৭২-এ ববিতা

৭২-এ ববিতা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার জন্মদিন ৩০ জুলাই। ৭২-এ পা রেখেছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার বিশেষে এই দিনে গুলশানে নিজের বাসাতেই ছিলেন তিনি। আত্মীয়-পরিজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় সময় কাটিয়েছেন ববিতা। ১৯৫৩ সালে বাগেরহাট জেলায় তার জন্মগ্রহণ। 

ববিতা চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের হাত ধরে, ১৯৬৮ সালে। ‘সংসার’ নামের সেই ছবিতে তিনি সুচন্দা-রাজ্জাকের কন্যার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তখন তার নাম ছিল সুবর্ণা। নায়িকা হিসেবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘শেষ পর্যন্ত’ (১৯৬৯)। আর তখন থেকেই তিনি দর্শকদের কাছে ‘ববিতা’ হিসেবে হাজির হন এবং পরবর্তীতে ‘স্বরলিপি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘পীচ ঢালা পথ’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সূত্রে প্রতিষ্ঠা পান। 

১৯৭০ সালে ববিতা ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিতে অভিনয় করেন। আন্তর্জাতিক মানের এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান এবং এটি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত হচ্ছিল। পরে বাংলাসহ আরও পাঁচটি ভাষায় এটি ডাব করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ায় ছবিটি অসমাপ্ত অবস্থায়ই থেকে যায়। 

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ববিতা অভিনয় করছেন। তিন শতাধিক ছবিতে নানা চরিত্রকে তিনি সেলুলয়েডে মূর্ত করে তুলেছেন। ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা রমণী, ‘আলোর মিছিল’-এর মা-বাপ হারা চঞ্চল মেয়ে—যার মুখে হাসি, ভেতরে কান্না, ‘বাঁদী থেকে বেগম’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র, ‘ডুমুরের ফুল’-এর নার্স রোকেয়া, ‘বসুন্ধরা’র ছবি, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র গোলাপী, ‘নয়নমনি’র মনি, ‘সুন্দরী’র প্রতিবাদী চরিত্র, ‘অনন্ত প্রেম’-এর প্রেমিকা হিসেবে তিনি সমুজ্জ্বল।

ববিতা অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে—লাঠিয়াল, এক মুঠো ভাত, আকাক্সক্ষা, মা, ফকির মজনু শাহ, সূর্যগ্রহণ, এখনই সময়, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি, বড় বাড়ির মেয়ে, পেনশন, দহন, রামের সুমতি, চ-ীদাস ও রজকিনী ইত্যাদি। এছাড়া মা ও ভাবির চরিত্রেও তিনি কয়েকটি ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন। 

গত শতকের সত্তর দশকে এ দেশের শিল্পসম্মত জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্রের শিল্পী হিসেবে ববিতা এক ও অদ্বিতীয়। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে রুচিশীল, সামাজিক ছবি মানেই ববিতা—এমন অবস্থা বিরাজমান ছিল। কাজ করেছেন আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, নারায়ণ ঘোষ মিতা, খান আতাউর রহমান, কাজী জহিরসহ সুস্থ ধারার নান্দনিক চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে। এক সময় তিনি বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন এবং সফল হন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দিগন্তে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ববিতা— এ কথা অনস্বীকার্য। অভিনয়, গ্ল্যামার, স্ক্রিন পার্সোনালিটি, নৃত্য কুশলতা—সবকিছুতেই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এমনকি সোশ্যাল অ্যাকশান ছবিতেও তিনি সুনাম পেয়েছেন। নায়িকা হিসেবে তিনি যে অন্যদের চেয়ে আলাদা এটি সুস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। অভিনয় দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পর পর তিন বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। সরকারি-বেসরকারিসহ বিদেশি পুরস্কারে ধন্য এই অভিনয়শিল্পীকে এক সময় ‘পুরস্কার কন্যা’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী—যিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন।

কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম পা রাখেন ভারতের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমে, তাঁর ছবি ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩)-এ অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে। চলচ্চিত্র সমালোচক, চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ম্যাগাজিনে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়; তাঁকে নিয়ে লেখালেখি হয়। তিনি বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।

‘অশনি সংকেত’ মুক্তির পর শিল্প মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের প্রতি ববিতার গভীর ভালোবাসা জন্মায়। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে তিনি বিনা পারিশ্রমিকেও কাজ করেন। এমনকি আর্থিক সাহায্যও করেছেন কোনো কোনো চলচ্চিত্রকারকে। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.