সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (নবম পর্ব)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (নবম পর্ব)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন নবম পর্ব।] 

খেলার জগৎ

একেকটা স্পট দর্শন শেষে আবার যখন গাড়িতে উঠছি, তখন পাল্টে যাচ্ছে সার্ব সিকিউরিটি অফিসারদের বসার সিটপ্ল্যান। আমার গাড়িতে সব সময় ক্রিভোকে পাচ্ছি না। অথচ তার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে। অনুভূতি আর ভালোবাসার টান- যাই বলি না কেন, কথা বলার লোক না পাওয়াটাই বড়ো বিষয়। টিমের বাকি অফিসাররা হাই-হ্যালোতেই সীমাবদ্ধ।

‘আচ্ছা, ভালোবাসার মানে কী? মন আঁকুপাঁকু মানে যে হৃদয়ের বাম অলিন্দে একটা টানের সৃষ্টি। এ থেকেই তো চিনচিনে ব্যথা। ব্যথার এই অনুভূতি কি সবার জন্য তৈরি হয়? অনেককেই তো ভালো লাগে, তবে ভালো লাগা আর ভালোবাসা কি এক? আরেক জনের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতেই-বা কতক্ষণ সময় লাগে? প্রথম দেখাতে যে প্রেমের সৃষ্টি হয় কারো মনে, সেই প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য কী?’

এবার আমার গাড়িতে ছিল গাইড দ্রেদারমিচ চোভানিচ। আমরা যাচ্ছি বেলগ্রেডের স্পোর্টস এলাকায়। দিলু ভাইকে মনে পড়ছে। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের স্পোর্টস এডিটর দিলু খন্দকার প্রাণখোলা উদার মানুষ, খেলার পাগল। স্পেনে বার্সেলোনার সামনে গিয়ে একবার ছবি দিয়েছিলাম।

তিনি দেখে খুশি হয়ে মন্তব্য করলেন, ‘কতজনের কতদিনের তপস্যা বার্সেলোনা। তুমি এত সহজে সেখানে পৌঁছে গেলে!’

সার্বিয়ার এই স্পোর্টস সিটির আগে নাম ছিল কোম্ব্যাংক; এখন স্টার্ক এরিনা। সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, প্রদর্শনী, বিনোদন- সবকিছুরই দেখা মেলে একই সীমানায়। তবে জনপ্রিয় আর কোলাহলময় হয়ে উঠতেও এর সময় লেগেছে দেড় দশক। ১৯৯১ সালে শুরু, পরিণত অবস্থা লাভ করে ২০০৭ সালে। সভা-সেমিনার, প্রদর্শনীর জন্য এখানে কয়েকটি সেমিনার রুম, বড়ো মিলনায়তন, প্রদর্শনীকেন্দ্র, সিনেমা হল, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ভোজনরসিকেরা বেজার হবেন না, তাদের জন্য রয়েছে রেস্টুরেন্টও।

১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক বাস্কেটবল ফেডারেশন সেই সময়ের যুগোস্লাভকে নির্বাচিত করে, ১৯৯৪ সালের বিশ্ব বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট আয়োজক হিসেবে। তবে অবকাঠামোগত দুর্বলতায় এর কাজ শেষ হয় না। ১৯৯৯ সালের আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টের জন্যও বেলগ্রেডকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কী, সেই বছর ন্যাটোর বোম্বিংয়ের জন্য তাও আর সম্ভব হয় নি। সুখের দেখা মেলে ২০০০ সালে, দেশটিতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর। ২০০৫ সালে ইউরোপিয়ান বাস্কেটবল আয়োজন করতে সমর্থ হয় বেলগ্রেড।

‘খেলাধুলার তথ্য পাব কীভাবে?’ গাইড দ্রেদারমিচ চোভানিচকে জিজ্ঞাসা করি।

‘কী ধরনের তথ্য লাগবে? আমি খেলাধুলা সম্পর্কে জানি না। কখনোই কোনো খেলাই খেলিনি। টিভিতেও খেলা দেখি না। ভালো লাগে না।’ চোভানিচের উত্তর।

‘সমস্যা নেই। জটিল কোনো বিষয়ের তথ্য নয়। তোমাদের কী কী খেলা জনপ্রিয়, বিখ্যাত খেলোয়াড় কে- এইসব বিষয় হলেই চলে।’

‘ওকে। আমি দেখছি তোমার জন্য কী করা যায়।’

খেলাধুলার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত নাম সার্বিয়া। তাদের খেলাধুলার ইতিহাসও অনেক পুরোনো। ফুটবল, বাস্কেটবল, টেনিস, ভলিবল, ওয়াটার পোলো এবং হ্যান্ডবল- এগুলো নিয়েই সার্ব তারুণ্যের বেশি মাতামাতি।

গাড়ি থেকে নেমে আমরা তখন হাঁটছি। মন কেড়ে নেয় স্টেডিয়ামের বাইরে খোলা চত্বর, সবুজের কার্পেটে মোড়ানো। চোভানিচ ততক্ষণে কেউ একজনকে জোগাড় করে ফেলেছে। কফির কাপ হাতে পরিচয় হয় ক্রীড়া সাংবাদিক মিলাচ তেনভিচের সঙ্গে। গাইডও পরিচয় করিয়ে দেয়। ছোটোখাটো চেহারা যেমন, বয়সও হালকা। বড়োজোর ২৩/২৪ হবে। ফুটবল তার প্রিয় খেলা। তিন বছর আগে খেলতে গিয়ে কোমরে আঘাত পায়। পরে আর খেলতে পারে নি। এরপর ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নেমে পড়ে। কাজ করছে সার্বিয়ার ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া সাপ্তাহিক ‘টেম্পো’তে। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া টেম্পো প্রকাশিত হয় সার্বিয়ান ভাষাতেই। আমার আগ্রহ দেখে ব্যাগ থেকে একটি সংখ্যা বের করে দিল। প্রযুক্তির সাহায্যে সার্বিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করি। ভালোই কাজে দেয়।

‘ফুটবল তোমাদের জাতীয় খেলা?’

মিলাচ তেনভিচের কাছে জানতে চাই। তার ধ্যানজ্ঞানজুড়েই রয়েছে ফুটবল, যা নিয়েই তার অগাধ পাণ্ডিত্য। তার ভাষায়, ‘ফুটবল সে দেশে এতটাই জনপ্রিয় যে, তাদের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত খেলোয়াড়ের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। বিশ্বসেরা ফুটবল রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি সার্বিয়া। শেষ পাঁচটি ফিফা বিশ্বকাপের চারটিতে খেলেছে সার্বিয়া। বিশ্ব আসরে এখন পর্যন্ত তেমন বড়ো কোনো অর্জন অবশ্য তাদের নেই।’

সার্বিয়ার দুটি প্রধান ফুটবল ক্লাব হলো রেড স্টার এবং পার্টিজান। আমাদের দেশের আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের মতো তাদের এ ক্লাব দুটির মধ্যেও জনপ্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালু আছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানে ‘ইটার্নাল ডার্বি’ নামে পরিচিত।

(চলবে...)

Leave a Reply

Your identity will not be published.