নীল ধ্রুবতারা (পঞ্চম পর্ব)

নীল ধ্রুবতারা (পঞ্চম পর্ব)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব।]

সিমির মেইল পড়ার পরে একধরনের মিশ্র অনুভূতি হলো ফাহিমের।

মেয়েটি তো দেখি খুব সহজ করেই উত্তর লিখেছে। যদিও ফাহিম বয়সের ব্যাপারটা নিয়ে নিজেই অস্বস্ত্বিবোধ করছিল। সিমি কি তাহলে হতাশ হয়েছে? হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বয়স লুকিয়ে কি কোনো সম্পর্ক করা ঠিক? আর সম্পর্কের কথাইবা ভাবছে কেন সে। ইমেইলের মাধ্যমে পরিচয় আর তার সূত্র ধরে কিছুদিন মেইল আদান-প্রদান হয়েছে, এর বেশি কিছু তো নয়। এখানে কি কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে? এটাকে কি কোনো সম্পর্ক বলা যায়? বন্ধুত্ব? আর বন্ধুত্ব যদি হয়ই, তাতে বয়সের ব্যবধান কতটা গুরুত্ব বহন করে? পুরো বিষয়টা অবশ্য নির্ভর করছে সিমির ওপর। তবুও নিজেকে পরিষ্কার রাখতেই অনেক ভেবে ফাহিম একটা মেইল লিখল।

সিমি,
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার বয়স জানার পরে তুমি হতাশ হবে। অবশ্য আমি চাইলেই বয়স লুকিয়ে তোমার বয়সের কাছাকাছি একটা সংখ্যা বলে দিতে পারতাম, কিন্তু তাতে কি ব্যাপারটা ভালো হতো? মিথ্যে বলার মতো কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই নি, যা সত্যি তাই বলেছি। লুকানোর তো কিছু নেই।

আমি জানি, তোমার বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে আমার মতো একজন বয়স্ক মানুষের বন্ধুত্ব ব্যাপারটা ঠিক যায় না। তাই তুমি যদি চাও তাহলে আমাদের যোগাযোগ কিংবা মেইল আদান-প্রদান এখানেই বন্ধ হতে পারে। আমি কিছুই মনে করব না।

মুনার সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য দশ বছরের মতোই। কিন্তু আমরা বেশ ভালো বন্ধু এবং আমাদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট। শিকাগোর বাঙালি কমিউনিটির একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যেয়ে তার সাথে আমার পরিচয় তারপর বন্ধুত্ব, সেই ৯৭ সাল থেকে। বেশ দীর্ঘ সময়ই বলা যায়। আমাদেরও ঝগড়া হয়, ভুল বোঝাবুঝি হয়। কিন্তু মুনা তার যে-কোনো আনন্দ বা কষ্টের কথা আমাকে বলে, সম্ভবত প্রথমেই। ব্র্যাড নামে আমেরিক্যান এক শ্বেতাঙ্গছেলের সাথে সম্প্রতি তার সম্পর্ক হয়েছে। ব্রাডের সাথে তার সম্পর্কের খুটিনাটি পারলে প্রতিদিনই আমাকে কিছু জানায়। এমন নয় যে আমি ছাড়া মুনার আর কোনো বন্ধু নেই। আমার কাছে তার বিশ্বাসের একটা জায়গা আছে, তাই হয়তো সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নির্দ্বিধায় বলতে পারে সবকিছু।

এসব কথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমাকেও তোমার বিশ্বাস করতে হবে এবং তোমার সব কথা বলতে হবে। তবে যদি বিশ্বাস করোই, তোমার আস্থার জায়গাটা অটুট থাকবে।

জানি না এসব কথা আমি কেন তোমাকে বলছি। আমার এক ধরণের গিলটি ফিলিং হচ্ছিল। সম্ভবত সেই অনুশোচনা কাটাতেই এত কথার অবতারণা।

বন্ধুত্ব হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক—আত্মার শক্তিশালী বন্ধন। এখানে বয়সের ব্যবধান কোনো বাধা নয়। আমার কাছে বন্ধুত্ব মানে বয়সের সাথে বয়সের মিল নয়, বরং মনের সাথে মনের।

ভালো থেকো।

ফাহিম।

মেইলটি পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল ফাহিমের। অসম বয়সী বন্ধুত্ব যে কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়, সেই সম্পর্কে নাতি দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে বিষয়টির যৌক্তিকতা বোঝাতে যে পেরেছে এতেই সে খুশি।

পরের দিন মোটামুটি উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটল ফাহিমের সময়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় একবার করে মেইল চেক করল সে। কিন্তু সিমির কোনো মেইলের দেখা পাওয়া গেল না। 

পরের দিনও না, তারপরের দিনেও না। ফাহিমের উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল। সিমি যদি ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না চায়, তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। সেই অধিকার তার আছে। কিন্তু সেটা জানালে তো ক্ষতি নেই। এটুকু সৌজন্য অন্তত সে দেখাতে পারত। কিন্তু ফাহিমের অবচেতন মন বলছে, সিমি শেষবারের মতো হলেও একটা মেইল তাকে পাঠাবে। তাই সে প্রতিদিনই সুযোগ পেলেই মেইলবক্স খুলে দেখতে থাকল।

সিমি কি তাহলে সত্যিই রাগ হলো কিংবা হতাশ? না হলে কোনো উত্তর নেই কেন? এতদিন তো মেইল পেয়েই উত্তর দিয়েছে! যে সম্পর্কের দানাই বাঁধল না ঠিকমতো এখনো, তা কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে?

আরও একদিন পর সিমির ইমেইল এল। ফাহিমে উত্তেজনা বেড়ে গেল। তারপরেও যথা সম্ভব স্থির হয়ে সে মেইল খুলে পড়া শুরু করল।

হেই হেই হেই, ডোন্ট গেট আপসেট, ম্যান। তুমি আমার সমবয়সী নও, তাতে কী হয়েছে? তোমার যদি আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে সমস্যা না হয়, তাহলে আমার কেন হবে? তাছাড়া বয়স আসলেই কোনো বাধা নয়, হওয়া উচিতও নয়। তুমি যেমন বললে, আমিও ঠিক তাই-ই মনে করি।

কি খুব টেনশনে ছিলে বুঝি— আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিব এই ভয়ে? আরে ধুর। সেসব কিছুই না। পারিবারিক কিছু ঝামেলা ছিল, মূলত শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গেই, জমিজমা সংক্রান্ত। যাই হোক, তোমাকে এভাবে অপেক্ষায় রাখাটা ঠিক হয় নি। কয়েকটি লাইন অন্তত লিখে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। তারপর মনে হলো, তোমাকে একটু টেনশনে রাখা যাক। ভীষণ দুঃখিত। এক্সট্রিমলি সরি।

দেখতে চেয়েছিলাম, আমার বিরহে কতটা কাতর হও তুমি! একটু কি মন কেমন কেমন করেছে?

আমি যখন রাশেদের প্রেমে পড়ি, আমার বয়স তখন বিশ বছর আর রাশেদের একত্রিশ। হ্যাঁ, আমার চেয়ে এগারো বছরের বড় ছিল সে। দেখতেই পাচ্ছ, বয়স কিন্তু কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি প্রেমে পড়বার কিংবা ভালোবাসবার এবং বিয়ে করবার জন্য, তাহলে শুধুই বন্ধুত্বের জন্য কেনইবা সেটা বাধা হবে? আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় অনেক বন্ধুই আমার আছে। এমন কি আমার বাবার বয়সীও। তোমার বয়স নিয়ে আমি একেবারেই চিন্তিত নই, আপসেটও নই। কাজেই মাথা থেকে ওই উদ্ভট চিন্তা বের করে দাও।

যাইহোক, আমি যখন কাউকে বন্ধু ভাবি, তখন কে বয়সে বড় আর কে ছোট সেগুলো আমার মাথায় থাকে না। আমি তাকে বন্ধুর মতোই ট্রিট করি। হাসি-ঠাট্টা খুনসুটি করি, দুষ্টুমি করি, এমন কি ধমকও দিই। আগেই জানিয়ে রাখলাম। পরে আবার বলতে পারবে না মেয়েটি এমন কেন? আমি এমনই।

তুমি কিন্তু আমাকে তোমার জন্ম তারিখটি জানাও নি। বন্ধুর জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে হবে না? তবে তুমি যদি জানাতে না চাও- তাহলে ভিন্ন কথা।

তুমি আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে অসম বয়সের বন্ধুত্বের বিষয়ে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছ। জানিয়েছ তোমার গিলটি ফিলিংয়ের কথা। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি, কেন এমন অনুভূতি তোমার হলো। দেখো, তোমাকে না জেনে না চিনেই আমি কিন্তু আমার জীবনের কত কথা বলে দিলাম অকপটে, নিশ্চিন্তে। না বললেও পারতাম, তবুও বলেছি। আমি রাশেদের প্রসঙ্গে কিছু না বললে, আমাদের কথা হয়তো সেখানেই থেমে যেত। কিন্তু আমি বলেছি। মাঝে মাঝে জীবনের কিছু কিছু কথা কাউকে না কাউকে তো বলতেই হয়। আর তাই তো, কাছের কেউ, পরিচিত এমন কী অপরিচিত অনেকের সঙ্গেও পথেঘাটে, চলতি পথে জীবনের বিশেষ কোনো গল্প আমরা শেয়ার করি। করি না?

আমি তোমার মেইলের অপেক্ষায় থাকব। তোমার প্রতিটা লেখা আমাকে শক্তি দেয়, কীভাবে জানি না, তবে দেয়। মনে হয় কেউ অন্তত একজন আছে যে আমাকে নিয়ে ভাবছে। কাজের ফাঁকে। অবসরে। কারও ভাবনায় থাকাটাও কিন্তু আশীর্বাদ। আমরা কি সবাইকে নিয়ে ভাবি?

আচ্ছা, তোমার কি কোনো মেসেঞ্জার প্রোগ্রাম আছে, লাইক ইয়াহু কিংবা এমএসএন? যদি থাকে তাহলে আমরা মাঝে মাঝে অনলাইনে চ্যাট করতে পারি। তাহলে মেইলের অপেক্ষায় না থেকে খুব সহজেই কথা বলা যাবে। ভালোভাবে একে অপরকে চেনাও হবে। জানাও যাবে। অবশ্যই যদি তুমি চাও- তবেই।

আশা করি তুমি আমাকে খুব তাড়াতাড়িই লিখবে- আরো অনেক কথা অনেক।

অনেক ভালো থেকো। অপেক্ষায় রইলাম।

সিমি।

সিমির মেইলটা পেয়ে কী এক ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে রইল ফাহিমের মন। মেয়েটার প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল সে।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.