হুমায়ূনীয় নির্জনতার এক প্রজ্ঞাবহ রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি

হুমায়ূনীয় নির্জনতার এক প্রজ্ঞাবহ রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি

‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।’
             
             —শামসুর রাহমান

সাহিত্যের সব নদী সমুদ্রের দিকে বয়ে যায় না, কিছু নদী শুকিয়ে যায়, কিছু নদী হারিয়ে যায় বালির নিচে আর কিছু নদী একা একা মাতাল হাওয়ার মতো এসে কাঁপিয়ে দেয় হৃদয়ের ভেতরটা। হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’ও তেমনই এক নদী। যার স্রোত ইতিহাসের বুক চিরে চলে গেছে এমন এক সময়ের দিকে যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
ঊনসত্তরের আকাশে তখন জমে উঠছিল বিদ্রোহের কালো মেঘ। রাজপথ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডা —সবখানেই বয়ে যাচ্ছিল অদৃশ্য এক উত্তাল স্রোত। বাংলাদেশ তখনো পায় নি তার নাম। তবুও মুক্তির স্পন্দন যেন বাতাসে ধুকপুক করছিল। দিকহারা মাতাল হাওয়ারই মতো সব হৃদয়ে ঢুকে পড়ছিল তার কাঁপন। এটা ছিল সেই বছর যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতিতে মত্ত ছিল আর এই ভূখণ্ডে ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল ইয়াহিয়া খানের হাতে। হুমায়ূন আহমেদ সেই উত্তাল হাওয়াকে বন্দি করেছেন উপন্যাসের পাতায়, নাম দিয়েছেন ‘মাতাল হাওয়া’।

শূন্যতার ক্যানভাসে আঁকা কষ্টের পোর্ট্রেট
২৩৫ পৃষ্ঠার অন্যপ্রকাশ-প্রকাশিত এই উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে ঢাকা ও ময়মনসিংহ।
পূর্ব পাকিস্তানের অত্যন্ত প্রভাশালী এক স্বনামধন্য ক্রিমিনাল লইয়ার এবং তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের বিশেষ স্নেহভাজন হাবিব সাহেব। যার বাড়ির পরিবেশের মধ্য দিয়েই শুরু হয় গল্পের কাহিনি। গল্পে দেখানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়িতে আসে হাবিব সাহেবের মেয়ে নাদিয়া। ঘটনাক্রমে জানা যায়, নাদিয়া প্রেমে পড়ে নিজ বিভাগের এক তরুণ হিন্দু শিক্ষকের। কিন্তু হাবিব সাহেব মেয়ের জন্য পছন্দ করেন ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলের জমিদারপুত্র হাসান রাজা চৌধুরীকে। যে আবার খুনের মামলায় অভিযুক্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতা, ধর্মীয় বিভাজন ও ব্যক্তিগত স্বার্থের এই জটিল জালে আটকে পড়ে নাদিয়ার জীবন। 
উপন্যাসে নাদিয়া ও তার পরিবারের জটিল সম্পর্ক, গ্রামীণ জীবনের সূক্ষ্ম চিত্রণ এবং সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতাসহ পাশাপাশি উঠে এসেছে লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হলকেন্দ্রিক নানা স্মৃতি ও ঘটনা—যা গল্পকে একসঙ্গে ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছে।


 

উত্তাল প্রেক্ষাপট
উপন্যাসটি মূলত দুই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। যার একদিকে রয়েছে ঊনসত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক ও সামাজিক সময় আর অন্যদিকে লেখকের আত্মজীবনীমূলক অন্তর্দৃষ্টি।
কাহিনির মূল চরিত্রগুলো পশ্চিম পাকিস্তানপ্রেমী হিসেবে এসেছে। যারা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার বিরোধিতা করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের খেলায় মত্ত থাকে। লেখক এদের মধ্যে সেই সময়কার ছাত্রনেতাদের নারী-অত্যাচার, হিন্দু সম্প্রদায় বিতাড়নসহ নানা ঘটনা কাল্পনিক রূপে উপস্থাপন করেছেন—যা হয়তো তাঁর পরিচিত বাস্তব মানুষদের প্রতিচ্ছবি।
উপন্যাসের মূল ক্রাইসিস হিসেবে এসেছে বিশাল জায়গাজমি ও সহায় সম্পত্তির মালিক এমন একজন ব্যক্তির ঘটনা, যে একটা খুন করে একজন নামকরা আইনজীবীর কাছে সহায়তা নিতে আসে। কিন্তু এই আইনজীবী কেবল তার মুক্তির পথ খুঁজে দিতে চান না, তিনি চান এই অপরূপ যুবক হোক তার একমাত্র মেয়ের বরও। এদিকে মেয়ের আবার নিজের পছন্দ অন্য জায়গায়।


পাঠ-সত্তার প্রতিবিম্ব
সার্থক উপন্যাস রচনার মন্ত্র অন্তত এটাই হওয়া উচিত উপন্যাসে কাহিনির স্পর্শময়তা একজন মানুষকে যেন শিহরিত করে রাখতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’ ঠিক তেমনই এক বই। পাতায় পাতায় যার ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দ বারুদের গন্ধ। বাইরে থেকে স্থির মনে হলেও ভেতরে বয়ে চলে অস্থির সময়ের কাঁপুনি।
এই উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, ইতিহাস এখানে কেবল পটভূমি নয় বরং কালকে ধারণ করে এক অনিবার্য চরিত্র হয়ে এসেছে। ১৯৬৮-৬৯ আসলে সেই উত্তাল সময়টা ধারণ করে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছিল। কেউ যদি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রকৃত পাঠ নিতে চায়, তবে তাকে ঊনসত্তরের দ্বারস্থ হতেই হবে। কারণ বর্তমানের ছাত্র রাজনীতি, দুর্নীতি কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ছায়া সেই দর্পণেই প্রতিফলিত হয়, যা ঊনসত্তরের ভেতর লুকিয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের নিয়ে গিয়েছেন সেই তপ্ত সময়ের অন্তঃপুরে যে সময়টায় রাজপথে ছায়া ফেলছিল আন্দোলন আর ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল দেশ বিভক্তির রেখা। একদিকে ছিল মুজিব-ভাসানী দ্বৈরথ, ছয় দফার ডাক আর অন্যদিকে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠীর অহংকার ও ভন্ডামি। আইয়ুব খান পতনের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নামের এক ছাত্র নেতা মারা গেলে তার রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ছাত্রদের মিছিলে উত্তাল হয়েছিল রাজপথ। যার প্রেক্ষিতে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তাঁর সেই ‘আসাদের শার্ট’ নামক বিখ্যাত কবিতা।
হুমায়ূন আহমেদ একবার বলেছিলেন, “গল্পপিপাসু পাঠকরা রাজনীতির গল্প শুনতে চান না। সত্য তাদের আকর্ষণ করে না। তাদের সকল আকর্ষণ মিথ্যায়।” তাই এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি হিস্টোরিকাল ফিকশন হওয়া সত্ত্বেও ‘মাতাল হাওয়া’য় ইতিহাসের চেয়ে ইতিহাসের কয়েকটি চরিত্র নিয়ে ফিকশন-এর পরিমাণই বেশি রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের উত্তাল সেই সময়ের মধ্যস্থলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ‘মাতাল হাওয়া’য়, যেখানে রাজনীতি নিছক পার্টি অফিস বা মিছিলে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রবেশ করেছে পারিবারিক সম্পর্ক, ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভেতরে। উপন্যাসে যখন দেশ ছিল উত্তাল তখন চরিত্রগুলো ছিল নিভৃতে। কেউ উচ্চস্বরে কিছু বলছে না কিন্তু প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি মুখ, প্রতিটি সংকোচ হয়ে উঠেছে এক-একটি রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো। কীভাবে একটি জাতি নিজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে—এই উপন্যাস হলো সেই আগুন পথের নেপথ্য সংগীত।


ভাষার সূক্ষ্ম সৌন্দর্যে হুমায়ূনের সহজাত মুনশিয়ানা
হুমায়ূন আহমেদের কলমে এক ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল। তিনি জটিল বিষয়কে সরল করে বলতেন না বরং সরলতার আড়ালে রেখে দিতেন অসীম জটিলতা। ‘মাতাল হাওয়া’য় তিনি ইতিহাসকে টেবিলের ওপর তুলে না দিয়ে মানুষের ভেতরে গেঁথে দিয়েছেন। কিছু জায়গায় তিনি যেন চেতনার টেলিস্কোপ দিয়ে সময়কে খুঁটিয়ে দেখেছেন, আবার কোথাও চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। উপন্যাসে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম একাধিকবার এলেও, এটা মূলত ইতিহাসের ঢেউয়ের ধাক্কায় নিজেদের দিক হারিয়ে ফেলা মানুষের গল্প।
 কিছু বিষয় যা না বললেই নয়, হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল তাঁর চরিত্র নির্মাণে এবং গল্প বলার ঢঙে। এই উপন্যাসেও আমরা হুমায়ূনীয় চরিত্রগুলিকে দেখতে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি আধিভৌতিক ক্ষমতার অধিকারী মুখরা এক বয়োবৃদ্ধ নারীকে; কখনো পেয়েছি এমন একজন পিতার চরিত্র, যাকে ভালো-মন্দের মাপকাঠিতে ফেলা যায় না। সেই সাথে চলতে থাকা ক্রমাগত শিল্লুক ভাঙ্গানি বা ধাঁধা, ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজ গানের উল্লেখ, হুমায়ূন আহমেদের ছকে বাঁধা সংলাপের মায়াজাল, বাস্তব-অবাস্তব পৃথিবীর বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার একদম সাজানো পরিপাটি ঘনঘটা আর দমফাটানো সেন্স অফ হিউমার।


ছায়ার ভেতরে আলো তথা আত্মজৈবনিক উপাদান
‘মাতাল হাওয়া’র এক অনন্য সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে লেখকের আত্মজৈবনিক উপাদানে। হুমায়ূন আহমেদের শৈল্পিক আত্মকথন এখানে সাহিত্যের জন্মকথায় রূপ নিয়েছে। বন্ধু রমিজের হয়ে ‘রূপা’ নামের এক তরুণীকে প্রেমপত্র লেখার ঘটনাটায় বুঝতে পারছিলাম, এই রূপা চরিত্রটিই পরে হয়ে উঠেছিল হিমুর রূপা—যা বাংলা সাহিত্যের হিমুপ্রেমীদের কাছে এক অমর নাম।
আবার আর এক রহস্যময় ডিম ভাজার শব্দ থেকে ভবিষ্যতের মিসির আলি জন্মের আভাস মিলছিল যেন। লেখক তার কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যকার ফাঁক গলিয়ে পাঠককে নিয়ে গিয়েছেন এক সাহিত্যিক জাদুবাস্তবতায়। এই অংশগুলো তাই আমার দৃষ্টিতে শুধুই আত্মজীবনী নয়, বরং সাহিত্যের উৎস সন্ধানের এক দুর্লভ প্রয়াস।


শেষ কথা
হুমায়ুন আহমেদ স্বয়ং ঊনসত্তরের উত্তাল সেই সময়ের সাক্ষী। প্রত্যক্ষ করেছেন নানা করুণ বাস্তবতা। সেসব সাথে নিয়ে এবং তার সাথে কল্পনার মায়াজাল বিছিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ‘মাতাল হাওয়া’। উপন্যাসটি পড়ে মনে হবে, ইতিহাস মানে কেবল গৌরবোজ্জ্বল স্লোগান বা রক্তাক্ত বিদ্রোহ নয়। ইতিহাস বাস করে ব্যক্তিগত কষ্ট, হারানো ভালোবাসা, অসহায় সিদ্ধান্ত আর নীরব বিদায়ের ভেতরেও। এই উপন্যাস যেন সেইসব শূন্যতাকে শব্দে রূপ দিয়েছে।

সূত্র : মাতাল হাওয়া। লেখক : হুমায়ূন আহমেদ। প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ। প্রচ্ছদ : মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম অবলম্বনে মাসুম রহমান। পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২৩৫। মূল্য : ৬০০ টাকা

Leave a Reply

Your identity will not be published.