একজন ভালোবাসাভরা মানুষ

একজন ভালোবাসাভরা মানুষ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চলে গেলেন। চলে গেলেন আক্ষরিক অর্থেই অকালে। এই যুগে ৭৪ বছর কি বিদায় বলার মতো কোনো বয়স ?

৩ অক্টোবর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের যখন হার্ট অ্যাটাক হলো, তখন দেশে তিনি কার্যত একা। তাঁর একমাত্র ছেলে শাফাক ইসলাম বহুদিন আগেই প্রবাসে সংসার পেতেছেন। স্ত্রী সানজীদা ইসলামও অল্প কয়েক দিন হলো বিদেশে গেছেন, ছেলের সান্নিধ্যে। কিন্তু সৈয়দ মনজুর মানুষটাই এমন যে এই শহরে এবং শহরের বাইরে তাঁর শুভার্থীর শেষ নেই।

 

গাড়িতে করে যাওয়ার পথে তাঁর তীব্র হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সেই ধাক্কায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে চেতনা ফিরতেই ফোনটা খুলে কোনোমতে তাঁর ড্রাইভারের হাতে দিতে পেরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, তাঁর কয়েকজন শুভার্থীকে খবর দিতে। ব্যস, এই শুভার্থীরাই তাঁর চিকিৎসা আর পরিচর্যার সব ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পরের একটি সপ্তাহজুড়ে এঁদের অক্লান্ত সেবা আর যত্ন কোরকের মধ্যে অস্ফুট কুঁড়ির মতো তাঁকে আবৃত করে রেখেছিল। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই ধরে রাখা গেল না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮০-র দশকের প্রথমার্ধে, ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদীর দপ্তরে। আমি বিশ-বাইশ বছরের তরুণ কবি যশোপ্রার্থী, সৈয়দ মনজুর মধ্যতিরিশ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। মনজুরুল ইসলাম পিএইচডি সেরে দেশে ফিরে লিখতে শুরু করেছেন। অনেকের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন। আমি আল মুজাহিদীর ওখানে গেছি সদ্য লেখা কোনো কবিতা নিয়েই হয়তো। একটা ছোটকাগজে আমার লেখা দীর্ঘ লেখা বেরিয়েছে, কবি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে। কাঁচা বয়সের তীব্র ঝাঁজে ভরা লেখা। পত্রিকাটা আল মুজাহিদীর টেবিলে। কথা বলতে বলতে মনজুরুল ইসলাম পত্রিকাটা হাতে তুলে নিলেন। পাতা উল্টে উল্টে নানা লেখা দেখতে দেখতে আমার লেখাটায় এসে থামলেন। সেটা তিনি একটু একটু করে পড়ছেন আর বলছেন, ‘আরে, এটা তুমি লিখেছ ?’ সেই কাঁচা বয়সের আমি তো শিহরিত।

প্রথম আলাপেই অবিশ্বাস্য অন্তরঙ্গতার সূত্রপাত। এর পর আমার বড় ভাইয়ের কবিবন্ধুদের দলে ভিড়ে কত কত রাত যে মনজুর ভাইয়ের বাড়িতে আড্ডায় মেতেছি, তাঁদের অন্ন ধ্বংস করেছি! তাঁর ঠিকানা পাল্টেছে—এলিফ্যান্ট রোডের ভোজ্যতেলের গলি থেকে লালমাটিয়া, লালমাটিয়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের শিক্ষক-নিবাসে। তাঁদের নতুন সংসারের একান্ত নিভৃতি তছনছ করে দেওয়া সেই আড্ডা চলেছে অবিশ্রাম।

এই অনতিদীর্ঘ সময়ে দেখেছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ক্রমশ বিস্তার। তিনি বিদ্যায়তনের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন। প্রথমে সাহিত্যধর্মী লেখায়, পরে শিল্পকলা বিষয়ে। তবে লেখালেখির জগতেই তাঁর চলাচল সীমাবদ্ধ রইল না। বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা নির্বাহী পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও তাঁর স্থান হতে লাগল।

তবু বিদ্যায়তনই ছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নিজের এলাকা, তাঁর প্রাণের ডানা মেলার মতো স্ফুর্তির নভোমণ্ডলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য। ক্লাস নিতেন নিয়মিত, সময়মতো যেতেন। ছিলেন নিবিষ্ট শিক্ষক। গুরুগম্ভীর তো ননই; বরং খুবই প্রাণবন্ত, কৌতুকমুখর, সহজে গল্প করার মতো একজন প্রাণখোলা মানুষ। এমন শিক্ষক যাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, টিপ্পনী কাটা যায়, রসিকতা করা যায়—যিনি হয়ে উঠতে পারেন ছাত্রদের অকপট বন্ধু, ছাত্রদের ভালোবাসার পাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে দীর্ঘ শিক্ষকতা-জীবনে অজস্র ছাত্রছাত্রী সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু সৈয়দ মনজুরকে তাঁরা কখনো ছেড়ে দেন নি। ক্লাসের শিক্ষক শুধু বদলে গিয়েছিলেন স্নেহভরা বন্ধুতে।

এই নিবিষ্টতা সত্ত্বেও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ক্লাসরুমের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকেন নি। নিজ গুণে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বৃহত্তর পরিসরে। পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের তরুণ লেখক-শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় অন্তরঙ্গতা। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের তাঁর মতো এত গভীরভাবে আর কাউকে আমি সম্পৃক্ত হতে দেখি নি। প্রায় প্রত্যেকের জন্যই তিনি কিছু না কিছু করেছেন। হয় কারও বইয়ের সমালোচনা লিখেছেন, কবিতা অনুবাদ করে দিয়েছেন ইংরেজিতে, নবীন শিল্পীর ক্যাটালগের জন্য লিখে দিয়েছেন ভূমিকা।

আমরা তখন তৎকালীন পিজি হাসপাতালের গাছতলায় বসে আড্ডা পেটাই। আমাদের সঙ্গে তরুণতর অনেকে এসেও আড্ডায় ভিড়ে যায়। বিদেশি কথাসাহিত্যিকদের নিয়ে লিখে এক তরুণ তখন অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। সে ছিল আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। একদিন সে এল। আলীগড়ে ইংরেজি অনার্সে সে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু আলীগড়ে সে আর পড়বে না। সে মাস্টার্স করতে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এখানে যেহেতু অনার্স করে নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো তাকে মাস্টার্সে আর ভর্তি করবে না। সেই তরুণ আমার সহযোগিতা চাইল। কিন্তু আমার নিজেরই-বা বয়স কত ? কীই বা ক্ষমতা ? যাবই-বা কার কাছে ? আমি অনুরোধ করলাম সৈয়দ মনজুরের কাছে। সেই তরুণকে তিনি ডেকে পাঠালেন। এশীয় দ্বিবার্ষিক চিত্রকলা উৎসব সে সময় আসন্ন। সেটির বৃহদায়তন ক্যাটালগের দায়িত্ব পড়েছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ওপরে। তিনি সেই তরুণকে ক্যাটালগের লেখার বিষয়গুলো সম্পর্কে বলে লিখে আনতে বললেন। তরুণ লিখে নিয়ে গেল। সৈয়দ মনজুর সন্তুষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেল সেই তরুণের। আমি যৎকিঞ্চিৎ কবিতা মকশো করি। আমার কথা রাখার যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণই সৈয়দ মনজুরের ছিল না। তবু তিনি কথা রেখেছিলেন। এমনই ছিলেন তিনি। সেই তরুণ এখন একটি ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ও কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পড়াতেন সাহিত্য, বিশেষ আগ্রহ ছিল নন্দনতত্ত্বে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির সে সময়কার মহাপরিচালক মনজুরে মাওলার তদারকিতে ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা’ সিরিজে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের শিরোনাম যে নন্দনতত্ত্ব, সেটি কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। তিনি পড়াতেন উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-কাঠামোবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদের তত্ত্বজগৎ, তবে এর তীক্ষè সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক শল্যব্যবচ্ছেদে তাঁর আগ্রহ ছিল কম। তিনি ছিলেন রুচি ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষ। এসব নতুনতর ভাবনার চমকপ্রদ সৌন্দর্য সৈয়দ মনজুরকে বিমোহিত করেছিল বেশি। আর এর নিপুণ প্রকাশ ঘটেছিল প্রবন্ধ-নিবন্ধের বদলে তাঁর গল্পে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তাঁর এক বন্ধুর বাবা মারা যান। সেই বেদনাভরা আবেগে, ১৯৭৩ সালে, ‘বিশাল মৃত্যু’ নামে তিনি প্রথম গল্প লিখেছিলেন। তখনকার মতো সেটিই শেষ। আর লেখেন নি। বহু বছর পরে গল্পে যখন আবার ফিরে এলেন, গল্প বলার ভঙ্গিটি তখন পুরো পাল্টে গেছে। মাঝখানের এই সময়টাতে তিনি পাঠক ও শিক্ষক হিসেবে সাম্প্রতিক তত্ত্ব ও সাহিত্য পড়ে ও পড়িয়ে এসেছেন।

নতুন করে তিনি গল্প বুনতে শুরু করলেন যৌথভাবে লেখা প্রথম উপন্যাসের মধ্য দিয়ে, ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে, বাংলা একটি দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে। ‘যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক’ নামে সে উপন্যাসের বড় অংশই তাঁর রচনা। উপন্যাসটির কিস্তি বের হতো, আর অবাক হয়ে যেতাম সৈয়দ মনজুরের তিক্ত রসিকতা, বাঁধভাঙা কল্পনা আর উদ্ভটের পারঙ্গম প্রয়োগে। ১৯৯০-এর দশকে অচেনা এক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আবির্ভাব লক্ষ করা গেল—নতুন রকমের গল্প-বলিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে বাংলা সাহিত্যের অভূতপূর্ব সুরসিক লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নাতি, এর আগে তার লক্ষণ ধরা পড়ে নি। গল্প-উপন্যাসে তা এক নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হলো।

এই পথ পর্যন্ত আসার আগে সৈয়দ মনজুর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সাদার্ন মিসিসিপি ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামে সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্য নিয়ে লিখে সুনাম অর্জন করেছেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ইমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছেন। গল্প আর উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমি আর প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের লেখক হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। এসবের বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন সবার উপচে পড়া ভালোবাসা। এই ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন সবাইকে ভালোবাসা দিতে পারার অসামান্য ক্ষমতার কারণে। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মনে হয়েছে, সৈয়দ মনজুর তাঁকেই বিশেষভাবে ভালোবাসেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জীবনের শেষ কয়েকটি দিনে সেই ভালোবাসার টানই দেখা গেল তাঁর শুভার্থীদের আকুল সেবাপরায়ণতার মধ্যে। এত ভালোবাসার ক্ষমতা কারই-বা আছে ? ০

Leave a Reply

Your identity will not be published.