বেবী নাজনীন : কোকিলকণ্ঠী এক কৃষ্ণকলি

বেবী নাজনীন :  কোকিলকণ্ঠী এক কৃষ্ণকলি

[গত পরশু, ২৩ আগস্ট ছিল প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনের ৬০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। এটি ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বেবী নাজনীনের মুখোমুখি হয়েছিলেন অন্যদিন-এর সহকারী সম্পাদক মোমিন রহমান।]

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ...           —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

তিনি কোকিলকণ্ঠী। এক কৃষ্ণকলি। ভক্ত-অনুরাগীরা আদর করে তাকে ডাকে ‘কালো গোলাপ’। কেউ কেউ ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ বলেও সম্বোধন করে।

রবীন্দ্রনাথ, কবি রবীন্দ্রনাথ সেই কালো মেয়ে—কৃষ্ণকলিকে দেখেছিলেন ময়নাপাড়ার মাঠে, যখন ঘন মেঘে আঁধার হলো দেখে ডাকছিল দুটি শ্যামল গাই, তখনই সেই কৃষ্ণকলি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

আমাদের এই কৃষ্ণকলিও ছোটবেলায় অবারিত মাঠে-প্রান্তরে খেলা আর দৌড়াদৌড়ি করে কাটিয়েছেন। তার সঙ্গী ছিল রাখাল বালকেরা যারা গরু-ছাগল চড়াত। সেই অম্ল-মধুর সোনালি শৈশব সম্পর্কে আমাদের কৃষ্ণকলি বলেন, “সৈয়দপুরের বিহারি এলাকায় দাদাবাড়ি। সেখানেই আমার শৈশব কেটেছে। সেখানে ছোটবেলায় রাখাল ছেলেদের সঙ্গে রাখালি পোশাক পরে গরু-ছাগল চড়াতাম। গলা ছেড়ে গান করতাম। লজ্জা, ভয় কোনো কিছুই আমার ছিল না। নানা বাড়ি শাহাজাদপুর। অজ পাড়াগাঁয়ে আমার ছোটবেলা কেটেছে। যার জন্যে এখনো আমার কাছে গ্রামই বেশি ভালো লাগে। আমি যে বয়সে মাঠে মাঠে দৌড়াদৌড়ি এবং খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সময় কাটাতাম সেই সময়ের কথা মনে হলেই সবচে’ বেশি মনে পড়ে আমার সঙ্গীদের কথা—সেই রাখাল বালকদের কথা। আমি যখন খোলা গলায় গান গাইতাম, তখন তারা আমাকে খুব উৎসাহ দিয়ে বলত, আবার একটি গান শোনাও। যেন ওরা বুঝতে পেরেছিল, আমি বড় হয়ে কণ্ঠশিল্পী হব। আমি জানি না, ওরা এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে। তবে আমার মনে হয়, ওরা এখনো আমাকে খুব ফিল করে।”

পাঠক, চিনতে পেরেছেন কি এই কৃষ্ণকলিকে ? হ্যাঁ, ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছেন। তিনি বেবী নাজনীন। আমাদের গানের ভুবনের এক তারকা-শিল্পী। সব মাধ্যমেই তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। চলচ্চিত্র-টেলিভিশন-বেতার-অডিও-মঞ্চ সর্বত্রই জাদুকরী কণ্ঠশৈলীতে মাতিয়ে রাখেন দর্শক-শ্রোতাদের। বিশেষত মঞ্চে তিনি অসাধারণ। এমন চমৎকার পারফরম করেন—শুধু গান পরিবেশনই করেন না, গানের ছন্দে নেচে উঠে গ্ল্যামারের দ্যুতিও চারপাশে ছড়ান; দর্শকদেরও সম্পৃক্ত করে নেন সেই গানের সঙ্গে। আমাদের এই কৃষ্ণকলি, বেবী নাজনীন, তার সঙ্গে সম্প্রতি অন্যদিন-এর কথা হয়। জিগাতলার পোস্টঅফিসের গলির ফ্ল্যাটে অন্তরঙ্গ এই আলাপচারিতায় জানা যায় বেবী নাজনীনের ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনের নানা কথা। সংগীত জগতের নানা প্রসঙ্গে তার ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও আমরা পাই। এই সবই এখানে তুলে ধরা হলো।

 

মোমিন রহমান : জনসম্মুখে গান করেন কবে ? মনে পড়ে ?

বেবী নাজনীন : হ্যাঁ, মনে পড়ে। আমি তখন খুবই ছোট। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিল অনুষ্ঠান। আমাকে কোলে করে মঞ্চে তুলে দেওয়া হলে আমি ‘ধীরে চালাও গাড়ি রে গাড়িয়াল’—এই ভাওয়াইয়া গানটি গাই। গান শেষে দর্শক-শ্রোতা পুরো হল মুখর করে তোলে। আমি আনন্দিত হই। সত্যি কথা বলতে কী, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের সেই অনুষ্ঠানের দর্শক-প্রতিক্রিয়াই আমাকে সংগীত জগতে পথচলায় অনুপ্রাণিত করে।

আমাদের এই কৃষ্ণকলি কোকিলকণ্ঠীর জন্ম রংপুরের সৈয়দপুরে। সেখানেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে। গান গাওয়া, নানা দুরন্তপনায় তার ছোটবেলা ছিল ভীষণ মধুর, ভীষণ সুখের।

বেবী নাজনীনের বাবা মনসুর সরকার। তাঁর কাছেই বেবীর সংগীতে হাতেখড়ি। পরে শহীদুল ইসলাম, খান, বশির আহমেদ, সাহাদাত হোসেন খান, সাগীর উদ্দিন খান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ অনেকের কাছে গান শিখেছেন।

মোমিন রহমান : এখন একটি কী-বোর্ডেই একটি গান করে ফেলা হচ্ছে—বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। কিন্তু এতে প্রকৃত বাদ্যযন্ত্রের মেজাজটা পাওয়া যাচ্ছে কি ?

বেবী নাজনীন : না, পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কী, সময় ও আর্থিক সাশ্রয়ের জন্যে কী-বোর্ডে একটি গান তৈরি করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে। অন্যদিকে, কেউ যদি মৌলিক কোনো কিছু করতে চান, তবে সে নানা বাদ্যযন্ত্র—তবলা, বাঁশি, সেতার, এস্রাজ, সানাই ইত্যাদি ব্যবহার করবে। তবে কথা হচ্ছে, আমাদের এখানে বাদ্যযন্ত্রীর বড় অভাব। যারা ছিলেন তারা হয় অবসর জীবনযাপন করছেন অথবা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাদের উত্তরাধিকারীদের আমরা লক্ষ করছি না। এটা আমাদের বড় ধরনের এক সমস্যা।

মোমিন রহমান : রেকর্ডিং ব্যবস্থায়ও তো এখন পরিবর্তন এসেছে। ট্রাক সিস্টেম চালু হওয়ায় এখন আর সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে না—

বেবী নাজনীন : হ্যাঁ, এটা একটা বিরাট সুবিধা। এই আধুনিক প্রযুক্তি যদি আমরা আগেই পেতাম তাহলে আরও অনেক কিছু করতে পারতাম। অবশ্য তখন যে সৃষ্টি হতো, এখন প্রযুক্তি দিয়েও সেই সৃষ্টি হচ্ছে না। কেননা এখন নিষ্ঠা ও চর্চার বড় অভাব। এখন আগের মতো শ্রম ও সময় দিয়ে গান তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না।

বেবী নাজনীন বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন ১৯৭৭ সালে, টেলিভিশনে ১৯৮২ সালে। প্রথম অডিও অ্যালবাম বের হয় ১৯৮৭ সালে। এটি অবশ্য সলো অ্যালবাম। এর আগে গীতালি থেকে একটি মিক্সড অ্যালবাম বের হয়েছিল। এই পর্যন্ত বের হওয়া অডিও অ্যালবাম হচ্ছে—একক অ্যালবাম ২০টি, মিক্সড ৭২টি, একক সিডি ১৬টি এবং মিক্সড সিডি ৪২টি। চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘লাগাম’ ছবিতে। ছবিটি ফ্লপ হয়, তবে বেবীর গাওয়া গানটি হয় হিট। গানটি হচ্ছে, ‘বিয়ের কথা বলতে/ লগন ঠিক করতে/ যাবে আমার আব্বা/ তোমার বাড়ি।’ এই পর্যন্ত অসংখ্য ছবির নেপথ্যে বেবী কণ্ঠ দিয়েছেন। বহু গান দর্শক-হৃদয় স্পর্শও করেছে। যেমন, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবী আসে’ (সত্য মিথ্যা), ‘তুমি আমার বাড়ি তুমি আমার ঘর/ তুমি ছাড়া দুনিয়ায় সবকিছু পর।’ অন্যদিকে, বেবীর গাওয়া বেসিক আধুনিক গানের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে—‘বলেছিল সে মিষ্টি হেসে আর যাই করো তুমি ভুল কোরো না’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নেরই রাত’, ‘এলোমেলো বাতাসে’, ‘রঙধনু থেকে’, ‘পরেছি লাল শাড়ি’, ‘দু’চোখে ঘুম আসে না’...।

মোমিন রহমান : আপনি তো প্লেব্যাকে একজন ব্যস্ত শিল্পী। আপনার কী অভিমত, কেন প্লেব্যাকে শিল্পীরা উঠে আসছে না ?

বেবী নাজনীন : প্লেব্যাক করা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে কমপ্লিট সিঙ্গার দরকার। তৈরি শিল্পীরাই প্লেব্যাকের যোগ্য। কিন্তু একজন শিল্পী তৈরি হতে তো সময় লাগে।

মোমিন রহমান : আমাদের চলচ্চিত্রের তো খারাপ অবস্থা (এখন অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে), অশ্লীলতা গ্রাস করেছে। গানও এর বাইরে নয়—

বেবী নাজনীন : এ ব্যাপারে আমি কট্টর সমালোচক নই। আসলে ব্যাপারটি হচ্ছে, চলচ্চিত্রে সিচুয়েশনের প্রয়োজনে গান তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে একটি-দুটি গানে কমার্শিয়াল ব্যাপার-স্যাপার থাকতেই পারে, তবে সেটুকুও করতে হবে সতর্কভাবে, যেন আমাদের রুচির বিকৃতি না হয়।

মোমিন রহমান : তাহলে এদেশের চলচ্চিত্রের গান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী হবে ?

বেবী নাজনীন : আমি তো এখনো শেখার পর্যায়ে। এখনো শিখছি। পরিপূর্ণ শিল্পী হবার চেষ্টা করছি।

মোমিন রহমান : তারপরও নিশ্চয় আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনা রয়েছে, যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে আপনি প্লেব্যাকের সঙ্গে জড়িত।... আপনি যে বললেন চলচ্চিত্রে সিচুয়েশনের প্রয়োজনে দু’একটি গানে কমার্সিয়াল ব্যাপার-স্যাপার থাকে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আগেও তো মূলধারার চলচ্চিত্রে সিচুয়েশনের প্রয়োজনেই গান থাকত, কিন্তু তখন তো আমরা কমার্সের নামে এমন ব্যাপার-স্যাপার দেখি নি।

বেবী নাজনীন : হ্যাঁ, নির্মাতাদের অনুধাবন করা উচিত যে, কমার্শিয়াল ব্যাপার-স্যাপারই সব নয়। আর সেটিও চলচ্চিত্রে শালীনতা বজায় রেখেই করা উচিত।

মোমিন রহমান : অডিও অ্যালবামের সঙ্গে মিউজিক ভিডিও রিলিজের দাবি উঠছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই সময়ে এটি কি দরকার ?

বেবী নাজনীন : হ্যাঁ, দরকার। এই সময়ে ভীষণভাবে দরকার। কেননা, বিশ্বে এখন সব কিছুই ভিজ্যুয়াল হয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষ সারাক্ষণই ক্যাবল দেখছে। চ্যানেল চেঞ্জ করে করে দেখছে একটির পর একটি। সবখানেই যদি এমন অবস্থা হয়, মানুষ দেখে-শুনে তারপর কিনবে সেটাই যদি দাঁড়িয়ে যায়, তবে এখন, এই সময়েই মিউজিক ভিডিও নয় কেন ?... যখন এইসব মিউজিক ভিত্তিক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারের জন্যে জমা পড়বে, তখন যদি কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হয়, তবে অবশ্য এর ইতিবাচক প্রভাবই আমাদের সংগীতাঙ্গনে পড়বে। এজন্যে শিল্পী, উদ্যোক্তা, নির্মাতা ও স্পন্সর—সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।

মোমিন রহমান : শিল্পী, উদ্যোক্তা—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরুন আজ আমাদের অডিও শিল্প একটি জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু তবু শিল্পীদের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে যে, এখানে শ্রোতাদের চাহিদাকে শুধু দেখা হচ্ছে, প্রকৃত শিল্পীদের শিল্পীসত্তার কদর নেই—এতে তাদের সৃজনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য ?

বেবী নাজনীন : এখানে দুটি দিক আছে। একদিকে যে পেশাদার শিল্পী তার জীবনযাপনের ব্যাপার আছে; আর যে অ্যামেচার শিল্পী তার কাছে এটা শখের ব্যাপার। যদি আপনি কোনো কিছু বাজারজাত করতে চান, তাহলে সেটি বাজারের চাহিদা অনুযায়ীই বানাবেন। আর যদি আপনি সেটি নিজের ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতে চান, তাহলে অন্যভাবে বানাবেন আপনি। এখন কথা হচ্ছে, একজন শিল্পী তার শিল্পকে ভালোবাসে, সেটিকে যে সে বাজারজাত করতে পারবেই, তা নয়। মার্কেটিং ব্যাপারটাই অন্যরকম। ভালো গান করবে, ভালো শিল্পকর্ম করবে—এটা শিল্পীর দায়িত্ব। একটা কোম্পানির দায়িত্ব হচ্ছে, একটি ভালো জিনিসকে বাজারজাত করা। আর যে জিনিসটি বাজারজাত করলে মুনাফা হবে সেটিই অডিও কোম্পানি সাধারণত জনসম্মুখে আনার উদ্যোগ নেয়। আবার একটি কোম্পানি যদি চায় যে একজন ভালো শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখবে, তখন তো সে একটি ভালো জিনিসই বাজারজাত করল। আজ হোক কাল হোক ধীরে ধীরে মানুষ তা গ্রহণ করবে। কিন্তু আপনি যদি এই দেওয়ার প্রক্রিয়াই বন্ধ করে দেন, তাহলে তো কোনো লাভ নেই।

মোমিন রহমান : রিমেক গানের ব্যাপারে আপনার কী অভিমত ?

বেবী নাজনীন : এটা খারাপ কোনো জিনিস নয়। সংরক্ষণ করার জন্যে এটি একটি সুন্দর পন্থা। কিন্তু পাশাপাশি এটাও চিন্তা করতে হবে যে, মূল শিল্পীর স্বকীয়তা ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারও নেই। এছাড়া যে কেউ রিমেক গান গাইবে, সুন্দর একটি গানের বারোটা বাজাবে—এটাও ঠিক নয়।

মোমিন রহমান : সব মাধ্যমেই তো আপনি গান করেন এবং সর্বত্রই আপনি স্বচ্ছন্দ। তারপরেও কোন মাধ্যমে গান করতে পছন্দ করেন বেশি ?

বেবী নাজনীন : অডিও, প্লেব্যাক, টিভি কিংবা বেতার—এইসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কাছে আমি বাঁধা। যদিও এর মধ্যেও গান ঠিকই গাই, ভালোও লাগে। তবে মঞ্চে প্রযুক্তির কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সেখানে শুধু শ্রোতা ও শিল্পী এবং আমি সেটিই ইনজয় করি।

মোমিন রহমান : আপনার শিল্পী জীবনে কাদের অবদান রয়েছে ?

বেবী নাজনীন : আমার পরিবারের সদস্যদের। আমার বাবা-মা, দাদা-দাদি তাঁরা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে। গান শেখা ও এর নিরন্তর চর্চার বিষয়ে তাঁরা আমাকে বলেছে। শিল্পী-জীবনের শুরুতে তাঁরা আমাকে পথ দেখিয়েছে, গাইড করেছে। তারপর সংগীতের সঙ্গে যখন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়লাম তখন থেকে শ্রোতাদের জন্য গাইতে লাগলাম। তারাই আমার অনুপ্রেরণা। এর জন্যে অবশ্য ব্যক্তি বেবী নাজনীনকে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয় শিল্পী বেবী নাজনীনের জন্যে। আমার যেন ব্যক্তিগত বলে কোনো কিছু নেই।

বেবী নাজনীনের কাছে মৃত্যু এক অবাঞ্ছিত অতিথি। মৃত্যুকে নিয়ে ভাবেন না তিনি। এটা তার কাছে স্বাভাবিক একটি বিষয়। তিনি বিশ্বাস করেন কর্মে। এই কাজের মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকতে চান—মৃত্যুর পরেও ভক্ত-অনুরাগীদের হৃদয়ে। পৃথিবীতে দাগ রেখে যাওয়ার এই প্রচেষ্টার মধ্যেই তিনি এখন মগ্ন।

বেবী নাজনীন সহজ-সরল মানুষদের ভালোবাসেন। এইসব মানুষদের সঙ্গ তার ভালো লাগে। আর ভালো লাগে গ্রাম। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গ্রামে গেলে আমি ভুলে যাই আমি শিল্পী বেবী নাজনীন। আমি তখন ব্যক্তি বেবী নাজনীনকে এনজয় করি। ঘুরি-ফিরি, বেড়াই, মনে মনে ফিরে যাই শৈশবে যেখানে আমি চাইলেও আর যেতে পারি না। তবে শৈশবের বিচরণক্ষেত্রগুলোতে ঠিকই যাই—যেখানে আমি মাছ ধরতাম, গাছ থেকে ফুল পাড়তাম, খেলাধুলা করতাম, দুষ্টুমি করে বেড়াতাম। এইসব জায়গায় সুযোগ পেলেই আমি চলে যাই, নিজেকে হারিয়ে খুঁজি, অতীতে বিচরণ করি। এই নস্টালজিক কারণে এখনো গ্রাম আমাকে টানে। এখনো এই শীতের সময় খড়ে আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে আলু পুড়িয়ে খাওয়া, চারপাশে সবাই বসে গল্প করা—এইসব ব্যাপার-স্যাপারের সঙ্গে আমি অন্য কোনো কিছুর তুলনা করতে পারি না। এগুলো আমার একান্ত ভালো লাগা।”

এক কৃষ্ণকলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিশ্বকবির। আর আমাদের এই কৃষ্ণকলির সঙ্গেও জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে দেখা হয়েছিল এক কবির। সেই কবির নাম সোহেল অমিতাভ—যার প্রকৃত নাম আবিদুর রহমান। দুজনেই দুজনের প্রতি আকর্ষিত হলেন। কবির সঙ্গে তার কবিতাকেও ভালোবেসে ফেললেন আমাদের কৃষ্ণকলি। এক সময় দুজনে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন। দুজনের ভালোবাসার ফসল—সন্তান—মহারাজেরও জন্ম হলো। কিন্তু তারপরই এক সময় নিয়তির কঠিন জ্বর নির্দেশে দুজন দুদিকে ছিটকে পড়লেন। বোধহয় এর জন্যে এই নগর দায়ী। এই নগরে বিশুদ্ধ হৃদয়ের নির্মাল্য কতদিন  তাজা থাকে ? একসময় শুকিয়ে ঝরে যায়।...যদি তাদের দেখা হতো অবারিত মাঠের মাঝে যেখানে আকাশ আর প্রান্তর মিলেছে, তবে কী হতো ? আমরা জানি না।

কিন্তু তাই বলে কি কবিতাও আমাদের কৃষ্ণকলিকে ত্যাগ করল ? না, কবিতা ততদিনে হয়ে উঠেছে আমাদের এই কৃষ্ণকলি, বেবী নাজনীনের প্রাণের জিনিস। তিনি নিজেও হয়ে উঠেছেন কবি। আত্মপ্রকাশের তাড়নাও অনুভব করলেন এক সময়। ১৯৯৯ সালে বের হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সে’। এরপর বের হয় আরেকটি কাব্যগ্রন্থ—‘ঠোঁটে ভালোবাসা’।

মোমিন রহমান : শুধু আপনার কাব্যগ্রন্থের মুখই আমরা দেখব ? অন্য আর কিছু দেখার সৌভাগ্য হবে কি আমাদের ?

বেবী নাজনীন : বোধ হয় হবে। একটি উপন্যাস লিখছি আমি। এর উপজীব্য বিষয়—সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন, সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম।

মোমিন রহমান : আমাদের শেষ জিজ্ঞাসা। আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।

বেবী নাজনীন : শ্রোতাদের জন্যে এখন যেসব গান গাইছি—এই গান গাওয়া তো চালিয়ে যাবই; এর বাইরে আমি শিল্পী হিসেবে নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে নিজের পছন্দের গীতিকার ও সুরকারদের দিয়ে কিছু গান ধীরে ধীরে তৈরি করছি। এগুলো প্রথমে শ্রোতাদের শোনার জন্যে উপহার দেব—কোনো অর্থের বিনিময়ে নয়। পরে হয়তো এগুলো বাজারজাত হতে পারে, নাও হতে পারে। তা ছাড়া প্রতি বছর ইন্টারন্যাশনাল কনসার্টে অংশগ্রহণ করি, আমার দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরি বিদেশের মানুষদের সামনে। আমার এই কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.