[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন ১৩তম পর্ব...]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব
ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার কনসাল জেনারেল ‘আর্চার ব্লাড’ ইসলামাবাদে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর জোসেফ ফারলেন্ডকে পূর্বপাকিস্তান তথা শেখ মুজিবের যৌক্তিক আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। কিন্তু জোসেফ ফারলেন্ড আর্চার ব্লাডের কোনো যুক্তি মানতে নারাজ। সে ধরে নিয়েছে ব্লাড বামপন্থীদের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিশীল।
আর্চার ব্লাড তাকে বুঝিয়েছে শেখ মুজিব কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো কোনো বামপন্থী নেতা নন, তিনি একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। তাকে তুলনা করা যায় তুরস্কের নেতা কামাল আতাতুর্কের সাথে। নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যে যিনি গণতান্ত্রিকভাবে সংগ্রাম করছেন। আওয়ামী লীগ কোনো ক্যাডারভিত্তিক গোপন দল না, এদের কোনো সামরিক উইংও নেই। এরা সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। ইয়াহিয়া গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে ভুল করেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি।
ফারলেন্ড আর ব্লাড বসেছে তাদের বুলেট প্রুফ গাড়ির পেছনে আর রফিক নামের এক বাঙালি প্রটোকল অফিসার বসেছে ড্রাইভারের পাশে। ছেলেটি বেশ কর্মচঞ্চল, বয়স পঁচিশের কোঠায়। সব ব্যাপারে তার মতামত স্পষ্ট। কনসাল জেনারেল ব্লাড রফিকের মতামতকে বেশ গুরুত্ব দেন।
অনেক ব্যাপারে ব্লাড আর আর ফারলেন্ডের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট। হেনরি কিসিঞ্জারের বন্ধু হওয়ার সুবাদে অ্যাম্বাসেডর ফারলেন্ড ইয়াহিয়া খানকে কিছুতেই চটাতে চান না। কারণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্ট্রেটিজিক পার্টনার হিসেবে চায়নাকে খুব দরকার আর ইয়াহিয়ার হাত ধরেই চায়নার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। কিন্তু ব্লাড চান পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে হাঁটুক। স্বাধীনতার ২৪ বছর পরও পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভিত খুব দুর্বল। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে আমেরিকা প্রতিবছর পাকিস্তানকে যে চার বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দেয়, সেটা অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।
৩২ নম্বরে ঢুকতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট লোকে লোকারণ্য। শত শত মানুষ বাড়ির চারপাশে ভিড় করে আছে, যেন আজ একটা উৎসবের দিন। অনেকের হাতে বাঁশের লাঠি, মাথায় নানা রঙের কাপড় বাঁধা।
ফারলেন্ড বাঙালি প্রটোকল অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, এদের মাথায় শিখদের মতো এসব কী বাঁধা রয়েছে। টারবান নাকি?
নো ইউর এক্সেলেন্সি, এদের মাথায় বাঁধা রয়েছে গামছা, এক ধরনের টাওয়াল।
টাওয়াল তো বাথরুমে থাকার কথা। মাথায় কেন?
এটি স্যার মাল্টি পারপাস কাজে ব্যবহৃত হয়। গোসল করা, ঘাম মোছা, লুঙ্গি বাঁধা, বাজার সদাই ক্যারি করা- নানা কাজে লাগে।
লুঙ্গি কী জিনিস বুজলাম না।
লুঙ্গি হলো পুরুষের বটমের পোশাক, ওই যে মেয়েদের স্কার্টের মতো পরে আছে ওটি।
তোমাদের ইস্ট পাকিস্তানের পুরুষরা স্কার্ট পরে?
স্কার্ট নয় ইউর এক্সেলেন্সি, প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই এখানে লুঙ্গি পরে। শহরে থাকা ১০% লোক প্যান্ট-পাজামা পরে।
লুঙ্গির তলায় কি আন্ডার গার্মেন্টস পরে?
গ্রামে থাকা ৯০ শতাংশ মানুষই আন্ডার গার্মেন্টসের ব্যবহার জানে না। তবে খেতে খামারে কাজ করার সময় লুঙ্গিকে উপরের দিকে উঠিয়ে সর্ট প্যান্টের মতো করে পরা হয়। আবার নদী-নালা পার হওয়ার সময় এটি খুলে ফেলে হাতে নিয়ে নদী পার হয়।
শেখ মুজিব লুঙ্গি পড়ে?
বাড়িতে নিশ্চয়ই পরে। ইয়োর এক্সেলেন্সি বস্ত্র হলো একটা নেসেসিটি। লজ্জা নিবারণ তো আছেই সেই সাথে কালচার এবং ওয়েদার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমেরিকা ইউরোপে যেমন আপনাকে শীতের কারণে নানা লেয়ারের শীতবস্ত্র পড়তে হয় আর গরমের কারণে মানুষ এখানে স্বল্প বস্ত্র পরিধান করে।
ওয়েস্ট পাকিস্তানের সাথে তোমাদের ইস্ট পাকিস্তানের তফাৎ হলো দারিদ্রতা এখানে বড় প্রকট।
ইউর এক্সেলেন্সি এটা ছয় ঋতুর দেশ। এ দেশের মানুষকে অনেক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বন্যা মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হয়। তারপরও আমি বলব আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। কিন্তু আমাদের সব টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম-পাকিস্তান।
তুমি তো দেখছি শেখ মুজিবের ভাষায় কথা বলছো!
বেয়াদবি মাফ করবেন ইউর এক্সেলেন্সি, হি ইস আওয়ার গ্রেট লিডার। হি উইল ফাইট ফর দিস ইনজাস্টিস।
নেংটি পরে কীভাবে ফাইট দেবে তোমরা?
সারা পৃথিবীতে নেটিভরা নেংটি পরেই শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছে।
তুমি তো দেখছি কমিউনিস্টদের মতো কথা বলছো! এখন গাড়ি থেকে নেমে ক্রাউড ক্লিয়ার করো।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.