বলিউডের প্রথিতযশা অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক মনোজ কুমার (১৯৩৭-২০২৫) গত ৪ এপ্রিল না-ফেরার দেশে যাত্রা করেন। সেই সময় মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি লিভার সিরোসিসের রোগী ছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি রেখে গেছেন অক্ষয় কীর্তি। প্রথিতযশা এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ এই বিশেষ রচনাটি প্রকাশিত হলো।
মনোজ কুমারের আসল নাম হরিকিষণ গিরি গোস্বামী। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি ‘মনোজ কুমার’ নামটি গ্রহণ করেছিলেন, প্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমার অভিনীত একটি চলচ্চিত্রের চরিত্রের নামে। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৪ জুলাই বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার আবোতাবাদে। ১০ বছর বয়সে দেশবিভাগের কারণে তিনি সপরিবার ভারতে চলে আসেন।
মনোজ কুমারকে বলা হতো ‘ভারত কুমার’। কেননা তাঁর কয়েকটি অভিনীত এবং পরিচালিত চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে দেশ আর দেশপ্রেম।
আবোতাবাদে ছোট্ট মনোজ কুমার তথা হরিকিষণ গিরি গোস্বামী দিলীপ কুমারকে প্রথম অভিনয় করতে দেখে ‘জুগনু’ ছবিতে। তখন থেকেই ছোট্ট মনোজের মনে জন্ম নেয় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন। বেশ কিছু বছর পর, মনোজ যখন যুবক, এবং দিল্লীতে যৌথ বড় পরিবারের সঙ্গে থাকেন, তখন একদিন তাঁর এক ভাই লেখরাজ মখরি, যিনি নিজেও একজন ফিল্ম মেকার, তিনি পরামর্শ দেন, ছবিতে একবার তাঁর ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখার। মনোজ দিল্লি ছেড়ে মুম্বাইয়ে আসেন ১৯৫৫ সালে। এবং এক বছর পর একটা ছবিতে ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। নাম ‘গঙ্গু তেলি’। পরিচালক হোমি সেটনা, প্রথম ছবিতে মনোজের কাজ দেখে এত খুশি হয়েছিলেন যে, নির্ধারিত পারিশ্রমিকের থেকে এক হাজার টাকা তাঁকে বেশি দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাঁর সেই ভাইয়ের ছবি ‘ফ্যাশন’-এ মনোজ এক পথ চলতি ভিখারির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর।
১৯৬১ সালে। ছবির নাম ছিল ‘কাঁচ কি গুড়িয়া।’ টিনসেল টাউনে এইচ এস রাওয়ালি, মনোজকুমারকে মুখ্য ভূমিকায় প্রথম ব্রেক দেন। এই নবাগত শিশুটিকে নিয়ে আলোচনা ছিল উচ্ছ্বসিত। তাঁর অভিষেক ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই মনোজ কুমার চার-পাঁচটা ছবিতে সই করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। যার মধ্যে একটা ছিল বিজয় ভার্যের ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’। এবং এই ছবিই জন্ম দিয়েছিলেন তারকা মনোজ কুমারের। তারপর আসে ‘ও কৌন থি’ এবং ‘হিমালয় কি গোদ মে’। সাফল্য আর থেমে থাকে নি। একজন বড় অভিনেতার থেকেও তিনি একজন ছবি নির্মাণমনস্ক মানুষ ছিলেন।
এমনকি তিনি পুরোপুরি পরিচালনায় আসার আগে মনোজ কুমারের স্বপ্নের প্রোজেক্ট ‘শহিদ’, যেখানে তাঁর আইডল দিলীপ কুমার ভগত সিং-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এবং মনোজ কুমার চেয়েছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর চরিত্রে অভিনয় করতে। পর্দার পিছনে মনোজ কুমার এভাবেই একজন পরিচালক হয়ে উঠলেন। অভিনেতা ও প্রযোজকের দাবি। তিনি তাঁর অভিনীত বেশ কিছু হিট ছবির গেস্ট ডিরেক্টর হিসাবে ছিলেন। যেমন ‘গুমনাম’, ‘নীল কমল’, ‘পাথর কে সনম’, ‘পেহেচান’, ‘সন্ন্যাসী’, ‘বে-ইমান’ এবং ‘দশ নাম্বারী’।
সরকারিভাবে পরিচালনায় আসার পর মনোজ কুমারের প্রথম ছবি ‘উপকার’ যা আজও সকলের স্মৃতির সরণীতে উজ্জ্বল। এবং এই ছবিতে তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম ছিল প্রশংসনীয়। মনোজ কুমারের ছবি মানেই তার ভেতর দেশপ্রেম অন্তর্নিহিত থাকবে। তাঁর পরিচালনায় সব ছবি, যেমন ‘উপকার’, ‘পূরব অউর পশ্চিম’, ‘শোর’, ‘রোটি কাপড়া অউর মাকান’ এবং ‘ক্রান্তি’ প্রতিটা ছবিতেই একটা জোরালো দেশপ্রেমের চিত্র ফুটে উঠেছিল। মনোজ কুমার নিঃসন্দেহে একজন বড় অভিনেতার থেকেও বড় পরিচালক ছিলেন। অভিনেতা হিসাবে তাঁর বাচনভঙ্গি বা ধীর শব্দ ক্ষেপণ ছিল দিলীপ কুমার দ্বারা অনুপ্রাণিত। মনোজ কুমার, দিলীপ কুমারের হিরোইন কামিনী কৌশলকে দিয়ে মায়ের অভিনয় করিয়েছিলেন ‘উপকার’ ও ‘পূরব অউর পশ্চিম’ ছবিতে। এই সুপার সেলেবেল স্টার একদা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পরিচালনায় ‘জয় হিন্দ’ ছবিটি অবশ্য বক্স অফিসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
অভিনেতা-লেখক-পরিচালক মনোজ কুমার জীবনের শেষ পর্যায়ে বর্তমান কাজের পদ্ধতির থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল ফিরে আসার। শুটিংয়ের জন্য দুটো বিষয়ও তৈরি ছিল তাঁর। মনোজ কুমারের ছেলে কুণালও একজন অভিনেতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেন নি।
লেজেন্ড মনোজ কুমারের কর্মজীবন মধ্য পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যার মধ্যে তাঁর ঐতিহাসিক হিট ‘দো বদন’, ‘ও কৌন থি’ এবং ‘হিমালয় কী গোদ মে’। পঁচাত্তরের শেষ দিকে লিডিং ম্যান হিসাবে তাঁকে পাওয়া গেছে ‘সন্ন্যাসী’ এবং ‘দশ নাম্বারী’ ছবিতে। যার দুটোই ছিল সুপারহিট। মনোজ কুমারের ছবি পরিচালনা করার চেতনা কখনো মরে যায় নি। একটা সময় যাঁরা তাঁর ব্র্যান্ড নিয়ে হাসাহাসি করত, পরবর্তীকালে ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদেরই মনোজ কুমারের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র অভিনয়
* কাঁচ কি গুড়িয়া (১৯৬১)
* হরিয়ালি অউর রাস্তা (১৯৬২)
* ও কৌন থি (১৯৬৪)
* শহীদ (১৯৬৫)
* গুমনাম (১৯৬৫)
* নীল কমল (১৯৬৮)
* আদমি (১৯৬৮)
* সজন (১৯৬৯)
* বেঈমান (১৯৭২)
* সন্ন্যাসী (১৯৭৫)
* দশ নাম্বারি (১৯৭৬)
পরিচালনা
* উপকার (১৯৬৭)
* পুরব অউর পশ্চিম (১৯৭০)
* রোটি কাপড়া অউর মাকান (১৯৭৪)
* ক্রান্তি (১৯৮১)
* জয় হিন্দ (১৯৯৯)
পুরস্কার
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (উপকার, ১৯৬৮)
* দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (২০১৬)
* জাতীয় কিশোর কুমার পুরস্কার (মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত, ২০০৮)
* জাতীয় রাজকাপুর পুরস্কার (মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক প্রদত্ত, ২০১০)
ফিল্মফেয়ার পুরস্কার
১৯৬৮ : শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র (উপকার)
১৯৬৮ : শ্রেষ্ঠ পরিচালক (উপকার)
১৯৬৮ : শ্রেষ্ঠ কাহিনি (উপকার)
১৯৬৮ : শ্রেষ্ঠ সংলাপ (উপকার)
১৯৭২ : শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (বেঈমান)
১৯৭৩ : শ্রেষ্ঠ চিত্রসম্পাদনা (শোর)
১৯৭৫ : শ্রেষ্ঠ পরিচালক (রোটি কাপড়া অউর মাকান)
১৯৯৯ : আজীবন সম্মাননা পুরস্কার
Leave a Reply
Your identity will not be published.