নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ২৩)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ২৩)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ২৩তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব  পর্ব ১১ পর্ব ১২  পর্ব ১৩ 
পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯ পর্ব ২০ পর্ব ২১ পর্ব ২২

ফোন

ট্যাক্সিতে ফোনে কথা বলা আইন বহির্ভূত। তাই বলে কি আমরা কথা বলি না? অবশ্যই বলি এবং সারাক্ষণই ভ্যাজর ভ্যাজর করতে থাকি। কথাবার্তার টপিক সবই ট্যাক্সিকেন্দ্রিক। এয়ারপোর্টগুলোর কী অবস্থা? ব্যবসা কেমন চলছে? রাস্তাঘাটে টিএলসির গাড়ি চোখে পড়েছে কি-না, পুলিশ কি কাউকে আটকেছে? টিকেট দিয়েছে? কোন ধরনের টিকেট? রেড লাইট বিটের নাকি ইম্প্রপার টার্নের টিকেট। এ ছাড়াও শেখ হাসিনা/খালেদা জিয়া, দেশ-বিদেশের গল্প তো আছেই।

দুই হাজার ছয় সালের ঘটনা। সেদিন ছিল শনিবার। নিউইয়র্কের আকাশ ছিল মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আমি কাজে বেরিয়েছি পাঁচটার দিকে। ভাগ্যদেবতা আমার সহায় ছিলেন না সেদিন। এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জারের আশায় অনেকক্ষণ এক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে অবশেষে পেলাম দশ ডলারের পেন স্টেশনের প্যাসেঞ্জার। যা’ হোক, প্যাসেঞ্জারকে পেন স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ভাবলাম এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরি। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তোবা একটা এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার পেয়েও যেতে পারি। এইটি ফার্স্ট আর সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্ট থেকে কেনেডি বিমানবন্দরের খেপ পেয়ে গেলাম। যাত্রী দুই বৃদ্ধা। একজনকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে অন্যজনকে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এক এলাকায় নামিয়ে দিতে হবে। ম্যানহাটান থেকে এয়ারপোর্টের ভাড়া পঁয়তাল্লিশ ডলার, যা ফ্ল্যাট রেট। বৃদ্ধা দুই যাত্রীকে বললাম, আমি তোমাদের মধ্যে যে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে তাঁকে নামিয়ে দেয়ার পর মিটার বন্ধ করে দেব এবং দ্বিতীয় ট্রিপ যখন শুরু হবে তখন নতুন করে আমার মিটার চালু করব। কারণ এই ট্রিপ দুটো অংশে বিভক্ত। তাঁরা রাজি হলেন। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। শনিবার বিধায় রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগল না। প্রথম যাত্রীকে নিয়ে যখন টার্মিনালে ঢুকছি, ফোনেও পরিচিত একজনের সাথে কথা বলছি। পোর্ট অথরিটি পুলিশ যে আমার ফোনে কথা বলা লক্ষ করেছে সেটা আমি খেয়াল করি নি, যদিও ফোন ছিল আমার কোলের ওপর আর আমি কথা বলছিলাম স্পিকার ফোনে। যাত্রীকে গাড়ি থেকে নামানোর পর পুলিশ ব্যাটা আমাকে এসে বলল, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স অ্যান্ড রেট কার্ড দাও।’

আমি বললাম, ‘কেন, কি সমস্যা?’

সে বলল, ‘আমি লক্ষ করেছি তুমি টার্মিনালে ঢোকার সময় ফোনে কথা বলছিলে।’

আমি বললাম, ‘না তুমি ভুল বলছো। আমি কারও সাথেই কথা বলছিলাম না।’

এবার সে জোর গলায় বলল, ‘আমার সাথে তর্ক করবে না। লাইসেন্স অ্যান্ড রেট কার্ড দাও।’

এঁদের সাথে তর্কে যাওয়াটা অনর্থক। আমি তাঁকে লাইসেন্স অ্যান্ড রেট কার্ড দিলাম। সে টিকেট ইস্যু করে আমাকে ‘হ্যাভ এ গুড ডে’ বলে চলে গেল।

তাঁর বলা ‘হ্যাভ এ গুড ডে’ আমার জ্বালা তখন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। একেতো টিকেট দিয়েছে তার উপর বলছে ‘হ্যাভ আ গুড ডে’, হারামজাদা ফাজিলের ফাজিল।

যা’ হোক, টিকেট খেয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম। হাইওয়ে ধরে গাড়ি চলছে। মেজাজ-মর্জি খারাপ, যদিও আমি ফোনে ঠিকই কথা বলছিলাম, কিন্তু শালা দেখল কীভাবে! দ্বিতীয় প্যাসেঞ্জারকে তাঁর বাসায় নামিয়ে দিয়েছি। বৃদ্ধা ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নামার সময় আমাকে বলল, ‘আমার স্যুটকেসের ওজন অনেক বেশি। আমাকে একটু সাহায্য করবে?’

আমার মাথায় নতুন একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বৃদ্ধাকে বললাম, ‘অবশ্যই করব তবে এক শর্তে।’

বৃদ্ধা অবাক হয়ে বলল, কী শর্ত?

‘তুমি আমার ট্রিপশীটে লিখবে যে ম্যানহাটান থেকে কেনেডি এয়ারপোর্টে আসার পথে আমি কারও সাথে ফোনে কথা বলি নি।’

বৃদ্ধা হেসে বললেন, ‘তুমি তো সারাক্ষণই ফোনে কথা বলছিলে। ঠিক আছে আমি তোমার ট্রিপশীটে সেটা লিখে দেব।’

বৃদ্ধা ট্রিপশীটে সুন্দর করে লিখে দিলেন, আমার ড্রাইভার তানকিউল হাসান, হ্যাক লাইসেন্স নাম্বার ৫১৫৮৯... ম্যানহাটান থেকে কেনেডি এয়ারপোর্টে যাত্রার প্রাক্কালে একটি মুহূর্তের জন্যও ফোনে কারও সাথে কথা বলে নি। পোর্ট অথরিটি পুলিশ তাঁকে অকারণে একটি টিকেট ইস্যু করেছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে (৫৫৫) ৫৫-৫৫৫৫ নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইল। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.