণের কাছে তিনি ‘সুকুমারী’ নামেই ব্যাপক পরিচিতি পান। এরপর থেকে তিনি মঞ্চের পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকের অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু একটি কন্যা সন্তান জন্মের পরেই গোষ্ঠবিহারী দত্ত স্ত্রী ও কন্যাকে পেছনে ফেলে রেখে ইংল্যান্ড পালিয়ে যান নিজেকে ভালো করে বুঝে নেওয়ার জন্যে। গোলাপসুন্দরী ১৮৯০ সালে মারা যান। শেষ বয়সে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়াতেন তিনি। মঞ্চ-থিয়েটারের চরম দুর্দিনে যেসব অভিনেত্রী সেখানে এসে যোগ দিয়ে নাটকের মান ও নান্দনিকতাকে নতুন এক স্তরে উন্নত করেছিলেন, যাঁরা প্রথমবারের মতো নারী চরিত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুকুমারী দত্ত, বিনোদিনী, এলোকেশী, তারাসুন্দরী, তিনকড়ি প্রমুখ।
Leave a Reply
Your identity will not be published.