[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন দশম পর্ব।]
সিমি,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, তোমাকে কলব্যাক করতে পারি নি বলে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! গভীর রাতে আমার ফোনটা একবার বেজে উঠল। আমার এখানে তখন ভোররাত ৩:১১! ফোনটা কি তুমি করেছিলে?
তোমার জীবনের গল্প শুনে আমি কিন্তু আর মন খারাপ করে নেই এখন। তবে বেশ কিছুদিন তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি তা অস্বীকার করব না। আমারও মনে হয়, জীবনকে জীবনের নিয়মেই চলতে দেওয়া উচিত। পেছনের কথা ভেবে থেমে থাকলে তো চলবে না। মানুষের জীবনে দুঃখ যেমন থাকে, সুখের স্মৃতিও তো থাকে। জীবনে দুঃখ–কষ্ট, বেদনা, ব্যর্থতা আসবেই। এসব নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
তুমি তো খুব সুন্দর করে বললে সিমি; সত্যিই তো সৃষ্টিকর্তাই হচ্ছে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং কারও সাধ্য নেই সেই স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করার। আর হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তার ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্থা দুই-ই আছে।
আমার হৃদয়ের নিলয় থেকে অলিন্দে তোমার জন্যে বেশ খানিকটা জায়গা খালি করেছি। রিজার্ভেশন পাক্কা। তুমি ডিজার্ভ করো তাই অটো রিজার্ভ হয়েছে। তবে বিনিময়ে ছোট একটা জিনিস চাইব।
তোমার একটা মিষ্টি হাসি
যদি পাই,
বর্ত্যে যাই,
কিছু আর নাহি চাই।
তোমার সঙ্গে যখন দেখা হবে, এই উপহারটি আমায় দিয়ো। তাতেই আমি খুশি হবো অনেক।
ভালো থেকো মেয়ে। আমাদের কিন্তু কথা বলার কথা। অপেক্ষায় আছি।
ফাহিম।
আজ ফাহিমের মনটা ভীষণ ফুরফুরা। সিমির সাথে তার ফোনে কথা হয়েছে। মেয়েটির কণ্ঠস্বর, কথা বলার ঢং, উচ্চারণ, সারাক্ষণ হেসে হেসে কথা বলা, দুষ্টুমি— সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম একটা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলো ফাহিম। আবার একটু কষ্টও হলো, এই ভেবে যে এমন স্বতঃস্ফূর্ত, হাসিখুশি মেয়েটির জীবনে কেন এমন একাকিত্ব!
সিমির সঙ্গে কথা বলার পর ফাহিমের আরও একটা উপলব্ধি হলো। তার মনে হলো মেয়েটির চরিত্রের মধ্যে একধরনের রহস্যময়তা আছে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে ফাহিমের ইচ্ছে হলো কয়েক লাইন মেইল লিখে পাঠানোর। সে লিখল-
রহস্যময়ী মেয়ে,
I love when you laugh, I like when you laugh. Wish you can laugh like that forever.
সত্যিই তুমি এত সুন্দর করে হাসতে পারো, আমি তো তোমার হাসির প্রেমেই পড়ে গেছি। দুষ্টুমিও বেশ ভালোই জানো দেখছি। যদিও আমি ভালো কথা বলতে পারি না, সুন্দর করে তো নয়ই। অথচ তোমার সঙ্গে কী সাবলীল আর সহজভাবেই না কথা বলে গেলাম। ননস্টপ। এ কি আমি? নিজেই ভীষণ অবাক হয়েছি। অথচ আমি কথা বলতে পারি না, হাসাতে জানি না, মন ভালো করে দেবার কোনো ক্ষমতা আমার নেই- আরও কত কী শুনি নিজের সম্পর্কে। জানি না, তোমার কাছে কী মনে হয়েছে, অথবা কী ভেবেছ আমার সম্পর্কে। আমি কিন্তু বেশ এনজয় করেছি তোমার সঙ্গ। মনেই হয় নি, একে অপরের কাছ থেকে ১২৭২২ কিলোমিটার দূরত্বে আমাদের অবস্থান ছিল।
এই প্রথম ফোনে আমাদের কথা হলো অথচ মনে হয়েছে তুমি আমার জন্ম-জন্মান্তরের চেনা কেউ। প্রতিদিনই আমাদের দেখা হয়, কথাও হয়। কত আপন! আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়...
কেন জানি না, গত বেশ কয়েক দিন ধরে, আমি প্রতি মুহূর্তে কেবল তোমার কথাই ভাবছি। আমি তোমাকে দেখতে পাই, চোখ খোলা থাকুক বা বন্ধ। আমার অদেখা তোমার মুখটি সারাক্ষণ চোখের সামনে ঘুরে।
এটুকু লিখে ফাহিম ভাবতে লাগল। হঠাৎই আর কোনো কথা খুঁজে পেল না সে। অনেকক্ষণ ধরে আঁতিপাতি করে কথা খুঁজে না পেয়ে তার পছন্দের একটা গানের কিছু লাইন লিখল। জনপ্রিয় আমেরিকান গায়ক রয় অরবিসনের ‘রহস্য মেয়ে।’
In the night of love
Words tangled in her hair
Words soon to disappear
A love so sharp it cut
Like a switchblade to my heart
Words tearing me apart
She tears again my bleeding heart
I want to run, she’s pulling me apart
Fallen angel cries
Then I just melt away
She’s a mystery girl
কাজ থেকে ফিরে ফাহিমের মেইল পড়ল সিমি। মনে মনে হাসল। একটু ভাবল এবং উত্তর লিখল প্রায় সাথে সাথেই।
এই ফাহিম,
তুমি কি প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? কিন্তু তোমার তো প্রেমে পড়া বারণ। একেবারেই না না। এখন কী হবে তবে? সামনে সমূহ বিপদ তোমার।
আমার ধারণা তুমি প্রেমে পড়েছ, আবার- এমন একটি মেয়ের, যে রহস্য ভালোবাসে, হঠাৎ করেই সে তোমার জীবনে এসেছে রংধনুর সাত রঙে রাঙিয়ে, সূর্যের সব আলো ছড়িয়ে। যদিও সেই রং কিংবা আলোর কোনোই প্রয়োজন নেই তোমার জীবনে। আমি কি ঠিক বলেছি?
তোমার বউ যদি জানতে পারে, তোমার কিন্তু খবর আছে বন্ধু। ধরা পড়ে গেলে আমাকে দোষ দিতে পারবে না কিছু। আমি কিন্তু আগেই সাবধান করে দিচ্ছি।
তুমি কয়েক লাইন কবিতা লিখেছ না কি গান, কিছুই বুঝি নি। ব্যাখ্যা করবে? কে এই মিস্ট্রি গার্ল? প্রিটি প্রিটি প্লিজ।
আমি অবশ্যই হাসব, সত্যিকার উচ্চ শব্দে হাসা যাকে বলে। তুমি যখন দেশে আসবে, দেখবে আমার হাসি। আমি কেমন হাসতে পারি নিজ চোখেই দেখো। তখন কিন্তু শব্দ দূষণের জন্য আমাকে দায়ী করতে পারবে না।
আমি আর কিছু লিখতে চাইছি না। আমার অংশটুকু কাল লিখব। সে পর্যন্ত ভালো থেকো।
লটস অফ লাভ।
অ্যা মিস্ট্রি গার্ল।
সিমি,
তোমার বুঝি তাই ধারণা যে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি? এত দ্রুত? তোমার সঙ্গে আমার এই মেইল চালাচালির সম্পর্ককে কি প্রেম বলা ঠিক হবে?
না বন্ধু, আমাকে নিয়ে ভয় পেয়ো না। সেই অর্থে যাকে প্রেম-ভালোবাসা বলে, তেমন প্রেমে পড়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই- অন্তত আমার পক্ষ থেকে। যদিও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, রহস্যময়ী মেয়েটি আমার মনোঃদৃষ্টি আকর্ষণ করেছে খুব ভালোভাবেই। হঠাৎ দেখা দেয়া রঙধনুর মতোই।
মানুষের জীবনটাও কিন্তু রংধনুর রঙের মতোই। হঠাৎ করে সুখ দেখা দেয়, কিছু সময় সে সুখ স্থায়ী হয়। আবার চলেও যায়।
ভালোবাসা, এই এক ছোট শব্দে আছে হাজার অনুভূতির মিশ্রণ। ভালোবাসাকে কতভাবেই তো সংজ্ঞায়িত করা যায়। পৃথিবীতে সহস্র ধরনের ভালোবাসা আছে। আমি যদি তোমাকে ভালোবাসিও, তোমার মতো একজন বন্ধু তেমন ভালোবাসা পেতেই পারে। একজন মানুষের বুকে অনেক এবং অনেকের প্রতিই ভালোবাসা থাকতে পারে। থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
তোমার প্রেমে যেন না পড়ে যাই, তার জন্যে আমাকে আগেভাগেই সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। যদিও, আমাকে সতর্ক করে দেওয়ার অনেক আগে থেকেই আমি জানি, আমার সীমাবদ্ধতার কথা। কাজেই বেশি টেনশন নিয়ো না। বন্ধু যেখন ভেবেছি, সম্পর্কটা সেখানেই লক করা থাকবে, অন্তত আমার কাছ থেকে। তোমাকে ঝামেলায় ফেলবার কোনো অভিসন্ধিই আমার নেই। আমার কোনো আচরণে তুমি যদি অস্বস্ত্বি বোধ করো জানিয়ে দিয়ো। মানুষ বলে কথা। আচরণের তারতম্য হতে পারে।
জনপ্রিয় আমেরিকান গায়ক রয় অরবিসনের ‘রহস্য মেয়ে’ শিরোনামের একটা গানের কিছু লাইন লিখেছিলাম তোমার জন্য। ব্যাখ্যা তো দিতে পারব না। আমি কবিও নই, লেখকও নই। তবে গানটির আরও কয়েকটি লাইন লিখে দিচ্ছি, আমার ধারণা এটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধাই হবে না, ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়বে না।
She's a mystery girl
She's a mystery girl
She's a mystery girl
She's a mystery girl
She's a mystery girl
ফাহিম,
তুমি দেখি প্রেমে পড়া বারণ সংক্রান্ত কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়েছ। আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং বাবা— ট্রায়িং টু পুল ইয়োর লেগস। তোমার সীমাবদ্ধতার কথা কি আর আমি জানি না? তার ওপরে আমি নিজেও তো আমার সীমাবদ্ধতার কথা জানি। আর তুমি না বললেও আমি খুব ভালো করেই জানি যে তুমি তোমার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসো। আমিও ভালোবাসি আমার স্বামীকে। যদিও সে আর আমার কাছে নেই।
আমি তোমার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছি মাত্র ফাহিম, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি এমনই। আর হ্যাঁ, আমিও তোমাকে অনেক পছন্দ করি।
তুমি কিন্তু বললে না, কেন তুমি আমাকে মিস্ট্রি গার্ল বলেছ...প্লিজ টেল মি না।
এই ছোট মেইলটা পাঠিয়ে দিয়ে সিমির হঠাৎ মনে হলো, একটা প্রশ্ন ছিল, করা হয় নি। সে আবার লিখল—
তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, আচ্ছা তার মানে এই কি যে আমি যদি না হাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসবে না?
ওকে বাই।
তোমার রহস্য মেয়ে
পুনশ্চ: ফাহিম, আমি তোমার কাছ থেকে মায়া, দয়া, অনুকম্পা, সহানুভূতি কিছুই চাই না। যেমন আছে আমাদের চিঠির সম্পর্ক তেমনি স্নিগ্ধ ভালোবাসার আলোয় উজ্জ্বল থাকুক— এটুকুই আমার কাম্য।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.