[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৮তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব
পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭
মার্শাল টিটোর জীবন্ত অবয়ব: ‘হাউজ অব ফ্লাওয়ারস’
বেলগ্রেড এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে শহরের পথ। রাস্তার ঠিক মাঝখানে আইল্যান্ডে স্ট্যান্ডে বিশাল ভাস্কর্য। ওটা ছিল জোসেপ টিটোর মূর্তি। এর পরে পুরো বেলগ্রেডের অলিতে-গলিতে, শপিংমলের সামনে, পার্কের মাঝখানে, নদীর তীরে- তুলনামূলক সব জায়গাতেই ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি।
সেই প্রথম দিন থেকে গত তিন দিন ধরেই দেখছি মার্শাল টিটোর ভাস্কর্য। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, শপিংমল, পার্ক, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার সামনে—আগে নাকি আরও ছিল। বেলগ্রেডে রয়েছে জোরান রাডোজিসিকের ভাস্কর্য, নোভিসাদে আছে প্রথম মেয়র শ্বেতজার মিলেটিকের। বিভিন্ন শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য দিয়ে ভরা সার্বিয়া। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরজুড়েই ভাস্কর্য। কোথাও না কোথাও মাথা উঁচু করে, আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে একেকটা স্মৃতিস্তম্ভ। থুতনির নিচে হাত দিয়ে ভাবনারত, বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে থাকা, আপন মনে বসে থেকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো ভাস্কর্যও চোখে পড়ল সার্বিয়ার বিভিন্ন শহরে।
স্বাধীনতার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা সময়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এসব ভাস্কর্য স্থাপনের সময় বিভিন্ন মহল থেকেই প্রতিবাদ করা হয়েছিল। এসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানান রাজনৈতিক মন্তব্যও প্রচলিত আছে। তবে ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ ‘ভাস্কর্য: যুক্তির শক্তি বা অহেতুক কৌতুক’ শীর্ষক লেখায় হাস্যরস দিয়ে জটিল বিষয় তুলে ধরেছেন। সেখান থেকে একটা কৌতুক তুলে ধরছি। ভাস্কর্য স্থাপন না করার ক্ষেত্রে যুক্তি তুলে ধরে আপত্তিকারীরা বলেছেন, ভাস্কর্য হলে সেটির ওপর পাখি বসবে। সেখানে পয়োনিষ্কাষণ করবে। ফলে যার ভাস্কর্য তার সম্মানহানি হবে। এই যুক্তি অনেকেই গুরুত্বের সঙ্গে নেন। হয়তো তারা মনে করেন পৃথিবীর কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ের ওপর কখনো পাখি বসে না।
এমন যুক্তি যারা গুরুত্ব দিয়ে দেখেন, তাদের জন্য সোভিয়েত কৌতুক রয়েছে।
দীর্ঘদিন লেনিন ও স্ট্যালিনের যুগল ভাস্কর্যকে অবহেলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশ্বরের দয়া হলো। তিনি ভাস্কর্যদ্বয়ে প্রাণ দিয়ে বললেন, ‘তোদের দেখে মায়া হলো, ১০ মিনিটের জন্য প্রাণ দিলাম, যা করিস কর।’
একটু ভয় অবশ্য ছিল, প্রাণ পেয়েই যদি এরা আবার কমিউনিজম এবং নাস্তিকতা ছড়ানো শুরু করে! তাহলে ঈশ্বরের নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি পড়বে।
কিন্তু একি! ১০ মিনিটের জন্য প্রাণ পেয়েই লেলিন-স্ট্যালিন দৌড়ে গেলেন ঝোপের আড়ালে। ফিরে আসার পর তাদের মুখে একরাশ তৃপ্তি। ফলে তারা আরও ১০ মিনিট বাড়তি সময় প্রাণ ফিরে পেলেন।
এবার আগের চেয়েও দ্রুত ঝোপের দিকে ছুটে গেলেন লেলিন-স্ট্যালিন। এবার কৌতূহলী হয়ে ঈশ্বরও এগিয়ে গেলেন ঝোপের দিকে। শুনলেন স্ট্যালিন লেলিনকে বলছেন, ‘নেতা এবার আপনি কবুতরটাকে ধরে রাখেন, আমি ওর ওপর টয়লেট করি। গত ১০০ বছর কী পরিমাণ যন্ত্রণা দিয়েছে!’
সব শুনে ঈশ্বরের মাথায় হাত।
স্ট্যালিনের শাসনকে অনেকেই সোভিয়েত আমলের সবচেয়ে আগ্রাসি সময় হিসেবে দেখে থাকেন। এই কৌতুকটি তাকে নিয়েই।
স্ট্যালিন মারা যাওয়ার পর তার এক বিশাল ভাস্কর্য বানানো হলো। নিচে লিখে দেওয়া হলো— ‘স্ট্যালিন মারা গেছেন, তবে তার কাজ বেঁচে থাকবে চিরকাল।’
এক মস্কোবাসীকে দেখা গেল ভাস্কর্যের পাশ দিয়ে গজগজ করতে করতে হেঁটে যেতে। তিনি বলছিলেন, ‘এর চেয়ে বরং স্ট্যালিন যদি চিরকাল বেঁচে থাকতেন, তার কাজগুলো মরে যেত তাহলে বেশি ভালো হতো না?’
সাধারণত কাউকে সম্মান করার জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ভাস্কর্যের মাধ্যমে কারও জাতীয় অবদান তুলে ধরা হয়। পর্যটন স্পটে ভাস্কর্য বানিয়ে অনেক দেশ দুহাতে ডলার, পাউন্ড, ইউরো কামাচ্ছে।
এই যে, ভারতের ‘একতা মূর্তি’ বা ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ ভাস্কর্যটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য। যেটি ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের অবয়বে নির্মিত হয়েছে। ৫৯৭ ফুট উঁচু ভাস্কর্যটি বানানো হয়েছে গুজরাটে। তবে ভাস্কর্যটির সমালোচনাও আছে। কেননা, এতে খরচ হয়েছে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ইউরো।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, উচ্চতায় এটি ভারতের ভাস্কর্যটির প্রায় অর্ধেক। তবে এর সুখ্যাতিকে কেউ ছাপিয়ে যেতে পারবে না। নিউইয়র্ক সিটির এই ভাস্কর্যটির উদ্বোধন হয় ১৮৮৬ সালে। এটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক।
ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। এই ভাস্কর্যের কাছে গেলে পর্যটকরা রিও ডি জানেইরোর অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পান। সুগারলোফ পর্বতের ওপর অবস্থিত ৩০ মিটার উঁচু ভাস্কর্যটি। এটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। ২০০৭ সালে এটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের তালিকাভুক্ত হয়েছিল। ১১৬ মিটার উচ্চতার ‘লেকুন সেকায়া’ বা ‘গোল্ডেন জায়ান্ট’ ভাস্কর্যটি আসলেই অন্যরকম। মিয়ানমারের এই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৮ সালে। বিশ্বের উচ্চতম বুদ্ধমূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি।
চীনের ‘সমুদ্রের দেবী’ বা ‘গডেস ইন দ্য সি’ গুয়ানিন অব নানসান মূর্তিটি আকারে বিশাল। ২০০৫ সালে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। চীনের পৌরাণিক কাহিনিতে গুয়ানিন করুণার দেবী হিসেবে পরিচিত। পূর্ব এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যটি ৭৮ মিটার উঁচু। বিশ্বে গুয়ানিন দেবীর সবচেয়ে উঁচু মূর্তি এটি। ভারতে প্যাটেলের ভাস্কর্য উন্মোচনের আগে চীনের স্প্রিং টেম্পল বুদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল। চীনের হেনান প্রদেশে ১২৮ মিটার দীর্ঘ বুদ্ধ একটি পদ্মফুলের সিংহাসনে দাঁড়িয়ে আছেন। ২০০৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।
২
গাড়ির গতি ছিল না তেমন একটা। তবুও যেভাবে ব্রেক কষে থামল, মৃদু একটা ঝাঁকি খেলাম। সিটবেল্ট বাঁধা ছিল বলে টের পেলাম কম। গাড়ি থামে মার্শাল টিটোর সমাধির প্রধান ফটকের সামনে। সমতল ভূমি থেকে একটু উঁচুতে, ছোটোখাটো টিলার মতো। মূল সমাধিতে ঢুকতে হলে হেঁটে উঠতে হয়। প্রধান ফটক থেকে সমাধি পর্যন্ত ইট-পাথর, কনক্রিটে নির্মিত টাইলসে মোড়ানো রাস্তা। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে নানা রঙের ভাস্কর্যের সৌন্দর্যতে। এই রাস্তার দুপাশে রয়েছে মার্শাল টিটোর বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য। টিটো যখন এখানে থাকতেন, তখন তিনি বেশকিছু অন্য ভাস্কর্যও সংগ্রহ করেন।
মূল বাড়ির সামনে এক গোলাকার ফোয়ারা পেরিয়ে কাচের ভারি স্বচ্ছ দরজা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি। কয়েক ধরনের ফুলের তোড়ায় আচ্ছাদিত টিটোর সমাধি। গাইড জানালেন, ‘বেশির ভাগ সময় ফুলে আচ্ছাদিত থাকে টিটো আর জোভাঙ্কা ব্রোজের সমাধি। বাড়ির ওপরে স্বচ্ছ কাচের ছাউনি, যা দিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ আসে।’
বিশাল খোলামেলা কক্ষ। কক্ষের এক পাশের দেয়ালে দুটি বিশাল টিভি টাঙানো। টিভিতে টিটোর সময়ের নানা কর্মকাণ্ড, সৎকার কাজের দিনের বিভিন্ন মুহূর্ত দেখানো হচ্ছে। আরেক পাশের দেয়ালে সৎকারের দিনের ছবি। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কয়েক জনকে দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। সেই সময়ে কেবল সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি কাজগুলোই করতেন। ১৯৮০ সালের পয়লা জানুয়ারিতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হচ্ছিল না। তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও এক সপ্তাহের মধ্যে আবার হাসপাতালের বেডে যেতে হয় তাঁকে। ওটাই ছিল তাঁর শেষ, মৃত্যুশয্যা। মে মাসের ৪ তারিখ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জোসিপ ব্রজ টিটো।
তাঁর মৃত্যুতে যুগোস্লাভিয়াসহ পুরো বিশ্ব রাজনীতিতেই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। টিটো মৃত্যুবরণ করেন বর্তমান স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুব্লিয়ানায়। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহটি রাজধানী বেলগ্রেডে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করা হয় নীল রঙের সেই ট্রেনটি। এই ট্রেনে করেই তিনি সারা দেশ ঘুরে দেখতেন, ঘুরে বেড়াতেন। ভিডিও ডকুমেন্টারিতে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ রেললাইনের দুই ধারে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে টিটোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, জানান শেষ বিদায়। চার জন রাজা, ৩১ জন প্রেসিডেন্ট, ছয় জন প্রিন্স, ২২ জন প্রধানমন্ত্রীসহ ১৫৮টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন টিটোর শেষকৃত্যে। এটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড়ো শেষকৃত্যানুষ্ঠান। টিটোর সমাধির পাশের দেয়ালে বিশাল একটি ম্যাপ, যাতে দেখানো হয়েছে কোন কোন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন সেদিন।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা ছিলেন টিটো। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল দুই ব্লকেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম মজুমদার আমাকে প্রায়ই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টা বোঝাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করতাম। তাই আমার প্রতি সব সময় তার বিশেষ নির্দেশনা, ‘দেখো ভাই, অর্ধেক গ্লাস ভর্তি পানি। তুমি লিখতে পারো, গ্লাসের অর্ধেকে কোনো পানি নাই। আবার তাও বলতে পারো, গ্লাসের অর্ধেকে পানি আছে। মেসেজটা একই। তোমার ব্যাপার তুমি বলবে কীভাবে— পজিটিভলি না নেগেটিভলি?’
খুঁতখুুঁতে এই স্বভাব তো রয়েই গেছে এখনো। ম্যাপে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাই। আলবেনিয়া, ভুটান আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দেশ থেকে কোনো প্রতিনিধিই এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। অথচ মানচিত্রে যুগোস্লাভিয়ার পাশেই আলবেনিয়ার অবস্থান। দেশটিতে সে সময় স্টালিনের অন্ধ ভক্ত এনভার হোজ্জা শাসন করতেন। স্টালিনের অনুসারী থেকে টিটোর বের হয়ে আসাটা ভালোভাবে নিতে পারেন নি এনভার। পঞ্চাশের দশক থেকেই যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে আলবেনিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।
সমাধির আরেকটা দেয়ালে বিভিন্ন চিত্র ও রেখাচিত্র। তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যুগোস্লাভিয়ার বিবর্তনের ইতিহাস। চিত্রের নিচে রয়েছে সার্বিয়ান ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত বর্ণনা। সার্বিয়ান ভাষায় ‘যুগো’ অর্থ ‘দক্ষিণ’ মানে দক্ষিণ স্লাভিয়া নিয়ে যুগোস্লাভিয়া দেশের শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে। দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মিলে গঠিত হয় নতুন দেশ যুগোস্লাভিয়া। এটিকে বলা হতো দক্ষিণ স্লাভদের দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে দেশটি, শুরু হয় উত্থানের নতুন যাত্রা। ২০০৬ সাল পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অস্তিত্ব ছিল। এই ম্যাপে সেই চিত্রই দেখানো হয়েছে। আবার আরেকটি ছবিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশাল এক ভবন, যেটি যুগোস্লাভিয়ার সাবেক সেনা দপ্তর। ভবনের বুকে বোমার দাগ দগদগে, যেন ভূতুড়ে বাড়ি। ন্যাটো হামলায় বিপুল রক্তপাত ঘটে। এরপর বেলগ্রেডের এই সেনা দপ্তরে বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে ন্যাটো বাহিনী সমাপ্তি করে যুদ্ধের দামামা। ভবনটি এখনো সেই অবস্থায় রয়েছে। তবে তার সামনে এখনো একজন সেনা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। খাতাকলমে সেটি এখনো সরকারি সম্পত্তি বলে পর্যটকদের ছবি ওঠাতে মানা।
সোয়া তিন একরের জায়গা জুড়ে সমাধিসৌধ। তিনটা ভবনের আয়তন পাঁচ হাজার ২৫৩ বর্গমিটার। দু-দফায় নাম পরিবর্তন করা হয়েছে টিটোর সমাধির। ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হওয়া এই সমাধির প্রথম দিকে নাম ছিল ‘মিউজিয়াম মে ২৫’ আর ‘মিউজিয়াম অব দ্য রেভ্যুলুশন’। এখন নাম ‘হাউজ অব ফ্লাওয়ারস’। ফুল পছন্দ করতেন তিনি। বাড়ির আশপাশে তাই লাগানো হয়েছিল বাহারি রঙের ফুলের গাছ। এর মধ্যে টিউলিপ আর গোলাপের সংখ্যা বেশি। মজা করে তখন এটাকে ‘ফুলের দোকান’ও বলা হতো। তিনি মারা যাওয়ার পর ফুলের গুরুত্ব কমেছে, বেড়েছে শুভ্র পাথরের সমাবেশ।
বেলগ্রেডের ডেডিঞ্জে এই সমাধি। বাইরে থেকে বোঝা যায় না খুব একটা। বার্চ আর পাইনসহ নানা গাছপালায় আচ্ছাদিত একটি বাড়ি। মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্ব জুড়ে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা ছিল ইতিহাসের বড়ো অংশ। অক্ষশক্তির পক্ষে নাৎসিদের বিপক্ষে ইউরোপে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ‘যুগোস্ল্যাভ পার্টিজান’-এর নেতৃত্ব দেন টিটো। যুদ্ধ শেষে যুগোস্লাভিয়ার নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। শুরু থেকেই নিজের মতো করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। অনেকে তাই টিটোকে চেনেন স্বৈরাচারী হিসেবে।
নানা বিতর্ক ছিল সব সময়। তিনি এসবে পাত্তা দেন নি। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় টিটোর হাত ধরে। ‘দ্বিতীয় যুগোস্লাভিয়া’র স্থপতিও বলা হয় টিটোকে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন— ন্যামের প্রতিষ্ঠাকালীন পাঁচ নেতার মধ্যে টিটো অন্যতম। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮০ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিটো ছিলেন একই গতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে অবস্থান করে যুগোস্লাভিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন টিটো। যা তাঁর সাফল্যের বড়ো একটি দিক। মতভেদ আর বিতর্ক ভুলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে একত্রিত করেন টিটো। দেশকে নিয়ে যান সমৃদ্ধির দিকে। কিন্তু সমৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে নি বেশি দিন। তাঁর মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে তাঁর সাজানো-গোছানো যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ফলে যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র ভেঙে গঠিত হয় ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি দেশ।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.