নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৩)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৩)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১৩ তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২

গভীর রাতে হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফাহিমের।

এমনিতেই সে রাত করে ঘুমুতে যায়। খুব যে বেশিক্ষণ ঘুমিয়েছে, তাও না। এত রাতে কে ফোন করল তাকে? কী কারণে? হঠাৎ করেই সিমির কথা মনে হলো তার। কিন্তু সন্ধ্যায়ই তো ওর সঙ্গে চ্যাটরুমে কথা হয়েছে। এ সময়ে ওর ফোন আসার কোনোই কারণ নেই।

এত রাতে একমাত্র বাংলাদেশ থেকেই ফোন আসে এবং তা অবশ্যই কোনো খারাপ খবর নিয়ে। ফাহিম লক্ষ করেছে দেশ থেকে কোনো ফোন এলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার সবগুলিই হয় দুঃসংবাদ। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃসংবাদ যেন তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

ফোনটা আবারও বাজল। ঘুম চোখে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে ভেসে এল, ‘ভাইয়া, ঘুমিয়ে পড়েছ?’ ফাহিমের ছোটবোন লীনা, ফোন করেছে দেশ থেকে। তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা স্পষ্ট।

ফাহিম বলল, ‘এত রাতে ফোন করেছিস, কী ব্যাপার?’

‘তোমার অফিসের কাজের চাপ কি খুব বেশি?’

ফাহিম ফোন স্ক্রিনে সময় দেখল। তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘রাত দুটার সময় ফোন করে অফিসের কথা জিজ্ঞেস করছিস, এসবের মানে কী লীনা?’

‘তুমি কি কিছুদিনের জন্য দেশে আসতে পারবে?’ ফাহিমের কথার উত্তর না দিয়ে বলল লীনা।

‘কেন, কী হয়েছে?’ উঠে বসল ফাহিম।

‘মায়ের শরীরটা খারাপ।’

ফাহিম জানে ওর মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না অনেকদিন হলো। রাতে ঘুমায় না বললেই চলে। সারারাত জেগে থাকে। মাথা ব্যথায় কাতরায়। ইদানীং কাউকে ঠিকমতো চিনতেও পারে না। ফাহিম অবশ্য ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে ওর মায়ের ঘুমের সমস্যা। তিনি প্রচুর কথা বলেন। কাউকে সামনে না পেলে একা একাই কথা বলেন। ফাহিম দেশে গেলে মায়ের সঙ্গেই থাকে। মায়ের কোলে মাথা রেখে রাজ্যের গল্প শুনতে শুনতে ফাহিম ঘুমিয়ে যায় কিন্তু মায়ের কথা শেষ হয় না। তিনি কথা বলেই চলেন।

খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে ফাহিম। তার বুকের ওপর শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো স্মৃতি ওর মনে নেই। ওরা দুই ভাইবোন একরকম মায়ের আঁচলের নিচেই বড় হয়েছে বলা যায়। ফাহিম আমেরিকায় চলে আসার পর থেকে ছোটবোন লীনার কাছেই থাকে ওদের মা। হঠাৎ মায়ের এমন কী হলো যে, গভীর রাতে লীনা ফোন করেছে? খারাপ কিছু ঘটে নি তো? ফাহিম শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘মায়ের কী হয়েছে?’

‘ব্রেন টিউমার।’ বলেই লীনা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘তোমার বন্ধুর বড়ভাই, নিউরোসার্জন প্রফেসর দীন মোহাম্মদ দেখেছেন। অনেক ধরনের টেস্ট করেছেন। মায়ের ব্রেন টিস্যু শুকিয়ে যাচ্ছে। টিউমার রিমুভ করা যাবে না। অনেক রিস্কি অপারেশন। উনি বললেন, এভাবেই থাকতে, যে কদিন বাঁচেন’, লীনা কথা শেষ করতে পারে না।

ফাহিম বুঝতে পারল, ওর মায়ের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেওয়ার মূল কারণ তাহলে এটাই। সে চুপ করে বসে রইল দীর্ঘ সময়। মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। প্রায় বারো বছর হলো ফাহিম আমেরিকায় অভিবাসী হয়েছে। এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে সে তার মাকে কাছে আনতে পেরেছে মাত্র দুবার। তিনি বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করতেন দেশে ফিরে যাবার জন্য।

ফাহিমের মায়ের কিছু অদ্ভুত ঘটনা আছে। সেসব কথা মনে হলে ফাহিম একা একাই হাসে। যেমন, যে-কোনো জায়গায় কোনো বিদেশির সঙ্গে দেখা হলেই তিনি হাত তুলে বলতেন, আসসালামুয়ালাইকুম। উত্তরে তারাও মাথা দুলিয়ে হেসে বলতেন, হ্যালো। মাঝে মাঝে তিনি বাংলায় কথা বলা শুরু করে দিতেন। তার ছেলের নাম কী, কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি। উত্তরে তারা মাথা দুলিয়ে হাসতেন। ভাবটা এমন যেন তার সব কথাই তারা বুঝেছে। সেটা দেখে ফাহিমের মাও হাসতেন। তার মন কাড়ানিয়া সেই সরল হাসি কি তবে আর কোনোদিন দেখা হবে না? এ কথা ভাবতেই শরীর কেঁপে ওঠে ফাহিমের।

‘ভাইয়া?’

লীনার ডাকে ফাহিম সম্বিৎ ফিরে পেল। অস্ফুটে বলল, ‘উম।’

‘দুই বছর হয়ে গেল তুমি দেশে আসো না। মাকে এসে দেখে যাও একবার। না হলে পরে আফসোস করবে।’

‘হুম। আসব।’ উদাস কণ্ঠে বলল, ফাহিম।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে তুমি ঘুমাও। আমি রাখছি।’

‘ভেঙে পড়িস না। আমি আসছি।’

লীনা ফোন কেটে দিল। ফাহিম জানে লীনা ভেঙে পড়ার মেয়ে না। খুব শক্ত মেয়ে। প্রকৃতিই ওকে ওভাবে বড়ো করেছে। তেমনি ওর বুকে ভালোবাসা দিতেও কার্পণ্য করে নি। মায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় মাঝি হয়ে সংসারের হালটা প্রায় একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে।

বাকি রাত ফাহিমের নির্ঘুম কাটল।

ঘুম ভরা চোখ আর মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে সকালে অফিসে গেল ফাহিম। এক মগ ব্ল্যাক কফি খেয়ে টিম মিটিং শেষ করে দেখা করল ওর বস জ্যানিস প্যাসিলিওর সঙ্গে। জানাল ওর মায়ের অসুস্থতার কথা। বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে প্রজেক্টের কাজ যতটুকু সম্ভব করবে সে— অবশ্যই যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে। সব শুনে জ্যানিস একমাসের ছুটির ব্যবস্থা করে দিল। জ্যানিসকে ধন্যবাদ দিয়ে সেদিনই স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে দেশে যাওয়ার টিকেট কনফার্ম করে ফেলল ফাহিম।

কয়েকটা দিন প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটল ফাহিমের। একটা হাই-প্রোফাইল সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের পুরো দায়িত্বটাই তার কাঁধে। ওর টিমে আছে আরো ছয়জন। ফাহিম টিম লিড। প্রজেক্ট ম্যানেজার না থাকায় প্রজেক্ট ডেলিভারির দায়িত্ব তার। সে সবার সঙ্গে কয়েক দফা মিটিং করে কিছু দায়িত্ব ভাগ করে দিল টিমের সিনিয়র মেম্বারদের মধ্যে। বাংলাদেশে বসে প্রয়োজনে সে কাজ করবে, তাই ল্যাপটপ, অফিসের নেটওয়ার্ক ও ডাটা সেন্টারের সাথে ভিপিএন কানেকশনসহ যাবতীয় সেটআপ রেডি করে ফেলল। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সার্ভিসের যা অবস্থা তাতে ঠিকঠাক মতো কাজ করতে পারবে কি-না কে জানে।

সিমিকে খবরটা দেয়া হয় নি এখনো। কাজের ব্যস্ততায় সে সুযোগই পাচ্ছিল না। হুট করে এভাবে দেশে যাওয়া হচ্ছে, এটা জেনে সিমি নিশ্চয়ই অনেক অবাক হবে। সিমিকে না জানিয়ে দেশে গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়? তা হয়তো ফাহিমের পক্ষে সম্ভব হবে না। সারপ্রাইজ দেয়া এবং কোনো কিছু সিক্রেট রাখার ব্যাপারে সে একেবারেই অপরিপক্ক।

রাতে সিমির জন্য সে ইমেইল লিখল।

‘কেউ কি চায়, আজ বিকেলে আমার সাথে এক কাপ কফি খেতে? তাহলে নীল রঙের একটা শাড়ি পরে সে যেন তৈরি থাকে।’

সিমি প্রিয়তমেষু, একদিন ঘুম ভেঙে যদি দেখো এমন একটা মেসেজ এসেছে তোমার ফোনে, কেমন হবে ব্যাপারটা বলো তো?

বুঝতে পারছি, বেশি হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে। সহজ করেই বলে ফেলি।

দুটি খবর দিয়ে শুরু করি। একটি ভালোলাগার আর একটি মন খারাপের। কোনটা আগে শুনবে? আচ্ছা ভালোলাগারটাই আগে বলি। আমি দেশে যাচ্ছি। আর মন খারাপের খবরটি হচ্ছে, আমার মা অসুস্থ। তার ব্রেনে টিউমার ধরা পড়েছে। দু’ বছরের বেশি হয়ে গেছে মাকে দেখি না। মনটা তাই অস্থির হয়ে আছে। বিক্ষিপ্তও অনেক।

একটা বিষয় তোমাকে বলতে চাচ্ছি, জানি না, তুমি কী ভাববে, তবুও বলছি। দেশে যাচ্ছি আমার মায়ের শরীর খারাপের খবর জেনে। আমার মনটা খুবই খারাপ। অথচ আমি যতটুকু না মনোকষ্টে আছি মায়ের কথা ভেবে তার চেয়ে বেশি খুশি এই ভেবে যে, তোমার সাথে আমার দেখা হবে! এটা কি অন্যায়?

আমি ভনিতা করতে পারি না। চাইও না। তাই সত্যিটাই তোমাকে বললাম।

যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তবে দেখা হচ্ছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। ততদিন অবশ্যই ভালো থাকবে।

ফাহিম।

ফাহিম,
তোমার মেইল পেয়ে কতটা খুশি হয়েছি বোঝাব কী করে?

আবার ভালোলাগার পাশাপাশি মনটা বিষাদে ভরে গেল। দুটো খবরই কেন তোমাকে একসাথেই দিতে হলো?

তোমার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে। তোমাকে কী করে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারছি না। তোমার দুঃখ নিরসনের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগত। মনকে শক্ত করো।

তোমার সঙ্গে সত্যিই এত তাড়াতাড়ি দেখা হবার সুযোগ হবে এটা ভেবে আমি কিন্তু একেবারেই অবাক হচ্ছি না। আমার মন বলছিল তোমার সাথে সহসাই আমার দেখা হবে। আবার হতে পারে, এটাও তাঁরই পরিকল্পনা! তিনি যে আমার জন্য এত বড় একটা চমক সৃষ্টি করবেন কে জানত? এমন চমৎকার সময় আমার জীবনে এভাবে কখনো আসে নি। কিছু কিছু সুখ প্রকাশ করার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার এখনকার অনুভূতির কথা তাই অপ্রকাশিতই থেকে যাবে।

এটুকু লিখে সিমি চুপ হয়ে যায়। আর কী লিখবে, কী লেখা উচিত, তার ভাবনায় আর কিছু আসে না। ফাহিমের বাংলাদেশে আসার খবরে কেমন জানি হয়ে যায় সে। কিছুটা ভালোলাগা, কিছুটা ভয়, কিছুটা আনন্দ, কিছুটা অনিশ্চয়তা— সবকিছু মিলিয়ে কেমন জানি একটা সময়। একবার ইচ্ছে হচ্ছে, কোথাও চলে যেতে, আরেকবার ইচ্ছে করছে চুপ করে ঘরের ভেতরেই বসে থাকে। এমন দুই মেরুর মিশ্র অনুভূতি ওর ভেতর কখনো কাজ করে নি আগে। সিমি লেখা শেষ করল।

তুমি ভালো না থাকলে আমার ভারি খারাপ লাগে। আমার কথা ভেবে হলেও ভালো থেকো।

তুমি এলে তোমার সাথে মা-কে দেখতে যাব। নেবে আমাকে?

আর একটা কথা, ভেবো না, আমাদের দেখা হবে বলে আর মেইল লিখবে না। তোমার লেখা চাই, ছোট্ট করে হলেও। দু’ লাইন হলেও। তোমার লেখা আমায় মুগ্ধ করে।

তোমার লেখা-মুগ্ধ আমি।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.