অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ ফররুখ আহমদকে নিয়ে রচনা-
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুরে গিয়েছিলাম আগেই। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই ঘুরে এলাম মাগুরা জেলার শ্রীপুরের মাঝআইল গ্রাম থেকে। ইচ্ছাটা অবশ্য সেই স্কুলবেলায়। কবি-পরিচিতি পড়ে প্রথম যেদিন জেনেছিলাম তথ্যটি। তবে এতদিনেও কেন যেন যাওয়া হয় নি। ইচ্ছাটি পূরণ হলো অবশেষে। দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়লাম মাঝআইলের উদ্দেশে। সঙ্গী শুধু ছোটবোন সমাপনী। যাত্রা শুরু মাগুরা সদর থেকে। অটোরিকশায় চেপে রওনা দিলাম ওয়াপদা মোড়ের দিকে। আধাঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে। ঢাকা থেকে গেলে অবশ্য মাগুরা সদরের আগেই পড়বে ওয়াপদা। সেখানে নেমে কবির বাড়িটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না মোটেও। বসতবাড়িটির অবস্থান মোড় থেকে একটু ভেতরের দিকে হলেও সবারই চেনা। ভ্যানে চড়ে রওনা দিলাম কবির বাড়ির দিকে। মহাসড়ক ধরে সামান্য এগোতেই চোখে পড়ল কবি ফররুখ আহমদ সড়কের দিকচিহ্নিত ফলকটি। ভ্যান দিক পরিবর্তন করে ডানদিকের ইটের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। চালকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জেনে নিলাম কবি পরিবারের তেমন কেউ থাকেন না এখানে। ছেলেমেয়ে সবাই ঢাকাতে থাকেন। ফররুখ আহমেদের ছোট দুই ভাই বাস করেন এখানে। ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মারুফ আহমেদই মূলত বড়ভাইয়ের স্মৃতিরক্ষার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। কথার মাঝেই হঠাৎ নজরে পড়ল সবুজ ধানক্ষেত্রের সীমানা ছাড়িয়ে ফুটে থাকা একগুচ্ছ কাশফুলের দিকে। শরতের ঝকঝকে রোদেলা আবহাওয়াতেও মনে পড়ে গেল ‘বৃষ্টির ছড়া’। এমনিতরো কোনো এক কাশফোটা শরতেই হয়তো ঝুপ করে নেমে এসেছিল ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতেই হয়তো কলম থেকে বেরিয়ে এসেছিল একের পর এক লাইন। ‘বৃষ্টি এলো কাশবনে/জাগলো সাড়া ঘাসবনে/বকের সারি কোথায়রে/ লুকিয়ে গেল বাঁশবনে/ নদীতে নাই খেয়া যে/ ডাকলো দূরে দেয়া যে/ কোন সে বনের আড়ালে/ ফুটলো আবার কেয়া যে।’
ভাবনা খুব বেশি স্থায়িত্ব পেল না। চালক জানালেন কাছাকাছি চলে এসেছি। মূল রাস্তা ছেড়ে সরু একটা রাস্তা ধরে সামান্য এগোতেই চোখে পড়ল কবি ফররুখ আহমেদ স্মৃতিফলক। সেখানেই নেমে পড়লাম। বড়ভাইয়ের স্মৃতিরক্ষার্থে সৈয়দ মারুফ আহমদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে সৌধটি। সৌধটির বুকে খোদাই ফররুখ আহমদের বিখ্যাত কবিতা ‘পাঞ্জেরী’র পঙ্ক্তিমালা।
ছবি তোলা শেষ করে এগিয়ে গেলাম মূল বসতবাড়ির দিকে। একটুখানি এগোতেই পৌঁছে গেলাম কাঙিক্ষত গন্তব্যে। দেখা পেলাম মারুফ আহমেদের স্ত্রী নূরজাহান বেগম, পুত্রবধূ আর নাতনি ইমনার। উদ্দেশ্য জানাতেই নাতনি ইমনাকে সঙ্গে নিয়ে নূরজাহান বেগম সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। বয়সের ভারে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তবু পুরোটা সময়জুড়ে থাকলেন আমাদের সঙ্গে। বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা কবির পাওয়া কয়েকটি পুরস্কার, দেয়ালে টাঙানো কবির বাঁধাই করা ছবি, রেডিওতে কাজ করার সময় তোলা ছবি সব দেখালেন। এরপর নিয়ে গেলেন যে ঘরে কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে। পুরো বাড়িটিই সংস্কার করা হলেও এই ঘরটিতে হাত দেওয়া হয় নি। এই ঘরেই ১৯১৮ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর দাদি তাঁকে আদর করে ডাকতেন রমজান নামে। ফররুখ আহমেদের বাবার নাম সৈয়দ হাতেম আলী আর মা রওশন আখতার। শৈশবেই মাতৃহারা কবি ফররুখ আহমদ দাদির কাছেই লালিত-পালিত হন। অতি আদরের এই নাতিকে ছেলেবেলাতেই শোনাতেন পুঁথির কাহিনি, তাজকিরাতুল আউলিয়া, কাসাসুল আম্বিয়া। এ সমস্তই তাঁকে কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রাণিত করেছে।
নূরজাহান বেগম আর ইমনার আহ্বানে কবির জন্মঘর থেকে এগিয়ে গেলাম একটা সিঁড়ির দিকে। এই সিঁড়িতে বসেই বেশির ভাগ সময় কবি লেখালেখি করতেন। তখন এখানে একটা ঘরও ছিল। ঘরটি এখন আর নেই। সিঁড়িটি দাঁড়িয়ে আছে তার সাক্ষী হয়ে। পাশেই কবির স্মৃতিবিজড়িত বহুবর্ষী একটি গাবগাছ। কখনো-সখনো এই গাবগাছের নিচে বসে কবি লেখালেখি করতেন।
এসব দেখাতে দেখাতেই ইমনা শোনাচ্ছিল কবির শৈশবের গল্প। দাদা-দাদির কাছে শুনতে শুনতে সব তার মুখস্থ।
ছেলেবেলা থেকেই কবি ফররুখ আহমদ পড়ালেখায় ছিলেন ভীষণ মনোযোগী। লেখালেখির প্রতি আগ্রহটাও তৈরি হয়েছিল সেই ছেলেবেলাতেই। মাঝে মাঝে দুরন্তপনায় মেতে উঠলেও বেশির ভাগ সময় উদাসীনতা আর ভাবুকতা পেয়ে বসত তাকে। প্রতিটি ঋতু বৈচিত্র্য, প্রকৃতির উচ্ছলতা খুব গভীরভাবে অনুভব করতেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন লেখাতেই সেটা স্পষ্টতরো হয়ে ওঠে। ফাল্পুনে কবিতায় লক্ষ করি-
‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী
ভোমরাটা গায় গান ঘুমভাঙানি,
একঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে
গান গায় একসাথে ভোর-বিহানে,
আযানের সুর মেশে নীল আকাশে
শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে,
আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে
আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে,
লাল নয়, কালো নয়, সবুজ ছাতা
জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা,
হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি
প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি।’
পঙ্ক্তিগুলিতে ঋতুরাজ বসন্তের এক অপরূপ ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। এমনিভাবেই বৃষ্টির ছড়া কিংবা শরতের সকাল, পউষের কথা, হৈমন্তীর সুর প্রভৃতি কবিতায় বিভিন্ন ঋতুর অপরূপ রূপ-লাবণ্য ভিন্ন ব্যঞ্জনায় চিত্রিত হয়ে উঠেছে। শিশুদের প্রতিও ছিল ফররুখ আহমদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ লিখেছেন শিশুতোষ গ্রন্থ পাখির বাসা, হরফের ছড়া, চাঁদের আসর, ছড়ার আসর ও ফুলের জলসা।
নিজগ্রামে কবির খুব বেশি দিন থাকা হয় নি। পড়ালেখার জন্য বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কলকাতায়। ফররুখ আহমদের পিতার মূল নিবাসও কলকাতায়। পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী চাকরির সূত্রেই পরবর্তী সময়ে মাঝআইলে আবাস গড়ে তোলেন। মাঝআইলের পাঠশালায় ফররুখ আহমদ অল্প কিছুদিন পড়েছিলেন। আর ফারসি জানা একজন মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে দিতেন ধর্মীয় শিক্ষা। স্কুলজীবন তাঁর কেটেছে কলকাতায় মডেল এম ই স্কুল, বালিগঞ্জ হাইস্কুল আর খুলনা জেলা স্কুলে। এসব স্কুলে বিভিন্ন সময়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন কবি গোলাম মোস্তফা, সাহিত্যিক আবুল ফজল, কবি আবুল হাশেমের মতো গুণী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। সর্বশেষ খুলনা জেলা স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। আর এই স্কুলের ম্যাগাজিনেই প্রথমবারের মতো তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। মেট্রিক পাস করার পর তিনি রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে পাস করেন আইএ। এরপর প্রথম স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং পরে কলকাতা সেন্টপল কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। তবে শেষপর্যন্ত বিএ পরীক্ষাটা তাঁর দেওয়া না হলেও শিক্ষক হিসেবে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণুদে, প্রমথনাথ বিশী’র মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকের সান্নিধ্য তাঁকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে। স্কুল-কলেজে বিভিন্ন সময়ে সহপাঠী হিসেবেও পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, ফতেহ লোহানী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে চাকরির সুবাদেই শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। আর এর এক বছর আগেই ১৯৪২ সালে খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন লিলির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নিজের বিয়ে উপলক্ষে রচনা করেছিলেন ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা। কবিতাটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে প্রিজন অফিস ছাড়াও ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। এর মাঝে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে একমাত্র পত্রিকার কাজটি ছাড়া কোনোটিই কবিমনের সঙ্গে খাপ খায় নি বলে কোনোটিতেই খুব বেশি দিন স্থায়ী হন নি। আর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। অনিয়মিত ‘রাইটার’ শিল্পী হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বেতারে। পরবর্তী সময়ে এখানেই স্থায়ী হন। বেতারের প্রয়োজনে তিনি দেশাত্মবোধক, আধুনিক, হামদ-নাত প্রভৃতি গানের পাশাপাশি কথিকা, নাটিকা, গীতিনাট্য, গীতিনকশা প্রভৃতিও রচনা করেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে পরিচালনা করেন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘কিশোর মজলিশ’। এসব রচনার পাশাপাশি তাঁর কাব্যচর্চাও চলতে থাকে সমানতালেই। তিনি ইসলামী রেঁনেসার কবি, ইসলামের পুনর্জাগরণের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করলেও তাঁর সমগ্র সৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে তাঁকে এই একটি অভিধায় একপেশে করে রাখার সুযোগ নেই। বরং তাঁকে বলা চলে একজন প্রকৃত মানবতার কবি। তাঁর কবিতায় বাক্যের গাঁথুনি, আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ নৈপূণ্য, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অভিনবত্ব, শব্দ চয়ন, উপমার ব্যবহার তাঁকে এতটাই বিশিষ্টতা দান করেছে যে তাঁর মতো কবিকে খণ্ডিত করার কোনো সুযোগ নেই। বরং তাঁকে বলা যায় প্রকৃত মানবতার কবি।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কবিতার পঙ্ক্তিমালা:
হে জড় সভ্যতা!
মৃত সভ্যতার দাস স্ফীত মেদ শোষকসমাজ
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময় তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও
ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও।’
কিংবা ‘জনতার সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ্বে উঠি অতি অনায়াসে/ তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে।’ অথবা পোড়ামাটি কাব্যের ‘মানুষের হাড় দিয়ে করেছো এ নগর পত্তন/ মরুভূমি হলো বন, মরুভূমি মানুষের মন’ চরণগুলিতে কোনো বিশেষ শ্রেণীপ্রীতি নয় বরং সকল নিপীড়িত মানুষের হয়ে সমগ্র শোষকশ্রেণীর প্রতি তীব্র ঘৃণা, ধিক্কার প্রকাশ পেয়েছে। তার সমগ্র জীবনে এ রকম বহু কাব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে এমন মানবিক চেতনা।
সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), / সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), / মুহূর্তের কবিতা (১৯৫৩), /পাখির বাসা (১৯৬৫), / হাতেমতায়ী (১৯৬৬), / নতুন লেখা (১৯৬৯), / হরফের ছড়া (১৯৭০), / ছড়ার আসর (১৯৭০), হাবেদা মরুর কাহিনী, তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ। এগুলো ছাড়াও তিনি বেশকিছু গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, প্রেসিডেন্ট পদক, আদমজী পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার ও মরণোত্তর একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন।
দুপুরের রোদ মরে গিয়ে নেমে আসে বিষণ্ন বিকেল। এবার আমাদের ফেরার পালা। এদিকে নূরজাহান বেগম আমাদেরকে নিজে হাতে চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে এই কষ্টটুকু দিতে মন সায় দিল না কিছুতেই। তাঁর সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হয়ে আবারও আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম সবার কাছ থেকে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.